সনাতন: লালুপ্রসাদ সাউয়ের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী ‘ব্রোঞ্জ অ্যান্ড পেন্টিংস’
পঁচাশিতেও চিরতরুণ। এই তারুণ্য অবশ্যই কিছু শিল্পমাধ্যমকে কেন্দ্র করে। না হলে কী করে একজন চিত্রকর কয়েক দশক ধরে ড্রয়িং নিয়েই বহুমাধ্যম ব্যবহার করার পাশাপাশি, লিথোগ্রাফ, লিনোকাট, এচিং, টেম্পারা, ভাস্কর্য (ব্রোঞ্জ) ইত্যাদি আরও নানা মাধ্যমে নিরলস কাজ করে চলেছেন?
লালুপ্রসাদ সাউয়ের নতুন প্রদর্শনী ‘ব্রোঞ্জ অ্যান্ড পেন্টিংস’। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে প্রশান্ত তুলসীয়ানের উপস্থাপনায়, জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে দেখা গেল ৩৭টি কাজ। কন্টি, প্যাস্টেল, ১৭টি টেম্পারা, ১৭টি ব্রোঞ্জ।
টেম্পারার কিছু কাজ কিন্তু সমানুপাতিক অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও মাত্রাহীন অবস্থানটিকে প্রত্যক্ষ করায়। হঠাৎ প্রোপোরশনের এই অসঙ্গতি চোখে একটু হলেও লাগে। শরীরের তুলনায় মাথা বা অন্য প্রত্যঙ্গ যদি কিছুটাও ছোট-বড় হয়, সে ক্ষেত্রে দ্বিমাত্রিক চিত্রের এই অপরিমিতি পীড়াদায়ক। বর্তমান প্রদর্শনীতে লালুপ্রসাদের টেম্পারাগুলি নিবিড় পর্যবেক্ষণ-উত্তর, এই বোধ কয়েকটি কাজে স্পষ্ট হয়। ব্রোঞ্জের কাজেও এই সমস্যা সামান্যতম হলেও চোখে পড়েছে। যদিও তাঁর টেম্পারার কাজগুলির বিন্যাস, স্টাইল, কম্পোজ়িশন, টেকনিক, স্বল্পবর্ণের সমাহার, অবয়বী মুহূর্তের একটা অভিব্যক্তিময় প্রকাশ, স্থির কিন্তু সচিত্রকরণসদৃশ, শিল্পীর নিজস্ব এক দৃশ্যকল্প-মুহূর্তটিকে দর্শক কিন্তু বহুকাল ধরে আত্মস্থ করেছেন। গ্রহণ করেছেন। সেই হিসেবে লালুপ্রসাদ বহুকাল ওই বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি, নগর সভ্যতার বিলাস, বাবুয়ানি জীবনযাপনের কিছু দিক, বিরাম-মুহূর্ত, দৈনন্দিন যাপনচিত্রের কিছু ঘরবন্দি মুহূর্ত, বিশেষত বাবু-বিবি সিরিজ় বিখ্যাত এত কাজ এই একটি ভাবনাকে নিয়েই লালন করে চলেছেন। কোথাও যে মোনোটোনি আসেনি, তা নয়। চিত্তাকর্ষক, দৃষ্টিনন্দন একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে তিনি সমতল বর্ণের ঘেরাটোপে অবয়বের শরীর, ত্বক, অলঙ্কার, পোশাক, ডিজ়াইন, প্রয়োজনীয় রূপবন্ধ, স্বল্প স্থাপত্য, বারান্দার গ্রিল, ধুতি-পাঞ্জাবির প্রিন্ট, চটি, অঙ্গুরি, চুলের স্টাইল, শাড়ির প্রিন্ট ইত্যাদির ক্ষেত্রে বরাবর নিজস্ব একটা পরিমিত স্টাইলকে প্রত্যক্ষ করান। বোঝা যায় যে, ধরে ধরে কাজ করার এই নিবিড় টেকনিকটি তিনি তাঁর শান্তিনিকেতন-কলাভবন-অধ্যয়ন পর্বের পর থেকেই আত্মস্থ করে, একটা স্টাইলকে নিজের মতো তৈরি করে নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে কখনও তিনি কোনও বিবর্তিত রূপ বা নিরীক্ষাজাত প্রবণতার দিকে পা বাড়াননি। সে সব অন্য মাধ্যমের ক্ষেত্রে পরবর্তী ক্ষেত্রে হয়েছে। চিত্রগুলির চতুর্দিকের দ্বিবর্ণ-ত্রিবর্ণের নানা ফ্রেম তাঁর সুচারু বিন্যাস ও তুলির লাবণ্যময় গতির সাক্ষী। তাঁর সমস্ত টেম্পারা চিত্রে এই বিশেষত্ব লক্ষণীয়। ড্রয়িংকে প্রাধান্য দেওয়া চিকন বা কখনও অপেক্ষাকৃত স্থূল রেখার ব্রাশিং সমস্ত বিভাজনরেখার সুনির্দিষ্টতাকে একটা খুঁতহীন অবস্থার দিকে নিয়ে যায়। হয়তো সেখানে একটু কাঠিন্যও লক্ষ করা যায়। সামগ্রিক চিত্রের বিচারে তা অতটা বাধাপ্রাপ্ত নয়। তবে কাঠিন্য যে একেবারে নিরুদ্দেশ, তা-ও নয়।
সুকুমার রায়ের লেখা ‘অতি খাসা মিহি সুতি/ফিনফিনে জামা ধুতি/চরণে লপেটা জুটি জরিদার/এ হাতে সোনার ঘড়ি/ও হাতে বাঁকানো ছড়ি/আতরের ছড়াছড়ি চারিধার...’। কিউরেটর নোটসের শুরুতে জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের এই উল্লেখ অনেক ছবির নামকরণে নির্দ্বিধায় চলে যায়। তবে জানা নেই, সুকুমারের এই লাইনগুলি থেকে লালুপ্রসাদ কোনও ভাবে কখনও উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর কিছু কাজ শুরু করেছিলেন কি না।
তাঁর বাবু-বিবি যখন আপাত-বৃহৎ ব্রোঞ্জে রূপান্তরিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করছে, তখন ভাস্কর্যসুলভ সমুন্নতি ও প্রয়োজনীয় লাবণ্যের ঘাটতি কিন্তু একেবারেই ছিল না, তা নয়। একটা টেক্সচারাল কোয়ালিটি যেমন চোখে পড়েছে, তেমনই পোশাকআসাকের ক্ষেত্রেও ডিজ়াইনের দিকটিতে টেক্সচার তৈরি, কিছু দৃঢ় লাইন, বোতাম, ভাঁজ, কোঁচা, চশমা, কলম, হাতে ঝোলানো ছাতা, হাতে ধরা ডাব ও স্ট্র, ঠোঁটে ঝুলন্ত পাইপ-সিগারেট, হাতে বসা প্রজাপতি, আয়নায় মুখচ্ছদ, হাতে ধরা জাঁতি, বাঘের মুখে লাগাম ধরা হাত, পুষ্প... সবেতেই তিনি ভাস্কর্যের গুণাগুণকে একটা মাত্রার মধ্যে বিন্যস্ত করতে পেরেছেন। এই মাত্রার ক্ষেত্রেও সামান্য স্খলন যে ঘটেনি, তা-ও নয়। দ্বিমাত্রিক চিত্রের কিছু চরিত্রকে ব্যবহার করেছেন এই ত্রিমাত্রিক ব্রোঞ্জের ক্ষেত্রেও। শিল্পী এড়ানোর চেষ্টা করলেও তাঁর ভাস্কর্যে কিছুটা পৌত্তলিকতা এসেই গিয়েছে। তাঁর চিত্রের গণেশের চেয়েও বহু গুণে শিল্পসমন্বিত ভাস্কর্যের গণেশ। মাটিতে ও সিংহাসনসদৃশ বেঞ্চে বসা গণেশের মুহূর্তগুলি চমৎকার। ধ্রুপদী আবহ থেকে বাস্তবসম্মত সমস্ত দিকই তিনি অতি সচেতনতার সঙ্গে কাজ দু’টিতে প্রত্যক্ষ করিয়েছেন। গণেশের হাতে ধরা লাড্ডু, বর্তুলাকার অস্ত্ররশি, কৃপাণ-ত্রিশূল, ইঁদুরবাহন, বসার ভঙ্গির দু’টি ধরন, ত্বকের মসৃণতা, সুললিত ভঙ্গি... প্রত্যেকটি দিকই চোখের আরাম। যেমন পানপাত্র হাতে ‘রসিকবাবু’, ‘নবকুমার’, ‘মেজদা’, ‘ললিতা’, ‘বৌ ঠাকুরানী’, ‘রায়বাঘিনী’, ‘গণেশ’, ‘পিপাসা যৌবনা’, ‘বাবুসাহেব’ ইত্যাদি বেশ আকর্ষণীয় কাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy