একটি রোগ গোটা বিশ্বকে যে ভয়ঙ্করতায় তছনছ করেছিল দুটো বছর, কিছুটা গুছিয়ে ওঠার আগেই মানুষ টের পাচ্ছে আবার তার ভ্রুকুটি। ওই বিষাক্ত সময়কে নিয়ে মৃত্যুমিছিলের অভাবনীয় শোকের মধ্যেও সৃষ্টি, সৃজনশীলতা কিন্তু স্তব্ধ হয়ে যায়নি। শিল্পী-ভাস্করেরাও ওই ভয়াবহ সময়কে নিয়েই করেছেন অজস্র কাজ। সেই করোনা-ই কিন্তু তাঁদের রচনাকে আর এক রকম ভাবে প্রভাবিত করেছিল।
আনন্দী আর্ট গ্যালারি ২৪ দিন ধরে চলা, সাত জনের কাজ নিয়ে ‘রেনবো’ শিরোনামে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। এই একক প্রদর্শনীর শেষ শিল্পী ছিলেন বাপ্পা ভৌমিক। অতিমারির আবহেই ছবি এঁকেছিলেন। তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার অভিঘাত কী কী ভাবে শিল্পীর কাজে ছায়া ফেলেছিল, শুধু রঙিন পেন-ইঙ্কের কাজগুলিই তার নিদর্শন। মানুষ, পশুপাখিকে (সামান্য হলেও) নিয়ে এমন অদ্ভুত বিচিত্র রূপাবয়ব একটি ‘রোগ’কে কেন্দ্র করে একজন শিল্পীকে কী ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে তিনি চেষ্টা করেছেন তা বোঝাতে।
বাপ্পার কাজে মানুষের মুখ ও শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ ও বিশেষ সব অঙ্গভঙ্গির স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক বিবর্তিত রূপের মধ্য থেকে তীব্র ভাবে বেরিয়ে আসা ও ঢুকে যাওয়া অন্যান্য প্রত্যঙ্গের বিবিধ মুহূর্তগুলি বেশ অদ্ভুত। বিকট, চমকপ্রদ, বিকৃত, আধাভৌতিক, অলৌকিক, ব্যঙ্গাত্মক... এমনই সব বিচিত্র রূপাবয়ব নিয়ে তাঁর ড্রয়িং।
প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে ডাচ চিত্রকর হিয়েরোনিমাস বসের পেন্টিংয়ে অদ্ভুত ও অত্যাশ্চর্য সব রূপ দেখা গিয়েছিল। সাররিয়ালিজ়মের সেই তো এক ধরনের সূত্রপাত বলা যায়। যদিও ইউরোপে তার প্রায় ৪০০ বছর পরে সাররিয়ালিজ়মের আবির্ভাব। বাপ্পার ড্রয়িংগুলিকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ-ও এক ধরনের অধিবাস্তববাদেরই নামান্তর। কাজগুলি কোনও কমপ্যাক্ট কম্পোজ়িশন নয়। সহজেই কোনও অলৌকিক বা বিচিত্র গল্পগাথার সঙ্গে দিব্যি ইলাস্ট্রেশন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। একটি স্বাভাবিক রূপের কোনও অংশকে ভেঙে, দুমড়েমুচড়ে, অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অংশের মধ্যে প্রবেশ ঘটিয়ে রূপান্তর করেছেন। মানুষ, পশুপাখি, জন্তুর অদ্ভুত বাঁকাচোরা শরীরী বিভঙ্গ। এ সবই কিন্তু ওই সমাজ, সভ্যতা, জীবনযাপনের উপর করোনার নখর, নৃশংস থাবায় ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া ভাবনাচিন্তার এক-এক রকম সাব-কনশাস। রঙিন রেখায় ও সাদাকালো রেখাঙ্কনে।
বাপ্পা এখানে মানুষের মুখ, মুখগহ্বর, হাঁ-মুখ, দাঁত, নখ, হাত-পা, বুক, পাঁজর, জিহ্বা, নিতম্ব ইত্যাদি ইন্দ্রিয় ও প্রত্যঙ্গগুলিকে নিজের মতো পোস্টমর্টেম করেছেন তাঁর রচনায়। বিকট ভাবেই কোনও ইন্দ্রিয় বা প্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিক পর্যায়ে বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরছে অন্যান্য প্রত্যঙ্গকে। এই অধিবাস্তববাদী বিশ্লেষণ ইলাস্ট্রেটিভ হলেও, এর চিন্তা ও প্রতিক্রিয়ার পিছনে একটা বার্তা থেকেই যায়। শিল্পীর নিজস্ব বক্তব্যের প্রেক্ষিতে দেখলে, রাজনীতির মারাত্মক এক কূট অভিপ্রায়, সামাজিক অবক্ষয়, মানব-যন্ত্রণার অভিঘাত... সবই এই করোনার প্রাক্কালে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর কাজে সূক্ষ্মতর হলেও একটি পলিটিক্যাল মেসেজ আছে। মানুষের বিভ্রান্তি, উন্মাদনা, ক্লেশ, যৌনতা, সমকামিতা, আবেগ, আলিঙ্গন, যন্ত্রণা, ভয়, আর্তনাদ, অভিশাপ, এক ধরনের অত্যাচার, নৃশংসতা, অবক্ষয়কে তিনি ওই অতিমারি কালে গৃহবন্দি অবস্থায় একাকিত্বের ঘেরাটোপে তাঁর অনুভূতিকে প্রকাশ করেছেন।
তাঁর ছবিতে যৌনতা এসেছে ওই বিকৃত কাম ও অবৈধ সম্পর্কের টানাপড়েনে। তৃতীয় লিঙ্গ, উভকামিতা, শারীরিক আদিম প্রবৃত্তি, অবৈধ সম্পর্কের পাশাপাশি সমবেদনা, আকাঙ্ক্ষা, উন্মাদনা, না-পাওয়ার যন্ত্রণা... এমন অনেক নঞর্থক জায়গাকেই তিনি দেখাতে চেয়েছেন। অতিমারি কখনও প্রতীক ও রূপক হিসেবেও প্রতিভাত।
রেখার বিবিধ আঁচড়, সূক্ষ্মতা, স্ট্রোক, রেখার একক চলনে কাব্যময়তা, সামান্য হালকা জলরং অথবা অ্যাক্রিলিকের ব্যবহার, টোনাল ভেরিয়েশনের সামগ্রিকতা, পরিমিত রেখার ব্যবহার— সব মিলিয়ে তিনি সাবধানী কৌশলই অবলম্বন করেছেন। তবু সচিত্রকরণের প্রাধান্য থাকা এই ড্রয়িংগুলিতে যেমন রিয়্যালিজ়মের এক চমৎকার নিদর্শন লক্ষ করা যায়, তেমন ওই রিয়্যালিজ়মই ড্রয়িংয়ের হাত ধরে হঠাৎ বাঁক বদল করে চলে যায় সাররিয়ালিজ়মের দিকে। একটি মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা লম্বা জিহ্বার সম্মুখে তারই আর এক মুখ, জন্তুর নিতম্বে দাঁতের সারি, মনুষ্য পদযুগল, ওষ্ঠাধর ফাঁক করা লিঙ্গের লোভ মাগুর মাছে, আঙুলময় শরীরের সঙ্গে পায়ের মিলন, দাঁত-জিহ্বা প্রকাশিত কুকুরমুখো মানব, শূকর ও ধনেশমুখো মানব... এমন আরও সব বিচিত্র অদ্ভুত ছবি। তবে বিশেষ করে তাঁর ‘হোপ’, ‘এক্সাইটমেন্ট’, ‘ফেস’, ‘নেচার’, ‘ইন্টিমেট’, ‘লাভ’, ‘গে’, ‘থার্ড জেন্ডার’, ‘পলিটিক্স’, ‘ড্রিম’, ‘রিলেশনশিপ’, ‘কন্টেম্পোরারি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy