এক বসন্তপঞ্চমীর দিনে একসঙ্গে জীবন কাটাবার প্ল্যানিংটা সেরে ফেলেছিলেন ওঁরা।
জগন্নাথ বসু-ঊর্মিমালা বসু।
একসঙ্গে ৪৫টি সরস্বতী পুজো কাটিয়েও কবেকার সেই খুনসুটি মেজাজে আবার ধরা দিলেন দু’জনে।
ঊর্মিমালা আগেভাগেই বলে বসলেন, ‘‘আজ কিন্তু আমাদের ইন্টারভিউ। আমি আমাদের কথা বলব। আর দেখবেন, জগন্নাথ ঠিক ওর কথা বলবে।’’
মেঘলা সকাল। বেলগাছিয়া মাঠের পিছন দিকে সেকেলে বাড়ি। তারই এক ঘরে বসে পাশাপাশি দু’জন।
ঊর্মিমালার কথার পিঠে এ বার মুখ খুললেন জগন্নাথও, ‘‘এ কী রকম কথা!’’
মনে প্রাণে তাজা যৌবনে-থাকা এই দুই প্রবীণ-প্রবীণার কথা শুনে মনে হচ্ছিল, ‘বুড়ো ছিল পরম বৈষ্ণব, বুড়ি ছিল পরম শান্ত।’ তক্কাতক্কির মাঝেই ‘পত্রিকা’র রেকর্ডার অন।
পত্রিকা: বিবিধ ভারতীর ‘বোরোলিনের সংসার’ থেকে তো অসংখ্য পুরুষের ‘ক্রাশ’ ঊর্মিমালা বসু। আর জগন্নাথ বসুর অসংখ্য মহিলা ফ্যান। তবু এই ঝগড়াঝগড়ির জন্যই কি ৪৫ বছর ধরে দাম্পত্য জুটি ব্যাটিং করেই চলেছে!
ঊর্মি: আমি বলছি।
জগন্নাথ: আরে আমাকেও বলতে-টলতে দেওয়া হবে তো!
ঊর্মি: তুমি তো প্রাপ্তির কথা বলবে। আমি তোমার পেছনে লাগার কথা বলব। তবে শুনুন। একটি মেয়ে জগন্নাথের প্রেমে পড়েছিল। এক্কেবারে গলে স্যুপ। কত রকম আদিখ্যেতা। এক বার বলল, আপনার জন্মের সময় কি মা মধু দিয়েছিল? …আচ্ছা, কার মা বিষ দেবে বলুন তো? সে তো গেল, এ দিকে অবস্থা এমন হল যে, জগন্নাথ তো তাকে আর সামলাতে পারছে না। অগত্যা আমাকে ময়দানে নামতে হল। আকাশবাণী-র ক্যান্টিনে এক দিন আমার দেওর গৌতম বসুকে নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। জগন্নাথও ছিল। ও আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘আমার স্ত্রী।’’ আমার মাথায় হঠাৎ দুষ্টুমি খেলে গেল। বললাম, ‘‘আরে, কী ইয়ার্কি মারছে দেখছিস! দাদার স্ত্রীকে বলে কিনা নিজের বউ!’’ আমার দেওরও তেমন। ও-ও জগন্নাথকে বলে বসল, ‘‘এ কী, সত্যিই তো হঠাৎ আমার বৌদিকে বৌ বলছ! কী ব্যাপার?’’ ব্যাপারস্যাপার দেখে মেয়েটি পুরো কনফিউসড। আর কোনও দিন আসেনি।
পত্রিকা: আপনি এ ভাবে মেয়ে ভাগান বলেই কি আজও অনেকে বলেন জগন্নাথ বসুর বৌ ঊর্মিমালা বসু না হয়ে অন্য কেউ হলে ভাল হত?
জগন্নাথ (উত্তেজিত): আরে, আমাকে বলেছে অনেকে, প্রেমে পড়ার পাঁচ মাসের মধ্যে বিয়ে! কী দরকার ছিল?
ঊর্মিমালা (মুখ নামিয়ে): সে তো আমাকে এখনও অনেকে বলে। অনেকেরই রাগ আমি কেন জগন্নাথ বসুর বৌ। এ যে কী জিনিস, যদি জানত! বিয়ে করলে বুঝত। আরে লোকে রোম্যান্টিক বলে, আমি তাতে ভেসে যাব? আমাকেও তো কত লোকে বলে, কী সুন্দর তোমার গলা! আমি বলি, আচ্ছা। আর ওকে যদি কেউ প্রশংসা করে তো, হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন নম্বর শেয়ার, হোয়াটস্-অ্যাপ, দুপুরে কবিতা শোনানো। এই সব সামলানো কি চাট্টিখানি ব্যাপার? ঝামেলায় পড়ি, আর বিরক্ত লাগলে নিজেকে সান্ত্বনা দিই, আমি তো জন্ম-মা, কী আর করা যাবে!
জগন্নাথ: আমাকে কিছু বলতেই দেওয়া হচ্ছে না। আশ্চর্য!
ঊর্মিমালা: (মুচকি হেসে) এই যে! দেখছেন তো, সত্যি কথা বললেই রেগে যাবে। (এ বার হাতে চাপ়ড় মেরে।) আরে অত উত্তেজিত কেন! …আমি যখন বিদ্যভারতী-তে পড়াতাম, তখন আমার সহকর্মীরা কী বলত জানেন?
পত্রিকা: কী?
ঊর্মিমালা: (হাসতে হাসতে) ওরা জগন্নাথের প্রেমের নাটকগুলো শুনত, আর বলত, ‘সব জেনে গেছি, কী করে ভালবাসার কথা বলে, আদর করে, জড়িয়ে ধরে, সব।’ আমি বলতাম, ‘সব ওই ঢাকের আওয়াজ।’
পত্রিকা: ৩৫টা বছর পেশাজীবনে একসঙ্গে কাটিয়ে দিলেন, ‘অভিমান’-এর জয়া-অমিতাভর মতো ইগো প্রবলেম হয়নি?
জগন্নাথ: আমি মানি না, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে একই পেশায় থাকলে এ রকম কোনও সমস্যা হয়। তবে অনেকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা কিন্তু করেছে।
ঊর্মিমালা: না, মোটেই তা নয়। কোনও পুরুষমানুষ বুকে হাত দিয়ে বলুক দেখি তার ইগো নেই?
জগন্নাথ: না, আমার ইগো আছে তো। কিন্তু ঊর্মির প্রশংসা হলে আমার কখনও মনে হয়নি, এটা কেন হচ্ছে।
ঊর্মিমালা: কেউ হয়তো বলল, যে মহিলা চলে গেলেন না, উনি ঊর্মিমালা বসু। ওঁর বর জগন্নাথ বসু। আমি জানি, ঘটনাটা শুনলে আজও ওর ইগোয় লাগে। আমি বলি, এটাও তো বাস্তব। তুমি যে আমার স্বামী এটাও তোমার আইডেনটিটি। তবে তার সঙ্গে এটাও আমি চাই, লোকে বুঝুক, আমি ওর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু লোকের যেমন ধারণা, জগন্নাথ বসু আমার শিক্ষক, সেটা কিন্তু ঠিক না।
জগন্নাথ (অবাক চোখে তাকিয়ে): মানে? ‘র’-এর উচ্চারণ কে শেখালো! প্রেম করতে গিয়ে উচ্চারণ ঠিক করাতে হত। বাড়ির কেউ তো শেখায়নি।
ঊর্মিমালা: আহ্! বাড়ি তুলছ কেন? তোমার বাড়িতে লক্ষকোটি জনের মুখে, ‘সোপকেস’-কে ‘শোপকেস’ বলতে শুনেছি।
জগন্নাথ: না, আমি বলিনি।
ঊর্মিমালা: আরে স্বীকার করো না, কী আছে?
জগন্নাথ: আচ্ছা, আমায় যদি বলতে না দেওয়া হয়, আমি উঠি। ঊর্মিই সাক্ষাৎকার দিক।
পত্রিকা: বলুন, আপনি বলুন।
জগন্নাথ: আমরা যখন ইডেন গার্ডেনের রাস্তায় প্রেম করতাম, তখন আমার কাজ ছিল, রোজ ওকে বলানো, ‘গড়ের মাঠে গরুর গাড়ি গড়গড়িয়ে যায়।’ ভেবে দেখুন একবার, যে সময়ে লোকে প্রেমের ডায়লগ বলে, আর আমি? তবে আমার জনডিসের সময় ও চিঁড়েদই আনত, মনে আছে…
ঊর্মিমালা: হ্যাঁ, সেই চিঁড়েদই অন্য কেউ খেত, তুমি চপ-কাটলেট খেতে। এটাও মনে আছে (প্রচণ্ড হাসি)। তবে ওর কথাতে একটা ব্যাপার বলি, এখানে এটাও দেখতে হবে, এক জন মেয়ে প্রেমের সময়ও নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার কী তীব্র প্যাশন!
পত্রিকা: শাঁওলী মিত্র, জগন্নাথ বসু এক সময় রোম্যান্টিক জুটি ছিলেন। সেই জুটি কি ভাঙলেন ঊর্মিমালা?
জগন্নাথ: আমার সৌভাগ্য, আমি শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, শাঁওলী মিত্র— তিন জনের সঙ্গেই কাজ করেছি। শম্ভুদা আমার ইন্সপিরেশন।
পত্রিকা: তা হলে কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে আপনি শম্ভু মিত্র ধারাটি নিলেন না কেন?
জগন্নাথ: আরে তখন লোকের ধারণা, প্রেম করলেই ‘বেস’ ব্যবহার করতে হবে। আরে শুধু ‘বেস’ দিয়ে যে মেয়ে পটবে না, বোঝাতেই পারতাম না। হয়তো ফোন ধরছে, চুলে হাত তখন। আরে বাবা, রেডিয়ো খুলে কে হাত দেখতে পাচ্ছে? দেখুন যোগেশ চৌধুরী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ী, এরা তো সব নর্মাল অভিনয় করতেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদের উত্তরসূরি। এই ধারাটা আমায় টেনেছিল।
ঊর্মিমালা: ও যে সময় কবিতা বলত, কবিতার জন্য তখন সব বাঘা বাঘা মানুষজন ছিলেন। পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষ, প্রদীপ ঘোষ, কিন্তু ও কথা বলার মতো করে কবিতা বলত। এই ব্যাপারটায় ও নিশ্চই ট্রেন্ড-সেটার। এটা কিন্তু আমি দর্শক বা শ্রোতা হিসেবে বলছি।
পত্রিকা: তৃপ্তি মিত্র?
জগন্নাথ: তৃপ্তিদির মতো অনাড়ম্বর সরল মানুষ আর দেখিনি। শাঁওলী তো বন্ধু। ওর-আমার জুটি তখন হিট। ঊর্মি আসার পর অনেকে শাঁওলীকে জিজ্ঞেসও করেছিল, ‘‘আপনি কেন জগন্নাথ বসুর সঙ্গে কাজ করেন না?’’ শাঁওলী বলেছিল, ‘‘এটা জগন্নাথকে জিজ্ঞেস করাই বোধহয় ভাল।’’
ঊর্মিমালা: আমি কিন্তু ঢুকব বলেই ঢুকে ছিলাম। আমি তখন নাচতেও পারতাম না। গানও গাইতে জানতাম না। এই একটাই ক্ষেত্রে কাজ করতে পারতাম। ঠিক করেছিলাম, এখানে কাজ করলে জগন্নাথের সঙ্গেই করব। লোকে এক সময় ভেবেছে, গৃহশান্তি বজায়ের জন্য ও বৌকে সঙ্গে করে মঞ্চে ওঠে। কিন্তু আমি মুখ খোলার বিপ্লবটা ঘটল। … শ্রীকুমারদা (চট্টোপাধ্যায়) এক বার আমাকে বলেছিলেন, ‘‘জগন্নাথ তুমি স্টেজে। ওম্মা, হঠাৎ দেখি একটা কচি মেয়ের গলা। কোথা থেকে আনলে? পরে ঊর্মিমালাকে দেখে চমকে গেছি।’’
জগন্নাথ: আমার সঙ্গে বিয়ে না হলে ও এই কাজে আসতই না। তবে এমন বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে এগিয়ে এসেছে, ভাবা যায় না।
ঊর্মিমালা: ডাক্তার বর হলে কম্পাউন্ডার হতাম।
জগন্নাথ: ও শেয়াল-চালাক। আমার ওর মতো বুদ্ধি নেই।
ঊর্মিমালা: (চোখ বড় বড় করে) তুমি আমাকে শেয়াল-চালাক বললে!
জগন্নাথ: আরে, তুমি নিজেও তো এই শব্দটা বলো।
ঊর্মিমালা: সে তো তোমায় একলা ঘরে ‘সোনা’ও বলি। সেটাও বলবে এখানে? খুন্তি নাড়তে নাড়তে কোন কান্নাটা কীরকম হবে, সেটা আমাকে কবে থেকে প্র্যাকটিস করতে হয়েছে, খবর রাখতে?
পত্রিকা: অন্য প্রসঙ্গ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, না উত্তমকুমার। আপনাদের কার গলাটা বেশি আকর্ষণ করে?
জগন্নাথ: উত্তমকুমার প্রসঙ্গে বলার চেয়ে আমি বলব, আমার একটা ব্যাপার সত্যিই আজও বিস্ময়ের। সৌমিত্রদা কী ভাবে এখনও এত কাজ করে চলেছেন। এক দিন জিজ্ঞেসও করেছিলাম। ওর মধ্যে একটা আর্টিস্টিক ইকনমি কাজ করে। সব কিছুর পরেও একটা পরিমার্জন। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ। সেটা সত্যি শেখার। সৌমিত্রদার প্রত্যেকটা সাক্ষাৎকার আমার মুখস্থ।
ঊর্মিমালা: সৌমিত্রদার সঙ্গে একটা সন্ধে একসঙ্গে কথা বললে, আজও অনেক কিছু শিখি। তবে উত্তমকুমার ওঁর চেয়ে বেটার কমেডিয়ান। আরও একজনের কথা বলি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একটা পার্টিতে মনে পড়ে, সুনীলদা অনেকটা ড্রিংক করেছেন। আমাকে দেখে বললেন, তুমি সরে যাও। সরে বসো। পরে কথা হবে। বলুন তো, সে দিন যদি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার হাত ধরে টানতেন, কী করতাম।
জগন্নাথ: সুনীলদার সঙ্গে পাল্লা দেব বলে, পার্টিতে এক বার প্রচুর মদ খেয়ে ফেলেছিলাম। আমি তো আউট। সেটা ছিল নিউ ইয়ার্স ইভ। এক জন মহিলাকে বলে বসলাম, ‘হ্যাপি বার্থ ডে।’ ঊর্মি তো রেগে আগুন। সে দিন সুনীলদা আমায় সামলেছিলেন।
পত্রিকা: বোরোলিনের সংসার কেমন করে সামলালেন ঊর্মিমালা?
ঊর্মিমালা: শ্রীকান্ত (আচার্য) এক বার আমায় বলেছিল, তুমি ছিলে আমাদের অডিও-ক্রাশ। বোরোলিনের সংসার শুনে আমরা আলোচনা করতাম, ‘এই গলাটা বেশ কচি। কে রে মেয়েটা?’ মনে আছে, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, গৌতম চক্রবর্তী, তৃপ্তি মিত্র, শাঁওলী মিত্র, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়— সকলের নির্মাণই এখান থেকে। সকলের থেকে দু’টাকা নিয়ে রোজ এক ধামা করে মুড়ি আসত বোরোলিনের সংসারে। সেটাই আনন্দ করে সবাই মিলে খেতাম। এমনও এক জন ছিলেন, যাঁর খাবার আসত কেনিলওয়ার্থ থেকে, কিন্তু তিনি মুড়িটা খেতে ছাড়তেন না।
পত্রিকা: আচ্ছা, কখনও মনে হয়নি, গৌতম চক্রবর্তী সময়ের আগেই হারিয়ে গেলেন?
জগন্নাথ: কী করে বলি বলুন তো! আসলে নেশাই ওকে শেষ করে দিল। শুধু ও কেন, স্বরাজ বসু। ওর ক্ষেত্রেও তাই। কী সব ট্যালেন্ট! আসলে তখন পেশাদারি থিয়েটারে বেপরোয়া মদ্যপান চলত। এখন লোকে অনেক সামলেসুমলে খান।
পত্রিকা: কেয়া চক্রবর্তীকে আপনিই নাকি কবিতা সিংহের সঙ্গে আালাপ করিয়ে দিয়েছিলেন?
জগন্নাথ: কেয়াদি আমার শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু এমনই এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর প্রেমে পড়ে তাঁর সঙ্গে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। ওঁর সঙ্গে আমি কবিতা সিংহের আলাপ করিয়ে দিই। আমার মনে হয়েছিল, দু’জনেই সময়ের চেয়ে এগিয়ে।
পত্রিকা: রেডিয়ো নাটকে আপনি যে ধরনের ‘সাউন্ড’-এর কাজ করেছিলেন, সেটা অনেকে বলে সময়ের চেয়ে এগিয়ে। কথাটা কি ঠিক?
জগন্নাথ: দেখুন, আমি শব্দের ব্যবহার দুটো মানুষের কাছে থেকে শিখেছি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর সত্যজিৎ রায়। শ্রুতি নাটকে ধরুন ফোনে সংলাপ চলছে। সেখানে হয়তো পাশের বাড়ির বাসন পড়ার আওয়াজ আসবে। এই ইমেজটা তো আমায় তৈরি করতে হবে, তাও আবার শব্দ দিয়ে। কায়িক অভিনয় আর শব্দ ব্যবহার, দুটোই ওঁদের কাছ থেকে শিখেছি। যদিও আজকের প্রজন্মকে পুরোপুরি এই শিক্ষাটা দিতে পারিনি।
পত্রিকা: কেন?
ঊর্মিমালা: এখনকার কথা আর বলবেন না। এক দিন অনুষ্ঠানে দেখি, এক মাস ক্লাস করা ফ্রক পরা একটি মেয়ে বলছে, ‘‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চেয়েছি যা পাব না’ শুনলাম। একটু দেবেন ওটা? কাল একটা অনুষ্ঠান আছে।’’ নতুন কবিতা শুনলেই বলবে, ‘‘দিদি কবিতাটা কোথায় পেলেন?’’ আমি বলি, ‘‘বই থেকে।’’ ওম্মা, সঙ্গে সঙ্গে বলে কি, বইটা একটু দেবেন! তবুও নিজের থেকে কেউ বই কিনে পড়বে না।
জগন্নাথ: আমরা, নাট্যকর্মীরা এক সময় বই নিয়ে প্রচুর আলোচনা করতাম। শেয়ার করতাম। এখন তো সে সবও দেখি না।
ঊর্মিমালা: কাল রাতে রবিশঙ্কর শুনছিলাম। শুনতে শুনতে অদ্ভুত ভাবে একটা ‘লাভ মেকিং’-এর ছবি আমার মধ্যে ধুরতে লাগল। বলতে দ্বিধা নেই, এখন গান কবিতা কেন যেন ‘ইজ্যেকুলেট’ করায়। এটা তো আমি একমাত্র জগন্নাথের সঙ্গেই শেয়ার করতে পারি।
পত্রিকা: আচ্ছা, বলুন তো, জগন্নাথ বসুর অমন একটা সফল কর্মজীবন না থাকলে শুধু বাচিক শিল্পী হয়ে থাকাটা আপনাদের ক্ষেত্রে সহজ ছিল?
জগন্নাথ: বিজন ভট্টাচার্য বলতেন, সার দিন যেমন লোকে অফিস করে, তেমনই লোকে সারা দিন লোকে রিহার্সাল দেবে, শো করবে। কেয়াদি-অজিতদারা (অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়) সেটাই চেয়েছিলেন।
ঊর্মিমালা: আমি আসল কথাটা বলতে চাই। ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় এই মাধ্যমে না এলে আমরা কোনও দিনই বাচিক শিল্পী হিসেবে শো-এর জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইতে পারতাম না। বাংলা সংস্কৃতির অনেক সেবা, আনন্দদান করেছি। তিন হাজার টাকার বেশি চাইতে পারিনি, পাছে অনুষ্ঠান না পাই। এখন আর সেটা করি না। শুধু বাচিক শিল্পী হয়ে রোজগার করাটা শক্ত। মেয়েদের ক্ষেত্রে মুগ্ধ বর থাকতে হবে। আরও একটা কথা, নাম করেই বলছি, শুনেছি সম্প্রতি গীতবিতান আর্কাইভ হচ্ছে, টম-হ্যারি-জেরি সেখানে কবিতা রেকর্ড করছে। আমাদের ডাকে না। আসলে তারাই কবিতা পড়তে পারবে, যারা উদ্যোক্তার স্ত্রীকে কবিতা বলার মঞ্চ দিতে পারবেন। পদলেহন করলে কিন্তু রোজগার করা যায়।
পত্রিকা: হঠাৎ ‘বুড়োবুড়ি দু’জনা’-তে! এ রকম একটা নাম?
ঊর্মিমালা: ’৮৩-তে দু’জনে মিলে এরকম একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম। ৩৫ বছর তো কাটল, মনে হল, আবার একসঙ্গে কিছু করি। সেখান থেকেই ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধেবেলা মিনার্ভায় ‘কথোপকথন’ আমাদের অনুষ্ঠান করাচ্ছে। নাম ‘বুড়োবুড়ি দুজনাতে’।
পত্রিকা: সিরিয়ালে এলেন না কেন? ইদানীং সেখানে তো অনেক রোজগার।
ঊর্মিমালা: ডাকে না কেউ। আমরা কোনও দিনই ‘মিডিয়া’র খাবার হতে পারলাম না। অনেক চেনাজানা। তবু ২৯ বছরে কোথাও নিজেদের ‘পুশ’ করতে পারলাম না। তবে তার জন্য সম্মান বোধ করি। সম্মান পাই। তবে খারাপ কি লাগে না? বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনে ডাক পাওয়া শো যখন হঠাৎ করে ক্যানসেল হয়ে যায়, তখন সত্যিই খারাপ লাগে।
জগন্নাথ: তুলিকা বসু, ঋতা দত্ত চক্রবর্তী প্রত্যেকেই আমার ছাত্রী। যারা এখন চুটিয়ে সিরিয়াল করছে। আমার সিরিয়ালে কোনও আগ্রহ নেই। সিনেমায় আছে। আচ্ছা, ঊর্মি আজ আমার চেয়ে বেটার খেলছে না? আমি ঠিক জমাতে পারছি না।
পত্রিকা: ঊর্মিমালা বসু কোনও দিন প্রেমে পড়েননি?
ঊর্মিমালা: পড়লে বেশ হত। ‘ইধারউধার’ হাজবেন্ডকে টাইট দেওয়ার জন্য একজন ‘ফেক লাভার’-এর দরকার হয়। এটা আমার টিপস। যদিও আমি তা পারিনি। কারণ পাশে বৌ আছে, অথচ আমার প্রেমিক যদি ফোন ধরে বলে, মিটিং-এ আছি, এই মিথ্যাচারটা আমি চাই না। আমি তো কমিটমেন্ট চাইছি না, কিন্তু বড়জোর বৃষ্টি পড়লে জিজ্ঞেস করবে, ছাতাটা নিয়েছ তো? এইটুকুই। আমার প্রেমিক থাকলে, জগন্নাথ অবশ্য তাকে মেরেই ফেলত। তাই যা হয়েছে, ভালই হয়েছে।
জগন্নাথ: যত্ত সব বাজে কথা। আমাকে আজ ঠিক মতো বলতেই দেওয়া হল না। শুধু ঊর্মির সাক্ষাৎকারটাই ছেপে দিন। ও বলেছিল না, এটা আমাদের ইন্টারভিউ? আসলে এটা ওরই ইন্টারভিউ।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy