Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বিস্মৃত এক সরস্বতী

নিজের সময়ে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত জনপ্রিয় সাহিত্যিক। কিন্তু এখন আর কেউ সে ভাবে মনেই করতে পারেন না প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর নাম। তাঁকে নিয়ে লিখছেন আবাহন দত্তনিজের সময়ে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত জনপ্রিয় সাহিত্যিক। কিন্তু এখন আর কেউ সে ভাবে মনেই করতে পারেন না প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর নাম। তাঁকে নিয়ে লিখছেন আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৯ ০০:৫০
Share: Save:

গলব্লাডারের অসুখে তিন মাস ভোগার পরে ১৯৭২ সালের ১৪ মে প্রয়াত হন সাহিত্যিক প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। পরের দিন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল— “সে যুগের জনপ্রিয় সাহিত্যিক শ্রীমতী প্রভাবতী দেবী সরস্বতী আজ দুপুর আড়াইটের সময় তাঁর পাতিপুকুরের বাসভবনে পরলোকগমন করেন।” কতটা জনপ্রিয়? প্রভাবতীর বইয়ে তাঁর সই-সহ পাঠকদের প্রতি একটি নিবেদন প্রকাশিত হত— “ইদানীংকালে বাজারে আমার নাম নকল করিয়া বহু উপন্যাস ও অন্যান্য রচনা প্রকাশিত হইতেছে বলিয়া সহৃদয় পাঠক-পাঠিকাগণ আমাকে জানাইতেছেন। পাঠক-পাঠিকা, প্রকাশক ও পৃষ্ঠপোষকগণের অবগতির জন্য তাঁহাদের আমি জানাইতেছি, আমার লিখিত উপন্যাস ও অন্যান্য রচনাদিতে আমার নাম সহি করা থাকিবে। যাহাতে তাঁহারা সতর্ক হইতে পারিবেন।”

জাম্প কাট করে চলে আসি ২০১৯। কলেজ স্ট্রিট। বড় প্রকাশকদের দোকানে ঘোরা হয়ে গিয়েছে। বই তো দূর, প্রভাবতীর নামই কেউ বুঝতে পারেন না ভাল করে। ছোট প্রকাশকদের দশাও তথৈবচ। ভরসার পুরনো বইয়ের দোকানেও বাঁশবনে ডোমকানা। অবশেষে অন্ধকারে আলো দেখাল প্রেসিডেন্সির সামনের সারির একটা ছোট্ট দোকান। দোকানি জানালেন, তাঁর পাশের দোকানে পাওয়া যাবে প্রভাবতীর বই।

‘কী চাইছেন? গল্প না উপন্যাস?’

‘হলেই হল। প্রভাবতীর লেখা পড়তে চাই।’

সামান্য মূল্যে হস্তগত করা গেল ‘স্থান কাল পাত্র’। কিছুটা সাহিত্য সমালোচনা, বাকিটা গল্প সংকলন। প্রথম পাতা দেখে বুঝলাম, বিয়ের উপহারের বই।

‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক বেরোত ‘দানের মর্য্যাদা’ (বাঁ-দিকে) এবং বিয়ের উপহার হিসেবে প্রভাবতীর বইয়ের বিজ্ঞাপন।

প্রবীণদের কাছে শুনেছি, বিবাহবাসর, অন্নপ্রাশন, জন্মদিনের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে যখন বই উপহার দেওয়ার চল ছিল, তখন সেই তালিকায় একেবারে উপর দিকে থাকত প্রভাবতীর বই। পরে গ্রন্থাগারে পুরনো বই ঘাঁটতে গিয়েও দেখেছি, প্রায় সব বইয়ের প্রথম পাতাতেই উপহারের নামাঙ্কন। আরও জেনেছি, ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় যখন ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন তিনি, তখন চাহিদা এতই ছিল যে, একটি উপন্যাস শেষ হলে পরবর্তী উপন্যাসের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে দিতে হত। সে কালের বিজ্ঞাপন ঘাঁটলেও দেখা যায়, ‘মধুযামিনীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উপহার’-এ তিন টাকা দামের উপন্যাসের তালিকায় বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসুর ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দম্পতি’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘ছিনিমিনি’, নারায়ণ ভট্টাচার্যের ‘অভিমান’, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রূপের ফাঁদ’, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘মধুযামিনী’, অনুরূপা দেবীর ‘স্ত্রী’, মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জানি তুমি আসবে’, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘শুক্লবসনা সুন্দরী’, ‘তোমায় আমি ভালবাসি’ এবং প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর ‘আমি যারে চাই’, ‘সোনার প্রতিমা’, ‘পথের শেষে’ ও ‘দানের মর্য্যাদা’।

তিনশোরও বেশি বই লিখেছিলেন প্রভাবতী। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, গান, গোয়েন্দা কাহিনি— সমস্ত সাহিত্যিক সংরূপ নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।

তবু নির্মম সত্য, আজ তিনি একেবারে বিস্মৃত!

রমণীর কথা

১৯০৫। বাল্যবিবাহ তখন সমাজের প্রথা। সে বছর ৫ মার্চ গোবরডাঙা পুরসভার খাঁটুরা গ্রামে জন্ম প্রভাবতীর। কুলপ্রথা রাখতে মাত্র ন’বছর বয়সে গৈপুর গ্রামের বিভূতিভূষণ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল ছোট্ট প্রভাবতীর। কিন্তু সেই কষ্ট নিয়ে বিরূপ মন্তব্য আসে শ্বশুরবাড়িতে। ন’বছরের মেয়ে আর দ্বিতীয় বার ভাবেনি। সোজা মাঠঘাট ভেঙে বাপের বাড়িতে ফেরা। চিরতরে সম্পর্ক বিচ্ছেদ। বাবাও আর মেয়েকে ফেরানোর চেষ্টা করেননি।

প্রভাবতীর লেখা বিভিন্ন উপন্যাসের প্রচ্ছদ

ইতিমধ্যে প্রভাবতীর বাবা গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আইন ব্যবসার কাজে দিনাজপুর চলে যান। সঙ্গে স্ত্রী-কন্যাও। সেখানে পড়াশোনার জন্য স্কুলে ভর্তি হন প্রভাবতী। কিন্তু শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছেও পরীক্ষা দেওয়া হল না। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় প্রবল আগ্রহ। কিন্তু একে মেয়ের ইচ্ছে, তাও আবার লেখাপড়ার, সে কালে কে-ই বা ভাবত? পাঁচ বোন এক ভাইয়ের সংসারে সত্যসাধনের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি ছিল। তার কলেজে ভর্তির জন্য ছয় সন্তানকে নিয়ে বহরমপুরে চলে এলেন সুশীলাবালা দেবী। প্রভাবতীরও স্কুলের গণ্ডি পেরোনো হল না।

কিন্তু কল্পনাপ্রবণ আর একাগ্র মনকে আটকে রাখার সাধ্য কার? অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবীর লেখা পড়তে শুরু করলেন প্রভাবতী। তার পরে একদিন সত্যসাধনের খাতা ধরে টানাটানি। সকলের অলক্ষ্যে শুরু সাহিত্যচর্চা। কিছু দিন পরে জানাজানিও হয়ে গেল। তবে বাবা-মায়ের বকুনির বদলে উৎসাহই জোটে। মাত্র ১১ বছর বয়সে ‘তত্ত্বমঞ্জুরী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। ‘গুরুবন্দনা’। শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্দেশে লেখা এক পদ্য। এর পরে গল্প ‘টমি’। প্রকাশিত ‘অর্চনা’ পত্রিকায়।

প্রভাবতীর লেখা আরও একটি উপন্যাসের প্রচ্ছদ

বহরমপুর থেকে অসমের ছোট শহর লামডিং। লেখালেখিতে ছেদ পড়ে না। রচিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘প্রতীক্ষায়’। এর পরেই দুঃসংবাদ— বহরমপুরে নিউমোনিয়ায় গোপালচন্দ্রের মৃত্যু। প্রভাবতীর জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কলম তবুও চলতে থাকে। ১৯২৪ সালে (১৩৩০ বঙ্গাব্দ) ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস ‘বিজিতা’।

পরবর্তী কালে ‘পল্লীসখা’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে প্রভাবতী লিখছেন— “মেয়েদের শাসন আমাদের দেশে বড়ই কড়া। তাহাদের অতি শিশুকাল হইতেই কঠোর শাসনের তলে থাকিতে হয়। যে সময়টা বিকাশের, সে সময়টা তাহাকে বন্ধ করিয়া রাখা হয়। ...অন্য দেশে যে সময়টা বালিকাকাল বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে, আমাদের দেশের মেয়েরা সেই সময়ে গৃহের বধূ, অনেক সময়ে সন্তানের মা।” নিজের ছোটবেলার জন্য কি বারবার আক্ষেপ হত প্রভাবতীর? লেখালেখির মধ্যে কিছু সূত্র ছড়িয়ে থাকলেও, এ সব প্রশ্নের উত্তর কালের গর্ভেই তলিয়ে গিয়েছে। ওই যে, মেয়েদের আবার লেখাপড়া!

বিজিতা

পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্য ছিন্ন করেননি প্রভাবতী। ১৯২৯ সালে ব্রাহ্ম গার্লস ট্রেনিং কলেজ থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট পেয়ে সেই স্কুলেই পড়াতে শুরু করেন। সেখানেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্রী রমা দেবীর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। আর রমা দেবীর উৎসাহে বাগবাজারে সাবিত্রী বিদ্যালয় স্থাপন করেন প্রভাবতী। পরে অবশ্য চাকরি নেন কর্পোরেশন স্কুলে। চাকরি সূত্রে কলকাতায় চলে এলেও শিকড়ের সঙ্গে যোগ বিচ্ছিন্ন করেননি কখনও। নিজের গ্রাম খাঁটুরায় ফিরেছেন, বিলুপ্তির পথ থেকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয়কে। সে সময়ে সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতির শাখা কেন্দ্রে সমাজসেবার কাজেও যুক্ত হন। পরে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়ে বোন হাসিরাশি দেবীর সঙ্গে মিলে কৃষকসভার হয়ে ত্রাণের কাজেও নেমেছিলেন।

নানা কাজের সূত্রে নানা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। রমা দেবীর সূত্রে যাতায়াত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে। নিজের ‘দারিদ্রের ইতিহাস’ বইটি প্রভাবতীকে উৎসর্গ করেন তিনি। প্রভাবতীর কথাবার্তা হত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও। শোনা যায়, তাঁর ‘মাটির দেবতা’ উপন্যাসটি লেখার পিছনে নাকি রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং উৎসাহ ছিল। সাহিত্য রচনায় উৎসাহ দিতেন রবীন্দ্রনাথ। পরে বোন হাসিরাশি দেবীকেও তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রভাবতী। হাসিরাশিও ভাল লিখতেন, ছবিও আঁকতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘চিত্রলেখা’।

ও দিকে, প্রভাবতীর কলমও চলেছে সমান তালে। ধারাবাহিক ‘বিজিতা’ জনপ্রিয় হওয়ার পরে বই আকারে প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক উপন্যাস— ‘ব্রতচারিণী’, ‘দানের মর্য্যাদা’, ‘পথের শেষে’, ‘ঘরের লক্ষ্মী’, ‘আশীর্ব্বাদ’, ‘স্নেহের মূল্য’, ‘সহধর্মিণী’, ‘সোনার প্রতিমা’, ‘প্রিয়ার রূপ’। প্রকাশিত হয়েছে প্রচুর গল্প। ‘আশ্রয়’, ‘সমাজদ্রোহী’, ‘অপরাধিনী’ গল্পগুলি প্রকাশিত হয় ‘কল্লোল’ পত্রিকায়। ‘বাঁশরী’, ‘সারথী’, ‘উপাসনা’, ‘উদ্বোধন’, ‘সম্মিলনী’, ‘মোহম্মদী’র মতো পত্রপত্রিকায় তাঁর বহু গল্প প্রকাশিত হয়।

জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে প্রভাবতীর বই রঙ্গমঞ্চ আর চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়। ব্যবসায়িক সাফল্যও পায়। ১৯৩২ সালে নির্বাক যুগে ছবি হয় ‘সহধর্মিণী’ উপন্যাস। পাঁচ বছর বাদে সবাক যুগে ‘ঘূর্ণি হাওয়া’ উপন্যাস ‘রাঙা বৌ’ নামে ছবি হয়। সে বছরই বেরোয় ‘বাংলার মেয়ে’। ১৯৪৩-এ ‘জননী’। হিন্দি এবং মলয়ালমেও প্রভাবতীর লেখা চিত্রায়িত হয়। ‘বিজিতা’ উপন্যাস ‘ভাঙ্গাগড়া’ নামে বাংলায়, ‘ভাবী’ নামে হিন্দিতে এবং ‘কুলদেবম’ নামে মলয়ালমে চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তি পায়। বিশ্বরূপা থিয়েটারে সাফল্য পায় ‘পথের শেষে’ নাটক। এ ছাড়া, গান লেখার জগতেও খ্যাতি অর্জন করেন তিনি।

যত দিন যায়, স্বীকৃতি মিলতে থাকে। নবদ্বীপের বিদ্বজ্জন সভা প্রভাবতীকে ‘সরস্বতী’ উপাধিতে ভূষিত করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘লীলা পুরস্কার’ দেয়। খ্যাতির বিড়ম্বনাও দেখা দেয়। এক সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্রদের নামে বাজারে আরও লেখক হাজির হয়ে বিপদ বাধিয়েছিলেন। কে জানে, বিপদ বাধাতেই দ্বিতীয়দের আবির্ভাব কি না! প্রভাবতীর নাম সাহিত্য জগতে বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পরে বাংলা বাজারে আবির্ভূত হন আর এক প্রভাবতী দেবী। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে জামশেদপুর নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের পরিচালক ছিলেন ‘আসল’ প্রভাবতী। শ্যামাপ্রসাদই অনুরোধ করেন, এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে নামের সঙ্গে ‘সরস্বতী’ উপাধিটি জুড়ে নেওয়া ভাল। জীবনের শেষ লেখা পর্যন্ত এই নামেই লেখালেখি করেন প্রভাবতী।

বাংলার বউ

নিজের সময়ে চমকপ্রদ খ্যাতি আর মৃত্যুর পরে বিস্মৃতির অতলে... এমন কেন, বুঝতে গেলে প্রভাবতীর লেখাগুলোর দিকে তাকাতেই হয়।

মনে করা যাক ‘বাংলার বউ’ উপন্যাসের প্লট। রুদ্রপুর গ্রামের গরিব ঘরের ছেলে রঞ্জনের বিয়ে হয় অতুল বিত্তশালী চন্দ্রমোহনবাবুর একমাত্র রূপবতী কন্যা অনুলার সঙ্গে। প্রচলিত রীতি অনুসারে ‘বিধাতার নির্বন্ধে’ই বিয়ে। কিন্তু বাল্যবিবাহ। এবং নেহাত ভাগ্যচক্রে সেই বিয়ে হয়ে যায়। মনে পড়তে পারে প্রভাবতীর নিজের ন’বছর বয়সে সেই বিয়ের কথা। লেখক নিজে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কল্পনার জগতে তা আঁকেননি। বরং রঞ্জন-অনুলার বিয়ে কত মূল্যহীন, তা-ই দেখা গিয়েছে উপন্যাসে। পরে নাগরিক, শিক্ষিত অনুলা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, আর রঞ্জন নিতান্ত শ্রমজীবী। অনুলার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় সেই সময়ে।

‘প্রেম ও পূজা’ উপন্যাসেও আছে একই রকমের অনুষঙ্গ। বিপুল সম্পত্তির অধিকারী রায়বাহাদুর প্রিয়নাথ গোস্বামীর যাবতীয় সম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিল তাঁর দৌহিত্রী বেণু। তার বাল্যবিবাহ হয়। বেণুর বাবা দেবতোষ সান্যাল হল প্রিয়নাথের উইল করা ঘরজামাই। এক সময়ে দু’জনের ঝামেলা বাধে। প্রিয়নাথের মেয়ের মৃত্যুর পরে দেবতোষ তার শিশুকন্যাকে নিয়ে নিজের বাড়ি চলে আসে। বাবার মৃত্যুর পরে কাকা ভবতোষ সান্যাল আর ঠাকুমার সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠে বেণু। স্বয়ংসম্পূর্ণ এক চরিত্র হয় সে। এক দিকে গৃহস্থালির কাজে অসামান্য পটুত্ব, অন্য দিকে পড়াশোনাতেও যথেষ্ট ভাল।

প্রভাবতীর ‘দাম পাওয়া’ এবং ‘বাজারে দর চড়া’— লেখালিখির জনপ্রিয়তা নিয়ে সমালোচকদের মত, সমকাল কী চায় বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। পাঠক ও প্রকাশকদের ফরমায়েশ যথাসাধ্য পূরণ করারও চেষ্টা করতেন। কী রকম? দেশের আপামর জনতা যে ঐতিহ্য, প্রথা, সংস্কার, বিশ্বাস নিয়ে বাঁচত, তাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন প্রভাবতী। পেরেছিলেনও। তাঁর সাহিত্যকর্মে তা ধরা পড়ত নারী চরিত্রগুলির মধ্যে। এর ফলে যেমন রক্ষণশীলরা কোনও আপত্তি তোলেননি, তেমনই সাধারণ পাঠকেরও খুব পছন্দসই হয়ে উঠেছিল এই সব গল্প-উপন্যাস। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচকদের প্রধান অভিযোগ, জনপ্রিয়তার দিকে তাকাতে গিয়েই তাঁর সৃষ্টিতে বৈচিত্র আসেনি। একের পর এক গল্প-উপন্যাস লিখে গিয়েছেন, অথচ সে ভাবে কোনও মাত্রা যোগ হয়নি। ছোটবেলা থেকেই সমাজকে নানা ভাবে দেখেছেন প্রভাবতী। তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও পূর্ণ। কিন্তু লেখায় তা উঠে আসেনি। সমাজের বিশ্লেষণও সে ভাবে চোখে পড়ে না। মনোরঞ্জনের জন্য তাঁর প্লট একঘেয়ে, এমন দাবিও অনেকে করেছেন। এমনকি সামাজিক উপন্যাসগুলি যাতে কোনও ভাবে সনাতনী সমাজের চক্ষুশূল না হয়ে ওঠে, সে জন্য আবেগঘন শিরোনামও নাকি লক্ষ করা যায়।

কিন্তু হিসেব গুলিয়ে যায়। কেননা বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা গোয়েন্দা চরিত্রের স্রষ্টাও এই প্রভাবতীই। কৃষ্ণাকে কোন ছকে ফেলবেন সমালোচকরা? তাঁদের মত তো তবে— ভ্রান্ত না হলেও— একদেশদর্শী! কৃষ্ণা কেমন? সত্যান্বেষী, মেধাবী, বিচক্ষণ, স্বয়ং সম্পূর্ণ, আত্মপ্রত্যয়ী। ক্রমে ক্রমে সে বড় হয়ে ওঠে। প্রভাবতীর অন্যান্য গল্পের মেয়েরা সমাজের জাঁতাকলে পড়ে নিষ্পেষিত। কিন্তু কৃষ্ণা হল এক আদর্শ। তাকে দেখে সাহসী হওয়ার সাহস পাওয়া যায়। ভয়ের ধার ধারে না, উপযুক্ত ব্যায়ামের ফলে সুগঠিত চেহারা, মাতৃভাষা ছাড়া আরও পাঁচ-সাতটা ভাষায় অনর্গল কথা বলে যেতে পারে, বর্মার (মায়ানমার) জঙ্গলে শিকারের অভিজ্ঞতা আছে। ঘোড়ায় চড়তে পারে, মোটর চালাতে পারে। দেশি-বিদেশি আততায়ীর মোকাবিলা করতে তার কোনও সঙ্কোচ নেই। বাবা-মায়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে সে বয়ঃসন্ধিক্ষণে অনায়াসে ভয়ঙ্কর অন্ধকারের মুখোমুখি হয়।

অনেকেরই মত, চিরন্তন শিক্ষক প্রভাবতী ছাত্রীদের জন্য হাজির করেছিলেন কৃষ্ণাকে। তা যেন বালিকা বিদ্যালয়ের এক পাঠ। এমন নারীর আকাঙ্ক্ষাই তো করবে আধুনিক যুগের কিশোরীরা। মানুষ গড়ার কারিগর প্রভাবতী ছাত্রীদের সমাজের মান্য গণ্ডিতে বেঁধে দিতে চাননি। রোমাঞ্চের চেয়েও বেশি নাটকীয়তায় সাজিয়েছিলেন গোয়েন্দা কাহিনি।

মহীয়সী নারী

ইদানীং কাল প্রভাবতীকে নিয়ে কী ভাবে? ২০১৩ সালের ২১ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকার ইন্টারনেট সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় কয়েক জন বিশিষ্টের মন্তব্য। মহাশ্বেতা দেবী বলেন, “প্রভাবতী দেবী সরস্বতী পুরনো যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য লেখিকা ছিলেন। তবে আজ সেই ভাবে তেমন কোনও গল্পের নাম মনে পড়ে না যেটি মনে দাগ কেটেছিল।” শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর বলিষ্ঠ লেখনী সেই সময় খুব নাম করেছিল। ...সেই ছোটদের জন্য ‘কৃষ্ণা রোমাঞ্চ সিরিজ’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস’ ছোটদের মধ্যেও আলোড়ন তুলেছিল।” পবিত্র সরকারের মতে, “...আমার তাঁর কোনও উপন্যাস পড়ার স্মৃতি বেঁচে নেই, গল্পও মনে নেই, যদিও পূজাবার্ষিকীতে বেশ কিছু গল্প পড়েছি।”

তাঁকে নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁদেরও বিশ্লেষণ খানিকটা তেমনই। আবেগের প্রাধান্য, চিরাচরিত গার্হস্থ্য সুনীতির আদর্শ শিরোধার্য এবং আত্মদানে নারীর স্বাধীনতা— এ রকমই ছিল প্রভাবতীর সাহিত্য সৃষ্টির মূল বার্তা। সে কারণেই সমকালের জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ছকভাঙা কোনও উপাদান না থাকার কারণেই সম্ভবত হারিয়ে গিয়েছেন স্মৃতির অতলে। প্রভাবতীর চরিত্রগুলি নারী-পরিচয় আঁকড়ে থেকেছে, পুরুষতন্ত্রকে ভাঙতে চায়নি, তার গভীরে ঢোকেনি। পুরুষের তৈরি সাহিত্য ঘরানার বিপরীতে কিছু বলতে চাননি প্রভাবতী। সমাজ যে ভাবে মেয়েদের চায়— স্ত্রী কিংবা মা— সে ভাবেই থেকেছে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলি। মেয়েদের জীবনের ভিতর দিয়ে সমাজকে দেখানোর পরেও শিকল ছেঁড়ার আবেদন না থাকাই বিস্মৃতির মূল কারণ বলে চিহ্নিত করছেন তাঁরা। উদাহরণ, ‘আমার কথা’ উপন্যাসে বালবিধবার স্বামীকে দেখার স্মৃতিও নেই। তবু মেয়ের দাদা পুনর্বিবাহের চেষ্টা করলে লেখক তাঁকে নঞর্থক ভাবেই আঁকেন।

এর আগে প্রভাবতীর সাহিত্য নিয়ে সুকুমার সেনের মন্তব্য প্রায় ব্যঙ্গের মতোই, “বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস রচনা যে ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে তাঁর... রচনার অজস্রতাই সেই কথা প্রমাণ করে।” যদিও বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য ব্যক্তিত্বের এই মন্তব্যে আজও

ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রভাবতীর জন্মস্থানের গবেষকেরা। গোবরডাঙার কিছু মানুষ আজও প্রভাবতীকে মনে রেখেছেন, ভূমিকন্যাকে নিয়ে তাঁরা গর্ব করেন। যমুনা নদীর উপরে সেতু প্রভাবতীর নামাঙ্কিত হয়েছে। অজস্র সাহিত্যকীর্তি, মঞ্চাভিনয় আর চলচ্চিত্রায়ন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা— সত্যিই তো, বাংলা সাহিত্যে এ রকম সাহিত্যিক আর ক’জনই বা আছেন?

বরং প্রভাবতীর জীবন আর সাহিত্যকে পাশাপাশি রাখলে একটু অন্য ভাবেও দেখা যায় স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে। ‘কোরক’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে জয়িতা দত্ত লেখেন, “প্রভাবতীর বিরুদ্ধে সমালোচকরা এই মুহূর্তে হয়তো খানিকটা স্তব্ধ হবেন। হয়তো আর একবার খোঁজ করে দেখবেন উপন্যাসের বহির্বাস্তবের অন্তরালে নিশ্চুপ থাকা চিরায়ত সত্যের অন্তর্বাস্তবকে। দেখবেন ওই গতবন্দী লেখিকা-ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে কতখানি চিন্তিত।” আসলে মেয়েদের যন্ত্রণা তাঁকে বিদ্ধ করে, কিন্তু প্রতিবাদ ঝলসে ওঠার বদলে প্রার্থনার পথই বেছে নেন প্রভাবতী। “ভগবানকে জানাই আবার যদি জন্ম দাও, বাংলার মেয়ে করে যেন আমাদের পাঠিয়ো না, ...ঘৃণিত এই বিষ্ঠার কীট করো—সেও ভালো; তবু বাংলার মেয়ে হয়ে যেন আর না জন্মাই।” মেয়েদের অনাশ্রয় আর সহায়হীনতার কথা কেবল দুঃখ হয়েই ঝরে পড়ে তাঁর কলমে। নিজের ‘বোধন’ উপন্যাস, যেখানে অন্তঃপুরবাসিনী মেয়েদের ভিতরের কান্নার গল্প বলেন লেখক, সেটি তাঁর বর্ণনায় ‘বুকের পাঁজর এক একখানা করে খসে পড়বার গল্প’। উল্লেখ্য, এই উপন্যাসের নায়িকা মেধারও বাল্যবিবাহ হয়েছিল। তার পর বাল্যবৈধব্য।

আসলে ভাবতে হবে, যাঁর নিজের জীবন গড়পরতা ছিল না, মাত্র ন’বছর বয়সে বিয়ের সাত দিনের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি ছেড়েছিলেন, সাহিত্য রচনার সময়ে তিনি কেন বেছে নিলেন গতানুগতিক পথ? নিজের জীবনে অসংখ্য বার বিচ্ছেদ দেখা প্রভাবতী তাঁর সাহিত্যে মিলনের কথা বলতে চেয়েছিলেন। গ্রাম-শহর হোক কিংবা প্রেম-দাম্পত্য, সমস্ত সম্পর্কের বিন্যাসের মধ্যে যে মিলন রয়েছে, তা পেতে চেয়েছিলেন লেখক। হয়তো নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে দুঃখের চেয়েও বেশি আতঙ্কে থাকতেন তিনি। কেননা বিচ্ছেদের হাহাকারের মধ্যে যে এক নিঃসঙ্গতার ভয় আছে! হয়তো দুর্বিষহ বেদনার তাড়না থেকে মুক্তি পেতেই নিয়তির দ্বারা লাঞ্ছিত মেয়েদের সংযমের কথা বলেছিলেন তিনি। অনুমান করা যায়, সমাজের প্রতারণা থেকে বাঁচতে আত্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া আর কোন পথই বা থাকে? এ ভাবে ভাবতেন প্রভাবতী।

অতএব বঙ্কিমচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথের মতো অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎকে মাতিয়ে তুলতে না পারলেও, কেবল সাময়িকতার আর্জি মিটিয়েই নিজেকে শেষ করেননি প্রভাবতী। বলতে চেয়েছিলেন আরও বেশি কিছু। বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে। লেখা শেষ করতে হয় ‘জাগৃহি’ উপন্যাসের নায়ক ঈশানের সংলাপ দিয়ে। ধর্ষিতা মায়ের কলঙ্কে ব্রাহ্মণের পঙ্‌ক্তিভোজনে পৈতে ফেলে দেয় ঈশান। আর বলে ওঠে, “যদি সত্যকার দেবতা কেউ থাকেন, আমি হাতজোড় করে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছি... যদি আবার জন্ম দাও... আমায় হীন চণ্ডালের ঘরে... সেখানে সমাজ গড়ে তুলব... জগৎকে সেটাই জানাব।”

ঋণ: সুখেন্দু দাস, দীপককুমার দাঁ, পবিত্রকুমার মুখোপাধ্যায়, রণিতা চট্টোপাধ্যায়

অন্য বিষয়গুলি:

Prabhavathi Devi Saraswathi Literature Bengali Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy