Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Aman Ali Khan

প্রতিটি স্পর্শে ধৈর্য

আমানের এ সন্ধ্যার প্রথম পরিবেশনার আলাপ-অংশ বিস্তৃত এবং অনুনাদী খাদরণনের সঙ্গে অনুনাদী মিঠে ঝংকারের সুষম সমাহার। বাদন শুরু থেকেই উদাসী বাউলের মতো পথ চলছিল।

জি ডি বিড়লা সভাঘরে আমান আলি খান

জি ডি বিড়লা সভাঘরে আমান আলি খান

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:৩১
Share: Save:

আমান আলি খান ইমনকল্যাণ ধরলেন প্রার্থনার আবেশে। শান্তিময় সমাহিত নির্বিকল্প ভঙ্গি। এ সন্ধ্যায় এই চলনই পরে হয়ে উঠবে ধ্রুপদগন্ধী নিবেদন-আর্তি। সম্ভবত ইমনকল্যাণে আমান এই ভঙ্গিটিই পছন্দ করেন। কলকাতার জি ডি বিড়লা সভাঘরে ‘সুতানুটি পটকথা’র সাম্প্রতিক এই আয়োজনে সেই চলনেই একক সরোদবাদনের অনুষ্ঠান শুরু করলেন শিল্পী।

আমানের এ সন্ধ্যার প্রথম পরিবেশনার আলাপ-অংশ বিস্তৃত এবং অনুনাদী খাদরণনের সঙ্গে অনুনাদী মিঠে ঝংকারের সুষম সমাহার। বাদন শুরু থেকেই উদাসী বাউলের মতো পথ চলছিল। তার প্রমাণ ভিয়ান-উপচানো মিড়ের লাবণ্যে। কল্যাণ ঠাট। পূর্বাঙ্গ। আমির খসরুর বিতর্কিত ‘মিথ’। দুই মধ্যমের ব্যবহার। তবে এ সন্ধ্যায় আমানের সবচেয়ে বড় বন্ধু শুদ্ধ মধ্যম। তার উজাড় ব্যবহার গোটা উপস্থাপনাকে পরম্পরাঋদ্ধ ধ্রুপদের চলনে বেঁধে রেখেছিল। আলাপ-অংশের সব চেয়ে বড় পাওনা শিল্পীর ধৈর্য, যা শ্রোতার মনে ধীরে ধীরে রাগটির আবেশ সঞ্চার করছিল। শিল্পী যে সচেতন ভাবেই এটা করছিলেন, তা বুঝতে ভুল হয় না তাঁর ইচ্ছাকৃত বিলম্বিত ‘স্ট্রোক’ ব্যবহারের সৌজন্যে। উচ্চগ্রাম স্বর ব্যবহারেও এই ধৈর্য ফুটে উঠছিল। জোড়-পর্বে চমক গমকের। সেখানে উত্তরাধিকার, ঘরানা আর পরম্পরার আখর। সেই সূত্রেই আবির্ভাব অনবদ্য ঝালার। যার শরীরে শিল্পী আঁকলেন ঠোক-ঝালা, গমক-ঝালা, মিশ্র ঝালার উল্কি। মধ্যেমাঝে দক্ষিণ ভারতের যমুনা কল্যাণীও ছুঁয়ে রইল বাদনকে।

ঝাঁপতাল এল তালবিজ্ঞান মেনেই। তবলায় আমান আলি খানের সতীর্থ ওজস আধ্যা। তবে ঝাঁপতালও ঝাঁপ দিল ধৈর্যের পরীক্ষায়। ইমনকল্যাণে ১৬ মিনিটের মতো দশ মাত্রার যাপন দুই শিল্পীর। ঠিক যে ধৈর্য নিয়ে মধ্য জোড় থেকে দ্রুত জোড়ে এসেছিলেন আমান, সেই ছন্দেই এগিয়ে চলল ঘরানাস্নিগ্ধ ‘কম্পোজিশন’। ধ্রুপদ-অঙ্গে তারই ইঙ্গিত। গোটা ঝাঁপতাল-পর্ব অনপনেয় নির্মিতি। সেখানে দ্রুতির মধ্যেও রইল মিড়ের পেলবতা। দাপুটে বোলতানের হাত ধরল সেই একাত্ম নিবেদন, যার আভাস শুরু থেকেই বুনে রেখেছেন শিল্পী। ঝাঁপতাল থেকে তিনতালে এলেন আমান। এলেন অন্য আলিম্পনে। খানিক তালফেরতার নিরন্ধ্র সন্ধিসময় তৈরি করে। মধ্য-দ্রুতে প্রবেশ এবং ক্রমে দ্রুতিবৃদ্ধি। এই ‘দ্রুতিবৃদ্ধি’ হালের চেনা গতিবৃদ্ধি নয়। সাধারণত যা দেখা যায়, তাতে বিপুল কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় এবং ঘুমন্ত শ্রোতাও জেগে উঠে হাততালিতে মুখর হন। না, তেমন নয় একেবারেই। মেজাজ বাঁধা নিবেদনেই এবং সুগন্ধটি ঐতিহ্যের। মাঝে আর্তির ঝাঁজপ্রাবল্য বেড়েছে লয়ের হাত ধরে— এইমাত্র। এখানে আমানের সহ-জাদুকর ওজসও। আমানের ২৮ মিনিটের অবিস্মরণীয় তিনতাল-পর্বে ওজসের মাপা হাতের প্রতিটি স্পর্শে মেধাই অনূদিত।

আমান আলি খানের ইমনকল্যাণের এই কল্যাণী অবয়ব মনে রেখে দেওয়ার মতোই। পরে আরও দু’টি রাগের পরিবেশনা ছিল এই সন্ধ্যায়। সে দু’টিও দুরন্ত। কিন্তু এ সন্ধ্যার সেরা প্রাপ্তি সম্ভবত ইমনকল্যাণই। এত প্রেম, এত আর্তি, এত মাথুর, এত নিবেদন— প্রতিবেদনে তার প্রকাশ প্রতিবেদনারই নামান্তর।

আমানের পরের পরিবেশনা তিলক কামোদ। ছোট পরিসর। পঁচিশ মিনিট। বিলম্বিত ও মধ্যলয়ের ‘কম্পোজিশন’। আমজাদখানি একহারা তান-গৎ। কম্পোজিশন এবং বাদনে প্রকাশ সরোদ বাদ্যটির বিবর্তন-সমাচারও। যা আমানের উত্তরাধিকার এবং পরিবারিক আবিষ্কার। গোটা নিবন্ধ তিনতাল-নিবদ্ধ। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তিলক কামোদ খাম্বাজ ঠাটের সদাচঞ্চল রসিক রাগ। তবে অভিমানীও। পাহাড় চড়ার সময় একবার আনবাড়ির ধৈবতে পা দিলেই হাল ছেড়ে দেয়। পাশাপাশি, প্রতি মুহূর্তে দেশ রাগের আকর্ষণী আঠাজালও বিছিয়ে রাখে। আমান এই সব সম্ভাবনার আভাস নিপুণ প্রাখর্যে ছত্রে ছত্রে ছুঁইয়ে দিয়ে স্থির রইলেন তাঁর লক্ষ্যে। সুরের মন নখদর্পণে দেখতে পেলেই যা সম্ভব একমাত্র। তিনতাল-নিবদ্ধ উপস্থাপনায় এখানেও আমানের সতীর্থ ওজস সারা-সময় মাপা-মেধান্বিত।

সন্ধ্যার শেষ উপস্থাপনা মিয়াঁ কি মল্লার। তিলক কামোদের মতোই ফের আরোহণে ধৈবতহীন শরীর। কাফি ঠাট। তিলক কামোদের মতোই এ ক্ষেত্রেও রাগরূপ প্রতিষ্ঠার অনায়াস বয়ান-বিস্তার। তিনতালের ধারাগতি। যৌথ নিষাদের মেঘমেদুর সাম্পানে সওয়ার হয়ে বৃষ্টিবন্দনা। মার্গবাদনের ধারানুযায়ীই শুরু। কিন্তু শুরু ছক ভাঙার খেলাও। দু’-এক আঁচড়ে রাগপ্রতিমা নির্মাণ করেই ডুব এ রাগের জনয়িতা মিয়াঁ তানসেনের রাজসিকতায়। কয়েক মাস আগেই কলকাতার আর এক প্রেক্ষাগৃহে আমানের মল্লারভ্রমণের সাক্ষী হওয়া গিয়েছিল। সে সন্ধ্যায় নানা মল্লারের মালা গেঁথেছিলেন শিল্পী। এ সন্ধ্যায় তিনি নির্বাচিত রাগ-কাঠামো ছেড়ে ভিন্ন বয়ানে গেলেন না, ঠিকই। তবে দু’টি কম্পোজিশনে ধরা রইল নানা রসের অনুভূতির প্রস্তাবনা। রইল মিয়াঁর দরবারি পেশকারি, সুগম্ভীর হাহাকার আর যৌথ নিষাদের বিচ্ছেদকান্না। আমান রাঁধলেন, ওজস বাঁধলেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Aman Ali Khan Sarod Players Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy