Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

রুশদির কথা দিনে তিন বার রবীন্দ্রনাথ এক বারও নয়

তবু আইওয়া যেন না জেনেই শান্তিনিকেতনের মডেলটা ধার নিয়েছে! আমেরিকা থেকে লিখছেন সুবোধ সরকার এনট্রি ১ হাল্লা চলেছে যুদ্ধে আমেরিকার সব ভাল, দুটো জিনিস আমি নিতে পারি না। অন্যের মাটিতে গিয়ে বোমা ফেলা। দুই, এমন একটা বড়লোকের অর্থনীতি বানিয়েছে যে সবাইকে বাসন মাজতে হয়। ভাইস চ্যান্সেলারও বাসন মাজে। নিজের হাতে নিজে করো। নিজের রান্না, নিজে করো, নিজের বিয়ে নিজে করো। নিজের গাড়ি নিজে চালাও।

বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর

বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

এনট্রি ১

হাল্লা চলেছে যুদ্ধে

আমেরিকার সব ভাল, দুটো জিনিস আমি নিতে পারি না। অন্যের মাটিতে গিয়ে বোমা ফেলা। দুই, এমন একটা বড়লোকের অর্থনীতি বানিয়েছে যে সবাইকে বাসন মাজতে হয়। ভাইস চ্যান্সেলারও বাসন মাজে। নিজের হাতে নিজে করো। নিজের রান্না, নিজে করো, নিজের বিয়ে নিজে করো। নিজের গাড়ি নিজে চালাও।

ওরা নিজের দেশে গণতন্ত্র চায়, অন্যের দেশে চায় না— সত্যি কথা লিখেছিল জয়দেব (বসু)।

বেনজির ভুট্টোর একটা জীবনী লিখেছেন এখানকার একজন মেমসাহেব, সদ্য প্রকাশিত, ছোট বই ১৮০ পাতার। কিন্তু চমৎকার।

একটা তথ্য পেলাম, মুজিবর রহমান যখন ১৮২-র মধ্যে ১৮১টা সিট পেলেন তখন পাকিস্তানের মানে গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা তাঁর, তখন বেনজিরের বিখ্যাত বাবা আমেরিকায় এসে চোস্ত ইংরেজিতে বলেছিলেন, ‘‘এই বাঙালটার পা ভেঙে দেব।’’

আমেরিকা এটা শুনেই ওকে চার বিলিয়ন ডলার দিয়ে দেয়, যাও সোনা যুদ্ধ করো।

চার বিলিয়ন ডলার? কয়েক হাজার কোটি টাকার ললিপপ হাতে নিয়ে ভুট্টো করাচি ফিরে আসেন। ওই টাকা দিয়ে ঢাকা কিংবা করাচিতে পৃথিবীর দুটো শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল বানাতে পারত আমেরিকা।

এনট্রি২

আইওয়া সিটি আসলে একটা সুন্দর গ্রাম

আমি যখন ফুলব্রাইটের চিঠি পেলাম, তখন ভাবলাম এই যখের ধন নিয়ে আমি কী করব! লিখি দু’লাইন কবিতা, তাও বাংলায়, যে বাংলা এখন আর বাঙালিরাই পড়ে না।

এখানে একমাস হয়ে গেল আমার একজনকেও রবীন্দ্রনাথের নাম বলতে শুনিনি। কিন্তু সলমন রুশদির নাম দিনে তিনবার শুনছি।

একেই বলে পরিহাস!

ভারতকে যদি জানতে হয় রুশদির লেখা পড়ে, তা’হলে তার আগে এবং তার পরে আমি দু’বার আত্মহত্যা করব।

ভাগ্যিস গায়ত্রী স্পিভাক মহাশ্বেতাদেবীকে স্কটহোমের টেবিল পর্যন্ত তুলে এনেছেন, না হলে কোনও বাঙালি মালয়ালি মরাঠি লেখকের নাম শোনা যেত না। কাল থেকে ইংরেজিতে লেখো, তুমি লেখক হয়ে যাবে।

সেটা অবশ্য ইউরোপ আমেরিকাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, ভারতেও তাই। আগে ছিল রাশিয়ান ঢেউ, তার পর এল লাতিন আমেরিকান ঢেউ, এখন ভারতে যে ঢেউ তার নাম চেতন ভগত।

দিল্লি আমার কাছে জানতে চাইল আমি কোথায় যেতে চাই। যারা ফুলব্রাইট পায়, তারা কেউ যায় কলম্বিয়া, কেউ যায় বার্কলে, কেউ যায় হার্ভার্ড। মক্কা মদিনায় সবাই যায়। আমি লিখলাম আইওয়া। ভুট্টা খেতের পাশে একটা গ্রাম। আমেরিকার সয়াবিন কর্ন— এই দুটো জিনিস এখান থেকেই উৎসারিত হয়।

আমাকে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে লেখা হল, তুমি এখানে ফল সেমেস্টার পড়াবে, তোমার জন্য আমরা অফিস ঘর ঠিক করে রাখলাম। বাড়ি ঠিক করে রাখলাম। তুমি এসো।

আমাকে কবি ক্রিস্টোফার মেরিল লিখলেন, তুমি যদি ফুলব্রাইট পাও, এ বার না পেলেও যে বারই পাও, তোমাকে আমরা ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রাম-এ চাই।

কেন ক্রিস এই কথাটা বলেছিলেন, আমি বুঝতে পারলাম যখন ইন্টারভিউ দিতে আসা বেঙ্গালুরুর ডাকসাইটে অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কি প্রথম এলে ইন্টারভিউ দিতে?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, কেন বলুন তো?’

তিনি রসায়নের অধ্যাপক। একটা দুঃখের হাসি মিলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি এই নিয়ে চার বার এলাম। আমি পাবই।’

সত্যি কন্নড় ব্রাহ্মণের জেদ দেখে অবাক হয়েছিলাম। আমি হলে দ্বিতীয় বার হেইলি রোডে যেতাম না। যখন এগারোজন সাহেব-মেমসাহেব আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, আমি তখন মনে মনে বললাম, ‘বাবা তুমি ছিলে গরিব মাস্টার, নিজে ভাল করে খেতে পাওনি। আমাকেও খেতে দিতে পারোনি। কিন্তু ওপর থেকে আশীর্বাদ করো যেন আমি পারি।’

কী করে যেন আমি ফুলব্রাইট চক্করে পড়ে গেলাম সে এক মহাভারত। আসলে একদিন আকাশ থেকে জিনস পরা টিশার্ট পরা একটা মেয়ে নেমে এসে বলল, তুমি যদি পারো, তা হলে দেখা হবে চন্দনের বনে,

এনট্রি৩

সুদূর ঝর্নার জলে

প্রথম এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১১ সালে। কী করে যে এলেন! কী করে যে পারতেন। তখন কিচ্ছু ছিল না আইওয়াতে। একজন বড়লোক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন, যার নামে সম্বুগ হাউস, যেখানে আমি কবিতা পড়লাম, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল, কিন্তু দিলে হবে কী, আমাকে দু’জন আমেরিকান জিজ্ঞাসা করল, কে এই রবীন্দ্রনাথ, অ্যান ইনক্রেডিবল ম্যান হু কেম ফ্রম ইন্ডিয়া ইন অ্যানশিয়েন্ট টাইম?

আমেরিকানকে রবীন্দ্রনাথ বোঝানোর দায়িত্ব আমি নেব না। কই আমাদেরকে তো বোঝাতে হয়নি কে হুইটম্যান, কে রবার্ট ফ্রস্ট, কে অ্যালেন গিন্সবার্গ? দু’বছর বাদে যিনি এশিয়া থেকে প্রথম নোবেল প্রাইজ পাবেন, তিনি কোন আক্কেলে আইওয়াতে এলেন? আমি দু’জন গোয়েন্দা লাগিয়েছি, তাঁরা ঘেঁটে দেখছেন সব তথ্য। নিশ্চিত কোন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এখানেও ছিল।

নারীর সৌন্দর্যের আশায় এবং কবিতার উৎযাপনে তিনি পাপুয়া নিউগিনি কিংবা তিব্বত কিংবা ইকোয়াডর ছাড়া সব দেশেই গিয়েছেন।

কিন্তু আমি বলব, তিনি আইওয়াতে না জেনেই এসেছিলেন যে তিনিই পৃথিবীতে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রাম তৈরি করবেন, যেখানে ছোট্ট লণ্ঠন-জ্বলা গ্রামে দেশ-বিদেশ থেকে লেখক গায়ক বুদ্ধিজীবী শিল্পীরা এসে থাকবেন। আইওয়া ঘুরে আমার মনে হল আইওয়া না জেনেই শান্তিনিকেতনের মডেলটা নিয়ে নিয়েছে।

আমেরিকাতে আজ দেখলাম একটা ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে গেছে, নাসা নাকি দাবি করেছে তাদের বিজ্ঞানীরা সূর্যের কণ্ঠ শুনতে পেয়েছেন, সেটা ভারতীয় মন্ত্র ‘ওম’।

বিজ্ঞানের সঙ্গে বেদ উপনিষদ যুক্ত করা আমেরিকার একটা অতি প্রিয় খেলনা, সেটা আমি মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, ‘সিস্টারস অ্যান্ড ব্রাদার্স, নাসার বিজ্ঞানীরা এর পর হিমালয়ের গুহায় গিয়ে ছাই মেখে ধ্যান করুক। যাঁরা ওয়াশিংটন থেকে ড্রোন পাঠিয়ে গুপ্ত বাড়ি থেকে লাদেনকে তুলে আনে, যাদের যুদ্ধ বিমান এত নিখুঁত, তাদেরকে আর ‘ওম’ নিয়ে মাতব্বরি করতে হবে না। কোনও দিন শুনব, হলুদ, নিম, বাসমতীর মতো ‘ওম’-কেও ওরা পেটেন্ট নিয়ে নিল।

এনট্রি ৪

ভুবনডাঙায় আমার বাড়ি

সাইপ্রাস থেক এসেছেন, বাতসোয়ানা থেকে এসেছেন। নিউজিল্যান্ড থেকে এসেছেন, মায়নামার থেকে এসেছেন, গায়না থেকে এসেছেন— তেত্রিশটা দেশ থেকে লেখকরা এসেছেন। যেন লেখকদের অলিম্পিক। চিন তো আছেই। আইওয়া সিটি থেকে আইওয়া সিটি এক চক্কোর দেওয়া যায়, গাড়িতে ১৫ মিনিট লাগবে, তা হলে মনে হবে আমি চায়নায় এসেছি।

ছোট চেহারার অর্ধেক প্রস্ফুটিত চোখের মানুষগুলোর যা বুদ্ধি, বাবুঘাটে পুঁতে দিলে বাকিংহামে গাছ হয়ে বেরুবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটের বাজারে হুঙ্কার দিয়েছে, আমেরিকাকে ইমিগ্র্যান্ট ফ্রি করে দেবেন। সে কথা শুনে পাগলেও হাসছে। আমেরিক খাবে কী? পরবে কী? চড়বে কী?

খাওয়াচ্ছে চিন। পরাচ্ছে ইওরোপ। চড়াচ্ছে জাপান।

আবার আমেরিকা নিজে যদি অস্ত্র বিক্রি করতে না পারে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। উনি নাকি আমেরিকার চারপাশে একটা দেওয়াল তুলে দেবেন। কাউকে আসতে হবে না। কাউকে যেতে হবে না।

তাও লোকটা এত জনপ্রিয় হল কী করে? উইকেড চার্ম? মেক্সিকোর দিকে আঙুল তুললে তো আর হবে না, ওরা ড্রাগ আনছে আমেরিকায়। আমার কথা নয়, আমেরিকার সাধারণ মানুষের কথা, যারা কিনছে তারা সমান অপরাধী, তাদেরকে ধরুন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপুল টাকা। ধনকুবের। হোয়াইট হাউসের থেকে চার পা দূরে একটা বিরাট পুরনো পোস্ট অফিস ছিল, আমাদের জিপিও-র দশগুণ, তিনি সেই বাড়িটা কিনে নিয়ে হোটেল বানিয়েছেন।

সেটা উদ্বোধন হল বলে, সেখানে একটা ঘরের ভাড়া তিন লাখ টাকা, সবাই বলছেন, হোয়াইট হাউসে তিনি যদি ঢুকতে না পারেন, তার পাশেই হোটেলের রাজপ্রাসাদে তিনি ঢুকছেনই।

যা তা বলে চলেছেন ওবামাকে, হিলারিকে। ওবামা কালো, ওবামা খারাপ, ওবামা নাকি আইসিসের জনক।

ওবামা রাশিয়ার পুটিনের থেকেও বাজে। যে পুটিনকে আমেরিকা বলে ‘থাগ’। মানে গুন্ডা।

কিন্তু আমার চোখ গিয়ে পড়ল একজনের ওপর। সব লেখককে ছেড়ে আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলাম শাহরুখ খানের দিকে। তেত্রিশটা দেশের ২৭টা ভাষার কবি লেখককে নিয়ে জমে উঠেছে পার্টি, আমি হাতে একটা ক্যালিফোর্নিয়ার ওয়াইন নিয়ে এগিয়ে গেলাম— ‘হাই শাহরুখ, হাউ আর ইউ?’’

শাহরুখ হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে বলল, ‘আই’ম ফাইন। অ্যান্ড ইউ?’ আমি বললাম, ‘তোমার হাত খালি, তোমাকে একটা ওয়াইন এনে দেব?’

শাহরুখ বলল, ‘নো থ্যাঙ্কস, আল্লা কি কসম, আমি মদ ছুঁই না।’

এ বার সম্বিৎ ফিরে এলে। হুবহু শাহরুখের মতো দেখতে পাকিস্তানের লেখক, বালুচিস্তান থেকে এসেছেন। বললেন, ‘আমি ইকবাল, আমি গল্প লিখি, উপন্যাস লিখি, কিন্তু আমি আইটি ইঞ্জিনিয়ার। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম শাহরুখের মুখে, স্যরি ইকবালের মুখে একটা গভীর বিষণ্ণতা আছে, সেই বিষণ্ণতা যা রাগ ও বেদনার মাঝখানে বসত করে।

বললাম, ‘তোমাকে ওরা থাকতে দিয়েছে কোথায়?’ ও বলল, ‘গ্রোভ স্ট্রিট।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘রিয়্যালি? আমার কটেজ নম্বর ১০৭ গ্রোভ স্ট্রিট।’

তখনই শাহরুখের একটা ফোন এল। একটু সরে গিয়ে মুখের কাছে হাত চাপা দিয়ে শাহরুখ কথা বলতে লাগল। আমি আর্জেন্তিনার লেখকের সঙ্গে মেতে গেলাম।

উনি বললেন, ‘ভারত কেন ক্রিকেট খেলে? তোমরা ফুটবল খেলতে পারো না?’

আমি বললাম, তোমাকে যদি বলি, আর্জেন্টিনা কেন স্প্যানিশে লেখে, ফরাসিতে লিখতে পারে না?— এর যেমন কোনও উত্তর হয় না, তেমনি ফুটবলেরও কোনও উত্তর নেই।

আমাদের আড্ডায় এসে যোগ দিলেন সাইপ্রাসের লেখক স্তেফানোস। তিনি আসলে গ্রিক, লেখেন ইংরেজিতে। সাইপ্রাস বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ান। আমাকে দেখেই বললেন, ‘আমি কলকাতায় গিয়েছি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করতে গিয়েছিলাম।’

এটুকু হলেই অনেক। যে কোনও বন্ধুত্ব দাঁড়িয়ে যাবে।

আমি বললাম, ‘তুমি সাইপ্রাসের কবি নাসা পাতাপিউ ক্রিসতোফিদিসকে চেনো?’

২৬ বছর আগে ভোপালের ভারতভবনে পাতাপিউ-এর সঙ্গে আমার সাত দিনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। আমি পাতাপিউকে ভাত খেতে শিখিয়েছিলাম, কিন্তু সে বিয়ার দিয়ে ভাত খেত, তাই দেখে সুনীলদা, অশোক বাজপেয়ি আর মল্লিকার সে কী হাসি! আমার একটি কবিতার বই ‘চন্দ্রদোষ ওষুধে সারে না’ উৎসর্গ করেছিলাম। আন্তিগোনের মতো সাহসী এই গ্রিক নারী ও কবির সঙ্গে আর দ্বিতীয়বার দেখা হয়নি।

পরের দিন সকাল ন’টায় আমি গেলাম আমার প্রতিবেশী শাহরুখ ইকবালের কাছে, একই গ্রামের পাড়া। প্রচুর মেপল্ ট্রি। কিন্তু আমার মনে হল— ‘তার পর আমবন জামবন চলে/গাঁয়ের সাহেবপাড়া তারি ছায়াতলে’।

ইকবাল আর আমার বাড়ির মাঝখানে একটা বিরাট পার্কিং জোন। সেখানে অন্তত ৩০টা মার্সেডিজ এবং খান দশেক বিএমডব্লু দাঁড়িয়ে আছে। এই না হলে আমেরিকার গ্রাম!

একটা বাড়ির সামনে একটা মাচার ওপর দাঁড় করানো একটা সুন্দর কাঠের বাক্স। গায়ে লেখা ফ্রি লাইব্রেরি, বাক্সর দরজা খুলে দেখলাম হেমিংওয়ে, আঁদ্রে জিদস, হুইটম্যানের বই। যে কেউ বই নিয়ে যেতে পারে। পড়ে ফেরত দিয়ে আসবে। এ রকম লাইব্রেরি আমি আর কোথাও দেখিনি।

ইকবালের ঘরে ঢুকে বসতেই আমি একটু অবাক হলাম। ওর পড়ার টেবিলে ল্যাপটপ। টেবিলে ছড়ানো পাঁচ-ছ’টা মোবাইল, ইকবাল আমার হাতে কফির কাপ তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আই অ্যাম সিওর, আমার অগোছালো পড়ার টেবিল নিয়ে তুমি আমাকে কোনও প্রশ্ন করবে না। বরঞ্চ বলো, রাতে কেমন ঘুম হল।’

আমি কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবলাম, এখানে না এলেই পারতাম। ভুল হয়ে গেল। আমার কী জানার দরকার একটা লোকের কেন তিনটে ল্যাপটপ, ছ’খানা মোবাইল। আমি কী করব জেনে?

ইকবাল বলল, ‘কাল রাতে জ্যোৎস্নায় যখন ভেসে যাচ্ছিল সামনের সবুজ মাঠ, তখন এখান দিয়ে প্রচুর হরিণ জলে খেতে যাচ্ছিল আইওয়া নদীতে। আমি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে দেখেছি সেই দৃশ্য। ইনক্রেডিবল।

এই তো আসলে কবি, আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

এনট্রি৫

সুনীলদা ও মার্গারিটার সঙ্গে

হরিণ জল খেতে আসে যে ঝর্নায়, সেখানেই কি সুনীলদা মার্গারিটাকে নিয়ে গিয়েছিলেন?

আমি একটা ঝর্না দেখছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে আমার পাশের ঘরে বসেন অধ্যাপক এরিক, তিনি শেলি কিটস বায়রন পড়ান। তিনি পাশের ঘরে বসে ই-মেল করেন আমাকে।

এখানে এটাই চল, কেউ ফোন করেন না, সবাই ই-মেল করেন। ই-মেল করে আমি জানতে চাইলাম, তোমাদের এখানে ঝর্না আছে কাছেপিঠে?

উত্তরে তিনি লিখলেন, ম্যাকব্রিড বলে একটা লেক আছে, চারপাশে গভীর জঙ্গল, তুমি যদি চাও আমি আমার তিন কন্যা আর স্ত্রীকে বলে রাখছি, অক্টোবরের লাস্ট উইক-এন্ডে আমরা সবাই মিলে যেতে পারি, আমি জানতে চাইছি ওই হেমন্তের অরণ্যে কোনও ঝর্না লুকিয়ে আছে কিনা। যে পথ ধরে ছত্রিশ বছর আগে একটা দৈব পিকনিকের জন্য সুনীলদা ফরাসি নারী মার্গারিটার হাত ধরে গহন আঁধার পথে হেঁটে গিয়েছিলেন, আমি সেই পথটাকে খুঁজে বের করতে চাইছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে কোরালভিল চলে এলাম। এই তো এখানেই প্রবালদ্বীপ ছিল কোনও একদিন, ছত্রিশ বছর আগের ঝর্না কী আর আছে, সে শহরের তলায় হারিয়ে গেছে।

মার্গারিটাও হারিয়ে গেছে। সুনীলদার মুখেই শুনেছিলাম, তাকে কারা যেন তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তার পর সাত দিন বাদে তাকে তার বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়।

এনট্রি ৬

জীবন সুখের হয়, প্রতিবেশী যদি হয় লিজা

আমর বাড়ির জানলা থেকে লিজাকে দেখা যায়।

লিজা মানেই তো আর সেক্সি নায়িকা লিজ টেলর নয়। লিজা নামে আমেরিকায় কত মা আছেন। আমার পাশের বাড়ির লিজা সত্তর বছর বয়েসি একজন মা। তার ছেলে ম্যাট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।

ম্যাথিউজকে ওরা ম্যাট বলে। ম্যাটের একটি মেয়ে। তিন বছর বয়স। তার নাম ঈশা। তার মা জাপানি, এখনে থাকে না। রোজ সন্ধ্যায় ম্যাট আর ঈশা স্কাইপি খুলে ওসাকায় কথা বলে।

এক দিন লিজা আমার ঘরে এলেন। বললেন, ‘ম্যাট আমার ছেলে নয়। ম্যাট আমার বন্ধুর ছেলে। ম্যাটের মা কিছুতেই এল না। এত ছোট মেয়েটাকে নিয়ে কী করে সামলাবে, আমি তাই ওর ঘর গুছিয়ে দিতে এলাম। ’

পনেরো দিন বাদে লিজা আবার আমার ঘরে এলেন, ‘তুমি জানো, ম্যাট আমার সঙ্গে কথা বলছে না? আমি রান্না করি, মেয়েটাকে স্কুলে দিয়ে আসি। ভ্যাকুয়াম করি (পড়ুন ঝাঁট দিই)। তবু ম্যাট আমার সঙ্গে কোনও আলোচনা করে না। আমি চললাম, আমি কাল নর্থ ক্যারোলাইনা চলে যাব।’

ইতিমধ্যে লিজা আমাকে বার্নার জ্বালাতে শিখিয়েছেন। ওয়াশিং মেশিন চালাতে শিখিয়েছেন। সস্তায় ব্রকলি কিনতে শিখিয়েছেন, নিজের গাড়িতে করে আমার বাজার এনে দিয়েছেন। সেই মানুষটা যখন বললেন, ‘আমি কাল চলে যাব।’ তখন আমি ভাবছিলাম, একজন মায়ের অভিমান।

কিন্তু পরের দিন সকাল বেলা উঠে দেখলাম গাড়িটা নেই। তার বদলে দেখলাম বাড়ির সামনে মেপল গাছে বাঁধা হয়েছে একটা দোলনা। লিজা ভোরবেলা উঠে দোলনা টাঙিয়ে দিয়ে গেছে ঈশার জন্য!

ঈশা বারবার বলত, ‘আমি একটা দোলনা চাই। আমি একটা দোলনা চাই।’

কাল বাড়ি ফিরে দেখলাম, একটা খাম। খুলে দেখি লিজা লিখেছেন, মিসিং ইউ, সুবোধ।

চোখের কোণটা ভিজে গেল।

তাকিয়ে দেখলাম, দোলনার দড়ি ধরে তিনটে কাঠবিড়ালি উঠছে আর নামছে। তাদের সঙ্গে জাপানি ভাষায় কথা বলছে ঈশা।

এনট্রি৭

দশ দিনের বেশি আমেরিকায়

থাকব না

আমাকে বাসন মাজতে হল। এ-ও ছিল কপালে!

আমাকে গুণিজনরা বললেন, আরে বাবা, আমেরিকায় গিয়ে সবাইকেই বাসন মাজতে হয়। ও কিছু না। উপাচার্যকেও বাসন মাজতে হয়।

আমি বললাম, আমাকে একটা জিনিস বলুন তো, এটা কী রকম ইকনমি তৈরি করেছেন আপনারা, একটা নেল-কাটারের দাম পাঁচ ডলার? মানে সাড়ে তিনশো টাকা। এই জন্যই তো চাইনিজরা ঢুকে পড়েছে। আমরা দশ টাকা দিয়ে নেল-কাটার কিনি, কিন্তু আমাদের গণেশের মা, লক্ষ্মীর মা আছে, তাঁরা আমাদের রেঁধে দেন। আমি রান্না করতে পারব না। আমি বাসন মাজতে পারব না। আমি কাপড় কাচতে পারব না। কেন সময় দেব, আমার হাতে বেশি সময় নেই, আমাকে লিখতে হবে। রইল আমার ফুলব্রাইট। আমি চললাম।

ওয়াশিংটনে ফোন করে কথাগুলো বলব ভেবেছিলাম। পারিনি। আমার কলকাতা অনেক ভাল। মাসি আছে। চালক আছে। লোকজন আছে।

এই যে অর্থনীতির বিন্যাস, এটা অনেক বেশি মানবিক। সুতরাং আমরা হাজার হাজার মধ্যবিত্তরা কষ্ট করে বড় হয়েছি, এখন নিজেরা খেতে পাই। অন্য পরিবারকে খেতে দিই।

এই মডেল আমেরিকাকে নিতে হবে একদিন। একটা সেমেস্টার থাকা, মানে চার মাস থাকা, খুব কঠিন।

কলকাতা আমাকে ডাকছে। দশ দিনের বেশি থাকা উচিত নয় এখানে। ছাত্রছাত্রী যারা আসে পড়তে, তাদের কথা আলাদা। তাদেরকে আমেরিকা চিরতরে কেড়ে নেয়, তাদের মা-বাবারা সন্ধেবেলা সল্টলেকের কয়েকশ নির্জন ব্যালকনিতে বসে থাকেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই প্রথম একটা ভাল দিক নজরে এলা। যদি তিনি আমেরিকার চারপাশে দেওয়াল তুলে দেন, সত্যি বলছি, সল্টলেকের খুব উপকার হবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy