অনুষ্ঠানে পাঠে ও গান পরিবেশনায় শিল্পীরা
সম্প্রতি ‘কলকাতা ব্রেস্ট হেল্থ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘ইনার সার্কল অ্যাডভার্টাইজ়িং’-এর নিবেদনে অনুষ্ঠিত হল ‘ইতি রবি’। প্রথমেই অনুষ্ঠানের নাম মনে কৌতূহল জাগায়। মঞ্চের পর্দা সরতেই নজরে এল পুরনো দিনের পড়ার টেবিল ও চিঠি লেখার সরঞ্জাম। সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জানালেন অনুষ্ঠানের মূল ভাবনা। পরিচয় করালেন রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য পত্রালাপের মধ্যে, জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নারীকে লেখা কিছু চিঠির।
কবিপত্নীর সঙ্গে কবি যে নিবিড় সংসার পেতেছিলেন, তার চর্চা তুলনামূলক ভাবে কম। শান্তিনিকেতন গড়ার কাজে তাঁর ছোট বৌ ছুটি নীরবে পাশে থেকেছেন। চিঠিতে কবির স্ত্রীকে নিয়ে চিন্তা, চিঠির উত্তর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বারবার ধরা পড়ে। সুজয়প্রসাদের পাঠে চিঠিগুলি প্রাণ পায়। চিঠিতে লিখছেন কোন শাড়ি বেলু-রাণুকে মানাবে, কখনও লিখছেন, “আজকাল কেবল মনে হয় বাড়ির মত এমন জায়গা আর নেই।” জয়তী চক্রবর্তী তাঁর সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন—‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে’।
রবিকাকার সঙ্গে বিবির সখ্য ছিল নিবিড়। তিনি বলতেন, “আমি জানি তোকে আমি যেসব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্রভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোন লেখায় হয়নি।” কবির স্নেহ বারবার দেখা যায় স্বকীয়তায় উজ্জ্বল এই ইন্দিরাকে লেখা অসংখ্য চিঠিতে। শ্রাবণী সেন মুগ্ধ করেন ‘কেন চেয়ে আছ গো মা’ গানে।
রবীন্দ্রনাথের তিন কন্যার মধ্যে একমাত্র যাঁর মৃত্যুশোক কবিকে পেতে হয়নি, তিনি অতসীলতা/মীরা। জীবনের অনেক কঠিন পথ পেরিয়ে চলতে হয়েছে মীরাকে। পিতৃহৃদয় বারবার তার আঘাত পেয়েছে। বিপর্যয়ের মুখে অসহায় পিতা কন্যাকে নিজের ভালবাসা আর উপনিষদের আশ্রয় ছাড়া আর কী-ই বা দিতে পেরেছেন! সুজয়প্রসাদ ও সুপর্ণা দত্তর পাঠে ফুটে উঠেছে সেই বেদনা। শ্রাবণীর গানেও একই প্রকাশ ‘এই করেছ ভাল’।
রবীন্দ্রনাথ ও সরোজিনী নাইডু একে অপরের অপরিসীম গুণগ্রাহী ছিলেন। ‘বঙ্গদর্শন’-এর জন্য রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করেন ‘প্যালানকুইন বেয়ারারস’ কবিতাটি ‘পালকী বেহারার গান’ শিরোনামে। সরোজিনীর সাহিত্যবোধ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের অসীম শ্রদ্ধা ছিল, যা বারবার ধরা পড়েছে তাঁকে লেখা চিঠিতে। সুজয়প্রসাদের চিঠি পাঠ ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা শ্রোতাদের এক অসাধারণ প্রাপ্তি। সেই সময়, সমাজ ও ব্যক্তিকে তুলে ধরেছেন নির্দিষ্ট চিঠি পাঠে।
কংগ্রেস পরিমণ্ডলে সরোজিনী নাইডু ছাড়াও তাঁর পূর্বসূরি অ্যানি বেসান্তের সঙ্গে কবির বিশেষ যোগাযোগ ছিল। ভারতে শিক্ষা ও সচেতনতার প্রচারে বেসান্ত যে ভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন, তার স্বীকৃতিতেই কবি নির্দ্বিধায় ১৯১৭ সালে বেসান্তের কংগ্রেস সভাপতি হওয়াকে সমর্থন করেন। রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে তা স্পষ্ট। প্রতিটি চিঠি নিয়ে সুজয়ের গবেষণা ও সংকলন প্রশংসনীয়।
বিনয়নী দেবীর বিধবা কন্যা প্রতিমাকে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিবাহে আবদ্ধ করেন কবি। সমাজে তখনও বিধবা বিবাহের আড় ভাঙেনি। পুত্রবধূকে মনের মতো করে গড়ে তুললেন কবি। চিঠিতে বারবার লিখছেন, আশ্রমের ভার প্রতিমার উপরে দিয়ে তিনি বড্ড নিশ্চিন্ত। আদরের নাতনি পুপেকে নিয়ে লেখা চিঠি রবীন্দ্রনাথকে অন্য ভাবে চেনায়। দাদামশাই তাঁর অমৃতকুম্ভের সন্ধান পেলেন। অন্যদের লেখা চিঠিতেও পুপের কাণ্ডকারখানা লিখে আমোদ পেতেন কবি। শ্রাবণীর গান সেই আনন্দকে সম্পূর্ণ করে— ‘তুমি খুশি থাক’।
অবলা বসু ও জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল নিবিড়। দেশে মহিলাদের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনের কাজে অবলা বসুকে প্রভূত উৎসাহ দেন কবি। চিঠিপত্র থেকে গিয়েছে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শ্রদ্ধার দলিল হিসেবে। জয়তীর কণ্ঠে মনোমোহন চক্রবর্তীর লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত ‘অনন্ত অপার’ অসাধারণ!
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সের বৌদ্ধিক আদানপ্রদান নিয়ে মানুষের উৎসাহের অন্ত নেই। গীতাঞ্জলি কী ভাবে ওকাম্পোকে নাড়া দিয়েছিল, তা অবর্ণনীয়। দুজনের সাহচর্যে ঋদ্ধ হয়েছেন দুজনেই। ‘পূরবী’-র কবিতাতে সেই ছোঁয়া অপরিসীম। কবির ‘বিজয়া’ রয়ে গেলেন কবিতা/চিঠিতে।
সমগ্র অনুষ্ঠানে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় সুজয়প্রসাদের ভাবনা ও বিন্যাস। ‘চিঠি’ নিয়ে এমন অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা যায়, তা সত্যিই অভাবনীয়। পাঠ ও গান এমন নিটোল ভাবে গাঁথা, যা শ্রোতাদের কখনওই অন্যমনস্ক হতে দেয় না। অনুষ্ঠানের পরিমিত সময়, মঞ্চসজ্জার রুচি অনুষ্ঠানের মাত্রা বাড়ায়। যন্ত্রের ন্যূনতম ব্যবহার গান ও পাঠকে শ্রোতার কাছে পৌঁছতে সাহায্য করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy