মূল্যবান: কে জি সুব্রহ্মণ্যনের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম
শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যনের শতবর্ষ উপলক্ষে ইমামি আর্টে একটি প্রদর্শনী দেখা গেল সম্প্রতি। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন মুম্বইয়ের পরিচিত কিউরেটর ন্যান্সি আদাজানিয়া।
১৯২৪ সালে কেরলে শিল্পীর জন্ম। অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করার পরে দেশে স্বাধীনতা সংগ্ৰামে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কিছু দিনের জন্য জেলেও যেতে হয়। কলেজের পড়াশোনা সেখানেই শেষ। পরের পর্বে তিনি চলে আসেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে। নন্দলাল, বিনোদ বিহারী এবং রামকিঙ্করের মতো শিল্পীদের সাহচর্য লাভ হয়। তাঁরা শুধু কৌশল-ই শেখাননি, সাহায্য করেছিলেন শিল্পীর মধ্যে এক দর্শন আর নীতিবোধ গড়ে তুলতে, যা সুব্রহ্মণ্যনকে গড়ে তুলেছিল একজন দুর্দান্ত শিক্ষক এবং দার্শনিক শিল্পী হিসেবে।
শিল্পীর সাত দশকের ছবি এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। সাজানো হয়েছিল তাঁর ২০০টি শিল্পকর্ম দিয়ে। আইকনিক রিভার্স ছবি, অ্যাক্রিলিক শিটের উপরে গোয়াশের কাজ, কাগজে মার্কার কলমের কাজ, ছোট পোস্টকার্ড সাইজ়ের ড্রয়িং (বিশেষ করে চিন ভ্রমণের স্বাক্ষরবাহী সব কাজ) বরোদায় থাকাকালীন নানা ধরনের খেলনার উদ্ভাবন ছাড়াও শিশুদের জন্য হাতে তৈরি বইয়ের ছোট মডেল এবং গঠন, ম্যুরাল আগের স্কেচ, ম্যাকেট বা ভাস্কর্যের আগের ছোট মডেল, ড্রয়িং ইত্যাদি কাজ ছিল প্রদর্শনীতে। বৈচিত্রে এ সব কাজ শিল্পরসিকদের জন্য অত্যন্ত উপভোগ্য।
সাত দশকে পঞ্চাশটি একক প্রদর্শনী করেছেন সুব্রহ্মণ্যন। দেশি-বিদেশি নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু সারা জীবন শিক্ষকতার সঙ্গে ছিল এক গভীর সম্পর্ক। ১৯৬২ থেকে ’৭৯ সাল পর্যন্ত বরোদার এম এস ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত এক ফাইন আর্টসের প্রদর্শনীর জন্য সুব্রহ্মণ্যন অদ্ভুত ধরনের খেলনার উদ্ভাবন করেছিলেন। কাঠের টুকরো, ঘাস, পুঁতি নানাবিধ সামগ্ৰী দিয়ে এই খেলনা তৈরি করেছিলেন। সে সময়ে খুবই জনপ্রিয় হয় তা। ওই ধরনের কিছু খেলনাও প্রদর্শনীতে দেখার সুযোগ পেলেন দর্শক।
১৯৬৫ সালে শিল্পী দেখেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিটি। দেশভাগের পরে দুই ভাইবোনের অন্তরঙ্গ কাহিনি। ওই ছবিতে এক শিশুকন্যার দেখা হয় এক বহুরূপীর সঙ্গে। হিংস্র, বীভৎস এক কালীমূর্তি। পরে সেই কালীবেশী বহুরূপী যখন তার জিভ খুলে, জামাকাপড় খুলে দেখাল, দেখা গেল সে এক সাধারণ খেতে না পাওয়া পুরুষ। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কে জি সুব্রহ্মণ্যন কলাভবনে থাকাকালীন রাম, রাবণ, কালী এবং শিবের মূর্তি এঁকেছিলেন। কিন্তু এগুলি একেবারেই ধর্মীয় ছবি নয়। সাধারণ জীবনের সঙ্গে একটু অন্য জীবনের ছোঁয়া মিশিয়ে দিয়েছেন। কল্পনা এবং বাস্তবতাকে একই ক্যানভাসে ধরেছেন। নিপীড়িত মানুষের কাছে দুঃখ-দুর্দশাই একমাত্র রাস্তা বলে তিনি দেখাতে চাননি নিজের ছবিতে। সব সময়েই অন্য উপায় খুঁজেছেন, ছাত্রদেরও দেখিয়েছেন। সব সময়েই একটা বিকল্প বা মুক্তির সন্ধানে থেকেছেন।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে টেরাকোটায় কিছু কাজ করেছিলেন শিল্পী। সেই সিরিজ়ের নাম তখন দিয়েছিলেন, ‘জেনারেলস অ্যান্ড ট্রফি’। তাঁর টেরাকোটার কাজ নিয়ে বিশদে গবেষণা করেছেন কিউরেটর ন্যান্সি। বাংলা টেরাকোটার মন্দিরের শিল্পকর্ম, হরপ্পার মাতৃমূর্তি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯২০ সালে যে ‘নিউ অবজেক্টিভিটি মুভমেন্ট’ হয়েছিল জার্মানিতে... এ সবেরই ছাপ পড়েছে সুব্রহ্মণ্যনের টেরাকোটার কাজে। ধরা পড়েছে সামরিক অধিকর্তাদের বিকৃত, বীভৎস, পীড়িত সব চেহারা... মাটির উৎকীর্ণ (রিলিফ) বিভিন্ন মূর্তিতে। ১৯৮৫ সালে যখন শিল্পী চিনে যান, তখন সে দেশের মানুষদের খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। অল্প দাড়িওয়ালা গ্রামীণ বৃদ্ধ, ছোট ছোট শহরে ঘোড়া ও গাধার পিঠে জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া, মেয়েরা পিঠে করে লাঠির বোঝা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, লাই নদীর উপরে ভেসে যাচ্ছে নৌকা, নদীবক্ষ থেকে দেখা বিভিন্ন সব পাহাড়ের সারি, গ্রামীণ বাজার ইত্যাদি। এই সবের ছোট ছোট পোস্টকার্ড মাপের ড্রয়িং দেখা গেল প্রদর্শনীতে।
২০১২ সালে তিনি ‘ওয়ার অফ দ্য রেলিক্স’ নামে অনমনীয় এক ম্যুরাল তিনি তৈরি করেছিলেন। এটি ন’ফুট উচ্চতার এবং ছত্রিশ ফুট চওড়া একটি ক্যানভাস। আসল কাজটি খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখানো সম্ভব নয়। কাজেই এটির একটি ম্যাকেট বা ছোট মডেল দেখা গেল এই প্রদর্শনীতে। মূলত এটির গল্প হচ্ছে, মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে রাজনৈতিক লাভের জন্য ভুল পথে চালিত করে মাটিতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই ম্যুরালের স্টাইলের বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে আর শিব কুমার বলছেন যে, এটির স্টাইল হচ্ছে ব্রুট বারোক। অর্থাৎ এটিতে আছে এক রকম অস্থিরতা। দেওয়ালে সারি সারি স্তম্ভ, খানিকটা টেরাকোটা মন্দিরের মতো এবং তার মধ্যে মধ্যে নানা আখ্যান। এই কাহিনির অন্তরের নির্যাস হল ইন্দ্রিয়চেতনা, ভোগবাসনা ইত্যাদি।
‘এজলেস কমব্যাট ১’ এবং ‘২’, ‘রিপার’-এ শিল্পরসিকরা দেখতে পাবেন অ্যাক্রিলিক শিটের উপরে করা বেশ কয়েকটি রিভার্স পেন্টিং। এখানে বহু-বাহু দেবীমূর্তি, নরমুণ্ড, পশুর কামলালসা, নারীর যোনি, পুরুষের লিঙ্গ, নারীবক্ষ ইত্যাদি দেখা যায়। এ দেশের প্রাচীন মন্দির-স্থাপত্যে এই ধরনের কাজ বহুল পরিচিত। শিল্পীমনে সে সবের নিগূঢ় অনুপ্রেরণা হয়তো ছিল। শিল্পীর এ সব কাজে বাসনার পাশাপাশি ধরা হয়েছে গান, কবিতা, নাচ এবং নাটক। এক সময়ে ‘কাম’ ও ‘কর্ম’ শব্দে কোনও অর্থভেদ ছিল না। সেই চোখ দিয়েই নতুন প্রজন্মের শিল্পী, শিল্পরসিক, শিল্পসমালোচক সকলকে কে জি সুব্রহ্মণ্যনের মহামূল্যবান শিল্পকর্মের বিচার করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy