Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Rakhal Das Banerji

সভ্যতার হৃদয় খুঁড়ে

শুধু মহেঞ্জোদড়ো নয়, প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তি আকাশছোঁয়া। মাটি-পাথরের আড়াল সরিয়ে আস্ত সভ্যতার অলিন্দে পদক্ষেপের পাশাপাশি সাহিত্য-সহ নানা ক্ষেত্রেই অবাধ বিচরণ এই বাঙালির।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২৪ ০৫:৪৪
Share: Save:

ভাষা-শব্দের সাগর সেঁচে মণিমুক্তোর সন্ধান করেন তিনি। সেই তিনিই এক দিন বললেন, ‘দাদা... আবিষ্কার বিষয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করে কতকগুলো কথা মনে জাগছে ভাষাতত্ত্বকে আশ্রয় করে...’ — বক্তা ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। শ্রোতা তথা সেই আবিষ্কারক মানব সভ্যতার ইতিহাস নতুন করে লিখতে বাধ্য করেছিলেন। তিনি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। আবিষ্কারের নাম, মহেঞ্জোদড়ো। রাখালদাসের ‘প্রসাদে’ সুনীতি লিখলেন, ‘দ্রাবিড়ীয়ান অরিজিনস অ্যান্ড দ্য বিগিনিং অব ইন্ডিয়ান সিভিলাইজ়েশন’।

লিখলেন যোগ্য লোকই, কিন্তু বলা ভাল রাখালদাস লেখালেন! কেন, কী প্রেক্ষাপটে? প্রশ্নচিহ্নসামনে রাখলেই রাখালদাসের তীব্র আমিত্ব, জেদ, তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায় এবং মুখ্যত বৌদ্ধিক চরাচর জুড়ে থাকা তাঁর বিস্তৃতির কথাসামনে আসে।

ইতিহাসের পথে-প্রান্তে

ফেরা যাক মহেঞ্জোদড়ো আবিষ্কারের কাহিনিতে। সুদূর গ্রিস থেকে এসেছেন দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজ়ান্ডার। কিন্তু সামনে দুর্ধর্ষ প্রাচ্য প্রতিপক্ষ। সঙ্গীরাও রণক্লান্ত। ভাবিয়ে তুলল মহানায়ককে। গাঙ্গেয় দেশ অধিকারের জন্য যে তেজ দরকার, তা যেন গোধূলির সূর্যের মতোই ঢলে পড়ছে পশ্চিমে। ফিরে যাচ্ছেন গ্রিক বীর। যাওয়ার আগে নিশান রাখলেন, বিপাশার তীরে: গ্রিক দেবতাদের সম্মানে ১২টি বেদি।

বহু যুগ পরে অনেকের মতো ভারতীয় পুরতত্ত্ব সর্বেক্ষণের (এএসআই) পশ্চিম শাখার সুপারিন্টেন্ডেন্ট রাখালদাসও বেরিয়ে পড়লেন ওই বেদিগুলির স্মৃতিচিহ্নের খোঁজে। দক্ষিণ পঞ্জাব থেকে মজে যাওয়া সরস্বতীর খাত ধরে এগোতে থাকলেন। পৌঁছলেন সিন্ধু-পারে লারকানা জেলায়। আশপাশের গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বললেন। শুরু হল অনুসন্ধান। প্রথম খননে বোঝা যায়নি, কী অপেক্ষা করছে। কালক্রমে, সম্ভবত ১৯২৩-এ রাখালদাসের হাতে এল মাটির পাত্রে রাখা কিছু মুদ্রা, সিল-সহ কিছু প্রত্নসামগ্রী।নানা পর্ব পেরিয়ে সামনে আসতে থাকল ভারত-সভ্যতার প্রাচীন সন্তানদের তিলে তিলে সাজানো মহেঞ্জোদড়োও।

কিন্তু আবিষ্কারের কৃতিত্ব কার? জটিলতা তৈরি হল। সরকারি লাল ফিতের ফাঁস কেটে সামনে আসছে না আবিষ্কারের কথা। কারণ সর্বেক্ষণের তৎকালীন সর্বাধ্যক্ষ জন মার্শাল চাইছেন বিষয়টি আরও একটু খুঁটিয়ে বুঝতে। কিন্তু লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার প্রতিবেদন জানান দিল, ওই প্রত্নক্ষেত্র খননের প্রথম কৃতিত্ব রাখালদাসের। কিংবদন্তি প্রত্নতাত্ত্বিক মার্শাল এতে চটলেন। তিনি পরে ১৯২৪-এর সেপ্টেম্বর, অক্টোবর জুড়ে নতুন সভ্যতা আবিষ্কারের কথা জানাতে থাকলেন পত্রপত্রিকায়। হইচই বাধল বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু তাঁর কৃতিত্ব কি ঢাকা পড়ে যাচ্ছে, হয়তো ভাবছেন রাখালদাস, ভুল ভাবছেন। এ দিকে, কলকাতার স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার পত্রিকা মার্শালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলল। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো। কিন্তু সরকারি বাধ্যবাধকতায় রাখালদাস নিজে কিছু লিখতে পারছেন না। এ দিকে, ধৈর্যও তাঁর ধাতে ছিল না।

তখন সিমলা স্ট্রিটে, ভাড়াবাড়িতে থাকেন রাখালদাস। আড্ডায় অনুজপ্রতিমকে বললেন, ‘দেখ্ সুনীতি, এরা তো আমাকে মহেন্-জো-দড়ো সম্বন্ধে কিছু প্রকাশ করতে দেবে না। এ সম্বন্ধে তোর লিখতে বাধা নেই।’ যাবতীয় ‘মাল-মশলা’ রাখালদাসই দিলেন। সুনীতিও লিখলেন পূর্বে উল্লিখিত ওই প্রবন্ধ, ‘মডার্ন রিভিউ’-তে, ১৯২৪-এর ডিসেম্বরে। ঘটনা হল, ইতিমধ্যে সর্বেক্ষণের পূর্ব শাখার সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে কলকাতায় বদলি ‘করা হয়েছে’ রাখালদাসকে। তবে এ-ও সত্যি, প্রকৃত পণ্ডিতের ন্যায় মার্শাল কৃতিত্ব নিতে চাননি রাখালদাসের। তার প্রমাণ, মার্শালের পর্বতপ্রতিম কাজ ‘মহেঞ্জোদড়ো অ্যান্ড দি ইন্দাস সিভিলাইজেশন’-এর প্রথম খণ্ডের ভূমিকা অংশ।

শুধু মহেঞ্জোদড়ো নয়, প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাসের কীর্তি আকাশছোঁয়া। ভুমারায় গিয়েছেন প্রযুক্তিবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক আলেকজ়ান্ডার কানিংহাম। নজরে পড়েনি স্থাপত্যটি। রাখালদাসও গেলেন। জঙ্গলের আড়াল সরিয়ে গুপ্তযুগের শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলির অন্যতম রাখালদাসের হাতেই কথা বলল। আলো দেখল ভুমারার শৈবমন্দির। রেওয়া অঞ্চলে একের পর এক মন্দির-কথা, বাদামির গুহা-ভাস্কর্যের কাহিনি... আরও কত কী রাখালদাসের ছোঁয়া পেয়েছে। বাংলার ইতিহাসেও তিনি আস্ত এক অধ্যায় রচনা করেছেন। বাংলাদেশের রাজশাহীর পাহাড়পুর। খনন চালাতে পারেনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। গেলেন সেই রাখালদাসই। সামনে এল পালযুগের অনুপম কীর্তি সোমপুর মহাবিহার।

মাটি-পাথরের আড়াল সরিয়ে আস্ত সভ্যতার অলিন্দে পদক্ষেপই শুধু নয়, পুরাতত্ত্বের নানা ক্ষেত্রে অবাধ বিচরণ এই বাঙালির। স্থান, কলকাতা জাদুঘর। দেওয়ালে টাঙানো প্রাচীন লেখের প্রতিলিপি। গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে দেখে রাখালদাস পরিচিতকে বললেন, ‘অক্ষরগুলি অপরিচিত— প্রাচীন ব্রাহ্মী বা খরোষ্ঠী নয়।’ পশ্চিম এশিয়ায় প্রাচীন যুগে ব্যবহৃত অক্ষরগুলির নমুনা পেলে হয়তো পড়তে পারতেন, এ-ও জানালেন। রাখালদাসের অনুমান ঠিকই ছিল। লেখটি প্রাচীন আরামীয়তে লেখা অশোকের লিপি।

আসলে অভিলেখ পাঠ, সম্পাদনা ও নিবন্ধ রচনায় বারবার নিজের ছাপ রেখেছেন তিনি। তালিকায় রয়েছে— সেন আমলের মাধাইনগর, ব্যারাকপুর, নৈহাটী তাম্রশাসন প্রভৃতি, ওড়িশার নানা লেখ সম্পাদনা, রাজস্থানের রাজ্ঞী চিত্রলেখার লিপি নিয়ে আলোচনা-সহ আরও কত কী। পাশাপাশি ‘নোটস অন ইন্দো-সিথিয়ান কয়েনেজ’, অঙ্কচিহ্নিত রৌপ্য মুদ্রা, চন্দেল্ল মদনবর্মণের রৌপ্যমুদ্রা, গ্বালিয়ারে তাম্রমুদ্রার গুপ্ত সঞ্চয়, উদয়দেবের স্বর্ণমুদ্রা প্রভৃতির পর্যবেক্ষণ, আলোচনায় মুদ্রা বিশেষজ্ঞ রাখালদাসকেও পাওয়া যায়। মুদ্রা নিয়ে রাখালদাসের আগ্রহের পরিচায়ক ‘প্রাচীন মুদ্রা’ শীর্ষক ১২ পরিচ্ছেদের বইটিও।

অবশ্যই রাখালদাসের সব মতামত পরবর্তী সময়ে গৃহীত হয়নি, অনেক কিছুই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু সেটা যে কোনও কৃতী মানুষের ক্ষেত্রেই ঘটে। তা বলে তাঁর কৃতিত্ব এক শতাংশও কমে না বরং বাড়ে, বিশেষত রাখালদাসের জ্ঞান-কীর্তির কথা ভাবলে। তাঁর কাছের মানুষেরা সেটাকে হয়তো ছুঁয়েও দেখেছেন। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী ‘আওরঙ্গজেব’ অভিনয় করবেন। রাখালদাস শেখালেন সপ্তদশ শতকের মোগল ও রাজপুতদের পোশাক, আদবকায়দা। আর প্রিয় শিশিরের মাথায় বেঁধে দিলেন পাগড়ি।

হে মহাজীবন

ইতিহাসের চোখে চোখ রেখে রাখালদাসও যে কীর্তিমান হবেন, তা বোঝা গিয়েছিল অল্প বয়সেই। কিন্তু কীর্তির পাশাপাশি মানুষ রাখালদাসের মন-মর্জিটিও ছিল উচ্চাঙ্গের। টের পেয়েছেন ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার। এক দিন রাখালদাসের বাড়িতে গিয়েছেন। দেখলেন কোঁচানো ধুতি, ফিনফিনে পাঞ্জাবি, গলায় কোঁচানো চাদর পরিহিত রাখালদাস খুব তেজি ঘোড়া জুতে গাড়ি হাঁকাতে চলেছেন। বললেন, ‘একটা নতুন ঘোড়া কিনেছি। তাকে সায়েস্তা করতে হবে— তাই গাড়ি নিয়ে বেরুচ্ছি।’

আরও নানা উদাহরণ আছে— যে আমলে টাকায় এক মণ চাল পাওয়া যেত, সেই সময়ে স্টেশনের কুলিকে বকশিশ দেন ১০ টাকা! খাওয়ার পরে হাতে জল ঢালতে বা প্যান্টের বোতাম লাগাতে বা জুতোর ফিতে বাঁধতেও লোক হাজির থাকত। পরিণত বয়সে রাখালদাসের আতিথেয়তাও চড়া সুরে বাঁধা। সঙ্গে থাকেন কোঙ্কনিভাষী গোয়ানিজ় খ্রিস্টান রাঁধুনি। ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও সেই রাঁধুনির হাতের মাংস না হলে রাখালদাসের চলে না। শুধু খাওয়া নয়, খাওয়ানোতেও জুড়ি মেলা ভার। এক বার পটনায় যাচ্ছেন সঙ্গীদের নিয়ে। সেখানেই আছেন ব্যারিস্টার তথা ইতিহাসবিদ কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল। রাখালদাস ট্রেনে উঠলেন দু’টি ডেকচি সঙ্গে নিয়ে। বললেন, ‘ও জয়সওয়ালের জন্য কিছু মিঠাই’। কিন্তু ট্রেন-পথেই জানা গেল, তাতে আড়াই সের মাংসের কোপ্তা ছিল!

আসলে বিপুল বৈভবের মধ্যে বড় হয়েছেন রাখালদাস। ছোটবেলায় চাহিদা পূরণ না হলে টাকা ছিঁড়তেন! এমন মেজাজের তারটি বাঁধা হয়েছিল বাড়িতেই। জন্ম ১২ এপ্রিল, ১৮৮৫-তে, বহরমপুরে। বাবা মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বহরমপুরের কোর্টের নাম করা আইনজীবী। মা কালীমতি দেবী। রাখালদাসের পূর্বপুরুষেরা ঢাকা বিক্রমপুরে দেওয়ান মুর্শিদকুলি খানের অধীনে পদস্থ কর্মচারী ছিলেন। মতিলাল-কালীমতির সন্তানেরা পরপর মারা যায়। রাখালদাস গর্ভে এলে, বাড়ির মেয়েরা রাখালেশ্বর মন্দিরে প্রার্থনা করলেন। তা থেকেই নাম রাখালদাস। বহরমপুরের এই ছেলের স্ত্রী উত্তরপাড়ার জমিদার নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে কাঞ্চনমালা। তাঁদের দুই সন্তান, অসীমচন্দ্র, যিনি ১২ বছরে মারা যান আর অদ্রীশচন্দ্র, তিনি বাবার ছায়ায় ঢাকা না পড়ে নিজেও কৃতী হয়েছিলেন।

যদিও বৈভব রাখালদাসের মেধার ঐশ্বর্যকে অতিক্রম করেনি। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে এন্ট্রাস, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ-তে প্রথম বিভাগ প্রাপ্তি। আচমকা ধাক্কা বাবা-মায়ের মৃত্যুতে। পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের জেরে রাখালদাসের পড়াশোনাতেও কিছু দিন বিরতি। ১৯০৭-এ ইতিহাসে স্নাতক হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের প্রতি গভীর টান। এই পর্বেই রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ও মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সঙ্গ রাখালদাসের। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের বিরতি পেলেই ছোটেন ভারতীয় জাদুঘরে। সেখানে আছেন আর এক গুরু পুরাতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত থিয়োডর ব্লখ। ১৯১০-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করলেন রাখালদাস।

রাখালদাসের ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেতে শুরু করল বৌদ্ধিক মহল, ‘দ্য সিথিয়ান পিরিয়ড ইন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ প্রবন্ধ দিয়ে সেই জয়যাত্রা শুরু। জীবনভর প্রায় ১৩০টি প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন। রয়েছে ‘হিস্ট্রি অব ওড়িশা’, ‘দি এজ অব ইম্পিরিয়াল গুপ্তাস’, ‘ইস্টার্ন ইন্ডিয়ান স্কুল অব মেডিইভাল স্কাল্পচার’, ‘পালস অব বেঙ্গল’, ‘হৈহয়জ অব ত্রিপুরী অ্যান্ড দেয়ার মনুমেন্টস’, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’-সহ নানা জরুরি বই। প্রতিভার ছাপ মৌলিক সাহিত্যেও— ‘পাষাণের কথা’, ‘শশাঙ্ক’, ‘ধর্মপাল’, করুণা প্রভৃতি।

কিন্তু বৌদ্ধিক স্তরে রাখালদাসের যত বিস্তার ঘটেছে, ততটাই বেড়েছে চক্রান্তের মায়াজাল। তাঁর প্রবল আমিত্বও এ জন্য দায়ী। কখনও জিতছেন, কখনও বা হেরে যাচ্ছেন। কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়—

১৯১০-’১১ সালে কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের পুরাতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্ব যায় এএসআই-এর হাতে। সর্বেক্ষণের সর্বাধ্যক্ষ মার্শাল দেশে নেই। কিন্তু তাঁর ইচ্ছে, হস্তান্তরটা রাখালদাসের মাধ্যমেই ঘটুক। রাখালাদাসকে সহকারী সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসাবে নিযুক্ত করার ইচ্ছের কথাও বললেন তিনি। এই পর্বে রাখালদাসের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ কিংবদন্তি পণ্ডিত দায়ারাম সাহানি। সফল হননি। রাখালদাস ৩০০ টাকা মাস মাইনের চাকরি পেলেন ১ নভেম্বর ১৯১১-য়। সুবিধা হল, জাদুঘরের মুদ্রা ঘরের দায়িত্বেও থাকলেন তিনি। এর আগের চাকরি জাদুঘরের পুরাতত্ত্ব বিভাগের সহকারী হিসেবে।

তবে সর্বেক্ষণের অন্দরে চক্রান্তের জাল যে ছড়ানো, তা বোঝা গেল ১৯১২-তেই। সর্বেক্ষণের পূর্ব শাখার সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডিবি স্পুনার। খটাখটি বাধল। ইংল্যান্ডের রাজা জাদুঘর-দর্শনের অনুষ্ঠানে দেওয়া হয় দরবার পদক। অজ্ঞাত কারণে বাদ রাখালদাস। কথিত, জাদুঘরের আধিকারিক নেলসন অ্যানাডেলের কারণেই এটা হয়েছিল। রাখালদাসও দমার পাত্র নন। সরাসরি চিঠি মার্শালকে। শেষমেশ বাংলা সরকারের তৎকালীন সচিব ডব্লিউ স্টিভেনসনের হস্তক্ষেপে পদক মিলল। শুধু কি সর্বেক্ষণ, সর্বত্রই রাখালদাসের জন্য কাঁটার পথ। আবেদন করলেন সরকারি এপিগ্রাফিস্ট হতে। এ নিয়ে দক্ষতাও প্রশ্নাতীত, যার সাক্ষ্য আছে ‘এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিয়া’-তে। কিন্তু চাকরিটা হয়নি তাঁর। অথচ ইনিই বাংলা লিপির বিবর্তন নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়ে পাবেন জুবিলি পুরস্কার।

আবার এই আশুতোষেরই সমর্থন মিলল না ১৯১৬-য়, অন্তত তেমনটাই ১৯৮০ সালের এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের কারমাইকেল অধ্যাপকের জন্য আবেদন জানালেন রাখালদাস। সুপারিশ স্বয়ংহরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভান্ডারকরকে এই পদে নিয়োগ করল। নীহাররঞ্জনের দাবি, উপাচার্য আশুতোষের সমর্থন মেলেনি কারণ, ভারতীয়দের সঙ্গে ব্রিটিশদের বঞ্চনামূলক আচরণের অত্যন্ত প্রতিবাদী ছিলেন রাখালদাস। প্রসঙ্গত, এর আগে মাদ্রাজ ও ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে চেয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে রাখালদাসকে।

রাখালদাস আঘাত পেলেন। আর তা বদলে গেল শত্রুতায়। দেবদত্ত যে তাঁর তুল্য প্রতিভাধর নন, তা প্রমাণ করে ছেড়েছেন বৌদ্ধিক মহলে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভান্ডারকর সম্পর্কে বাছাবাছা বিদ্রুপ করলেন ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায়। এএসআই-তে একটি মজার গল্প প্রচলিত যে, কাশিম নামে এক কর্মচারী প্রত্ন-সামগ্রীতে মার্কা করার সময়ে ভুল করে ইংরেজিতে উল্টো করে জাদুঘরের ছাপ দিয়েছিলেন। সেটিকে দেবদত্ত মনে করেছিলেন ব্রাহ্মীলিপির প্রাচীন রূপ! এই ঘটনা নিয়ে বেনামে রাখালদাস ‘কাশিমের মার্কা’ নামে একটি প্রবন্ধ ছেপে হাসির খোরাক করে দিলেন দেবদত্তকে। যদিও যোগ্যকে সম্মান দিতেও জানতেন রাখালদাস। হরপ্রসাদ ও ব্লখকে গুরুর স্থানেই সম্মান দিয়েছেন, যার সাক্ষ্য ‘দি অরিজিন অব দ্য বেঙ্গলি স্ক্রিপ্ট’-এর উৎসর্গপত্র। আরও দু’টি ঘটনাতেও বোঝা যায় বিষয়টা। রাখালদাসের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’-এর বেশ কিছু ভুল বার করে প্রবন্ধ লিখেছে রমেশচন্দ্র মজুমদার। রাখালদাস সাদরে তা গ্রহণ করলেন এবং তাঁর ‘প্রাচীন মুদ্রা’র পাণ্ডুলিপি দিলেন, ভুল ধরার জন্য!

রাখালদাসের এমন মানসিকতার প্রমাণ পেয়েছিলেন রাজস্থানের পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর হীরাচাঁদ ওঝা। এক বার তিনি কলকাতায় জাদুঘরে এসে কিছু শিলালেখ দেখার কথা ভাবছেন। কিন্তু সেই সব তখন প্রদর্শনের জন্য ছিল না। আচমকা দেখলেন এক বাঙালি সাহেব ঘুরছেন গ্যালারিতে। তাঁকেই এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। প্রশ্ন শুনেই বাঙালি সাহেব বুঝলেন, ইনি সামান্য কেউ নন। ওঝা মহাশয় পরিচয় দিতেই বাঙালি সাহেব রাখালদাস প্রণাম করে বললেন, ‘আপনি আমার গুরু, পদধুলি দিন।’

শেষ নাহি যে

এত কিছুর পরেও রাখালদাসের কর্মক্ষেত্র, সর্বেক্ষণের অন্দরেই তাঁর বিরুদ্ধে তৈরি হল সর্বাত্মক ষড়যন্ত্র। অভিযোগ, জব্বলপুরের চৌষট যোগিনীর মন্দির থেকে তারামূর্তি সরিয়েছেন না কি রাখালদাস! আদালত যদিও অভিযোগটাই খারিজ করল। কিন্তু ইংরেজ প্রভুদের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি (মূলত মার্শালের অনুপস্থিতিতে জেএফ ব্ল্যাকিস্টন সাহেবের কলকাঠিতে) তৈরি। চুরির অভিযোগ ধোপে টিকল না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নানা প্রশাসনিক ত্রুটি সামনে এনে অগস্ট ১৯২৭-এ ভারত সরকারের চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিল রাখালদাসকে। ভরসা পেনশন। সঙ্গী অর্থকষ্টও। যদিও তা হওয়ার কথা ছিল না, কারণ বিপুল পারিবারিক সম্পত্তি ছিল রাখালদাসের। কিন্তু সে সবই প্রায় উড়িয়ে দিয়েছেন রাখালদাস। এগিয়ে এলেন ময়ূরভঞ্জের মহারাজা। তাঁরই অর্থানুকূল্যে রাখালদাস লিখলেন ওড়িশার ইতিহাস। ১৯২৮-এ পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের হস্তক্ষেপে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের প্রধান এবং মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন ।

কিন্তু শরীর দিচ্ছিল না। জটিল ডায়াবিটিস থাবা বসিয়েছে শরীরে। ছুটি নিয়ে কলকাতায় এলেন। প্রায়ই বলেন, ‘আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে ৪৭ বছর বয়সে পড়েই আমি মহেন্-জো-দড়োর মুদ্রার লিপিপড়তে পারব!’ নিয়তি সেই সময় দেয়নি সভ্যতাকে নতুন করেদেখতে চাওয়া রাখালদাসকে। কলকাতায় ৪৫ বছর বয়সে, ২৩ মে ১৯৩০-এ প্রয়াত হলেন। সাহিত্যিক রাখালদাসের ‘তথ্য রস’ নিয়ে সুনীতিকুমার যে মন্তব্য করেছিলেন, তা ব্যক্তি রাখালদাস সম্পর্কেও খাটে— “...যতদিন বিদগ্ধ জনসমাজে... প্রতিভার আদর থাকবে ততদিন তা লুপ্ত হওয়ার নয়।”

তথ্য ও ছবি ঋণ: ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’: অশোক ভট্টাচার্য, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ‘রাখালদাস ব্যানার্জি— টাইম, লাইফ অ্যান্ড অ্যাচিভমেন্টস অব ফরগটেন আর্কিয়োলজিস্ট’: ফণীকান্ত মিশ্র, ‘শতবর্ষের আলোয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়: সম্পাদনা কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত, ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিস্মৃত অধ্যায়’: রজত পাল এবং ‘দ্য লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্কস অব রাখালদাস ব্যানার্জি’।

অন্য বিষয়গুলি:

Rakhaldas Banerjee Archaeology Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy