দৃশ্যকল্প: ‘ইউনিটি’ প্রদর্শনীতে শিল্পী নিত্য কুণ্ডু এবং সুব্রত পালের কাজ।
পুরাণনির্ভর, বিশেষত ভারতীয় পুরাণকেন্দ্রিক চরিত্র ও বিভিন্ন ঘটনার অংশবিশেষ এবং অজস্র ভারতীয় দেবদেবীর মধ্যে জনপ্রিয় চরিত্রগুলি নিয়ে আজও শিল্পীরা বিস্তর চিত্রচর্চায় সীমাবদ্ধ। কী সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক, কী দলীয়, এমনকি একক প্রদর্শনীসমূহেও এমন সব নানা ধরনের পেন্টিং দেখা যায় আকছার। ধর্মীয় চিত্রকলা, প্রাগৈতিহাসিক চিত্রশিল্প, ইতিহাসনির্ভর চিত্র... সবই বিশ্বজোড়া এক বিরাট ঐতিহাসিক অধ্যায়। স্থান-কাল-সময় নির্বিশেষে শিল্পীরা যেমন পৃষ্ঠপোষকতা-নির্ভর কাজ করেছেন, সময় যত এগিয়েছে সমস্ত কিছুতেই একটি পরিবর্তিত ভাবনাচিন্তা, বিশেষ করে শিল্পীদের চিন্তার স্বাধীনতা-উত্তর সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও নানা বদল এসেছে আঙ্গিক থেকে শিল্পসৃষ্টির নির্দিষ্ট অনেকগুলি জায়গায়। সে প্রাচ্য, পাশ্চাত্য, আফ্রিকান সমস্ত স্থান-কালের নিরিখেই। ধ্রুপদী রীতি থেকে আধুনিকতার উত্তরণ ও বিমূর্ততার ক্ষেত্রেও বহু সৃষ্টির মধ্যেই রয়ে গিয়েছে শিল্পের সে সব অসাধারণ কুশলী নিপুণতা।
ভারতীয় পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত ও পরবর্তী সময়ে রচিত আরও বিবিধ কাব্য-সম্বলিত অধ্যায়গুলিতে ‘রাধাকৃষ্ণ’ একটি বিশাল জায়গা জুড়ে বিরাজমান। চিত্র-ভাস্কর্যে ভারতীয় বহু শিল্পী-ভাস্কর দু’টি চরিত্রকে নিয়ে কতই না সৃষ্টি করেছেন! আশির দশকের প্রথম দিকে কলকাতায় চিত্রশিল্পী-লেখক-সম্পাদক শুভো ঠাকুর নিজস্ব অবিশ্বাস্য সংগ্রহ থেকে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর কিছু অজানা শিল্পীর আঁকা ছবি নিয়ে নিজেরই আস্তানার দ্বিতলে ‘কল অব দ্য ফ্লুট’ নামে অবিস্মরণীয় এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন, বংশীবাদনরত কৃষ্ণের নানা মুহূর্তের পেন্টিংয়ের।
‘টুনু আর্ট উইন্ডো’ গ্যালারিতে ‘ইউনিটি’ নামের প্রদর্শনীতে নিত্য কুণ্ডুর বিভিন্ন টেম্পারা, জলরং, ওয়াশ, অ্যাক্রিলিক, আর্থ-কালারের কাজগুলি ফিরিয়ে দিচ্ছিল ওই সমস্ত পুরনো স্মৃতি। তাঁর ছবি রূপকথা, অথচ রূপকথা নয়। সচিত্রকরণ, অথচ সচিত্রকরণ নয়। পুরাণের ছবির আদল কিছুটা থাকলেও, সমগ্র রচনায় নিত্যর এক নিজস্ব স্টাইল ও টেকনিকের নম্র, স্বচ্ছতোয়া বর্ণের এক চমৎকারিত্বের প্রকাশ পরিলক্ষিত। রাধাকৃষ্ণের সমূহ রচনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আপাত-বৃহৎ টানাটানা দীঘল চোখ ও বড় অক্ষিগোলকের চাহনির মধ্যে এক ধরনের নীরব ও মিষ্টি চাহনি আনতে চেষ্টা করেছেন। ধরে ধরে করা কাজ। কাজে সেই অর্থে পেন্টিংয়ের চিত্রগুণ যেন বড্ড থমকে থাকা, সাবধানী। বর্ণিল আবহের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফিনিশিং সম্পর্কে অতি সচেতন শিল্পী। রূপ, অলঙ্কার, প্রয়োজনীয় পত্র-পল্লবিত পুষ্প, বৃক্ষ, পক্ষী, জলের তরঙ্গ, মৎস্য সমূহের মুখোমুখি-সন্তরণ, আকাশে ভাসমান মেঘ ইত্যাদিতে কোথাও একটু হলেও কাঠিন্যের প্রকাশ আছে। ড্রয়িংয়ের বাস্তবতাকে যথাযথ ভাবে রক্ষা করলেও, কোথাও শারীরিক স্থূলতার ফলে রাধার হাত বা অন্য কিছু প্রত্যঙ্গ একটু হলেও বিসদৃশ লাগে। বর্ণ ব্যবহার, আলো-ছায়া, আলো-আঁধারি এক নাটকীয়তা দৃষ্টিনন্দন। রূপকথা-সদৃশ ‘নস্টালজিয়া’, পুরাণনির্ভর ‘মা মনসা’, ‘রাধাকৃষ্ণ’, ‘মা গঙ্গা’, ‘গণেশজননী’, ‘লাভ’ কাজগুলি অনন্য। ছায়াতপের ব্যবহার, ব্রাশিংয়ের পরত, মিশ্রবর্ণের অতি নম্রতার লাবণ্য, বাহুল্যহীন রূপারোপ ছবিগুলিকে এক আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
প্রদর্শনীর আর এক শিল্পী সুব্রত পাল জলরং করেছেন। মুখাবয়ব, নৌকো, নিসর্গ, বাঁদর, সাধু, নদী, নদীতট অবয়বীপ্রধান কিছু কাজ। ড্রয়িংয়ের ক্ষেত্রে অবয়বীপ্রধান কাজে রিয়েলিজ়মের বিবর্তিত রূপারোপ কিছুটা মার খেয়েছে তাঁর স্টাইলাইজ়েশনে। বিশেষ করে ‘সি’ বা ‘সি ওয়ান’ কাজ দু’টিতে। স্পেসের শূন্যতা ও অন্য অনুষঙ্গ বা রূপ অ্যারেঞ্জমেন্টও নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও বিপর্যস্ত হয়েছে। সুব্রতর জলরঙের হাতটি মন্দ নয়। তিনি রঙের স্বচ্ছতা ও মিশ্রবর্ণের ব্যবহারে মুনশিয়ানা এনেছেন অন্য কিছু কাজে। ‘চিৎপুর’ জলরংটি এর উদাহরণ। এক নির্দিষ্ট দূরত্ব ও কিছুটা (সামান্য হলেও) ‘বার্ডস আই ভিউ’-এ দেখা ট্রাম ও মানুষের ট্রামে ওঠার মুহূর্ত, দূরের আংশিক মসজিদের মাথা, রাস্তার দু’ধারের পুরনো বাড়িঘর-সহ সমগ্র লাবণ্যময় রচনাটি বেশ লাগে। নীল বর্ণের অনন্য ব্যবহারে নৌকো নিয়ে করা ‘বাবুঘাট’ ছবিটিও অসামান্য জলরং। স্পেস, রং, রঙের কুশলী বিভাজন ও নদীতটের অসাধারণ মিশ্রবর্ণে চোখ টানা রচনা। ‘দিঘা’ নামের জলরংটিও মন্দ নয়। ‘দ্য টাইম’, ‘জোকার’ এবং ‘সি অন জীবনতরী’ কাজগুলিতে আবার কিছু দুর্বলতা প্রকট। তুলনায় ‘হার্মিট’ নামের কাজটিতে সাধুর মুখ, বিশেষত পাশে-দূরে অবস্থিত জলাধার, সিঁড়ি, মন্দিরগুলির ট্রিটমেন্ট ভারী সুন্দর। এর আলোছায়াও অনবদ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy