বিমূর্তায়ন: শিল্পী সোমনাথ হোরের জন্মশতবর্ষের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম
আশির দশকে তাঁর শান্তিকেতনের বাড়িতে বসে একটি সাক্ষাৎকারসূত্রে সোমনাথ হোর বলেছিলেন, ‘‘মানুষের এই বিবিধ যন্ত্রণা, কষ্টগুলো বারবার আমার চেতনায় ধাক্কা মারে, সহজে বিস্মৃত হতে পারি না।’’ ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এই কমিউনিস্ট শিল্পী। তেভাগা আন্দোলনে নিজেই বিরাট এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। লিখেছিলেন তেভাগা নিয়ে অনেক লেখা। গ্রন্থপ্রকাশ ও বহু স্কেচ, ড্রয়িং সে সময়কার অমূল্য দলিল। প্রভূত মাধ্যমে তাঁর অজস্র শিল্পসৃষ্টি, বিস্তর লেখালিখি, সে সময়কার রাজনৈতিক বিবিধ বিশ্লেষণের ইতিহাসকে একত্র করে কোনও কাজ এখনও করা হয়ে ওঠা হল না। সেই অর্থে এই মহান পেন্টার-প্রিন্টমেকার-স্কাল্পটরের যে মূল্যায়ন হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর তাঁকে সাংঘাতিক নাড়া দিয়েছিল। আমৃত্যু বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী শিল্পী সোমনাথ হোরের জন্মশতবর্ষের প্রদর্শনী ‘শতবর্ষের আলোয়’ আয়োজিত হল দেবভাষায়। ১৯৬৩-২০০১ এই আটত্রিশ বছরের ৬২টি কাজ-সহ নির্বাচিত সংগ্রহের কাজগুলির কিছু গ্যালারির নিজস্ব, বাকিটা পারিবারিক।
তাঁর শিল্পে বহু বাঁক এসেছে। বিবর্তিত হয়েছে কাজ। মাধ্যমগত বৈচিত্রে কিন্তু মানুষই ছিল তাঁর প্রধান ও শেষ প্রেরণা। খুব কাছ থেকে মানুষের দৈনন্দিন যন্ত্রণা, সংকট, দুর্বিষহ অবস্থান থেকে মৃত্যু, মানুষের সংগ্রাম-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তিনি অনুধাবন করেছেন। অজস্র সৃষ্টিতে সেই সামাজিক-রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইকে নানা ভাবে ব্যক্ত করেছেন। সে স্কেচ, ড্রয়িং, প্রচুর খসড়া, ছাপচিত্র, ভাস্কর্য, পেন্টিং, টেরাকোটা... এমন অনেক মাধ্যমে। যদিও প্রথম দিকের অ্যাকাডেমিক চর্চা থেকে পরবর্তী সময়ে নানা ভাবেই বিমূর্তায়ন ও সাদা-কালো ছাপচিত্র বা ড্রয়িংয়ে তাঁর অভূতপূর্ব এক অধ্যায় লক্ষণীয়। সেই সঙ্গে ভাস্কর্যের আশ্চর্য স্টাইলেও এনেছিলেন নিজস্ব এক পদ্ধতি, যা চমকে দেওয়ার মতোই। বহু নিরীক্ষা করেছেন। মানুষের বিপন্নতা, যন্ত্রণার জ্যান্ত রূপ যখন রূপক হয়ে তাঁর ছবিতে আত্মপ্রকাশ করে, সেখানেও মনে হয়, কতটা গভীরে এই বেদনাহত মনটিকে তিনি নিয়ে গিয়ে অন্তঃস্থলটিকেও যেন প্রত্যক্ষ করেছেন। না হলে ওই ব্যথাহত রূপ, শরীরী বিভঙ্গে মানুষের বেঁকেচুরে যাওয়া যন্ত্রণাকে, অভুক্ত নিরন্নের এই অভিব্যক্তিময় মুহূর্তগুলিকে বিভিন্ন রেখায় ও ভাবে ব্যক্ত করা দুঃসাধ্য। এই জায়গাটিকেই তিনি দ্রুত ধরতে পেরেছিলেন।
এই প্রদর্শনীতে ভাস্কর্য ছাড়া প্রায় সব মাধ্যমের কাজই ছিল। তবে বেশির ভাগ কাজই ড্রয়িং, ছাপচিত্র, স্কেচ, দ্রুত করা কিছু পেন, পেনসিল, তুলির সরু ও মোটা রেখা, প্যাস্টেল ও রঙিন পেনের ড্রয়িং... এমনই নানা রকম কাজ। এখানে বিশেষত্ব বলতে সবই অবয়বী ছবি। উল্লেখযোগ্য হ্যাচিং থেকে রেখার বৈচিত্র ও সরলীকরণ বিভিন্ন মাত্রায় সংযোজিত। এই সরলীকরণে কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই ছায়াতপ সংক্ষিপ্ত, প্রায় উধাও। যখন রেখাপ্রধান ছবিতে মানুষের আপাত বিষাদ-বেদনাকে রূপ দিচ্ছেন, সেখানে ওই গভীর ড্রয়িংয়ে প্রত্যক্ষ ভাবেই অবয়বের ব্যথাহত অনুভূতিটি জাগ্রত। এটি শিল্পীর নিজস্ব এক প্রখর অনুভূতিরই একটি দিক। নিরন্নের যে আর্তিকে তিনি বাস্তবে অনুভব করেছেন, দ্বিমাত্রিক সারফেসে হুবহু তাকেই যেন রৈখিক ও টোন-সংবলিত রূপারোপে জীবন্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ কৃশকায় শরীর, ন্যুব্জ মানুষ, কৌতূহলী ও বিস্ময়াবিষ্ট নারী, যোদ্ধা, বিহ্বল-আতঙ্কিত মানুষ, একাকী শিশু, চিন্তাচ্ছন্ন মুখ, এমনকি কিছু পশুপাখির অবস্থান ও চালচলনে তাদের ওই মুহূর্তের অভিব্যক্তিকে রেখার বিবিধ টান, চাপ, সরলীকরণে মূর্ত করেছেন। এই রেখা কখনও অতি সংক্ষিপ্ত, কখনও অনেকটা অংশ জুড়ে তার অস্তিত্ব। যে অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে থাকে অন্য অবয়ব ও আসবাবের যৎসামান্য সঙ্কেত অথবা সারমেয়র চিৎকার বা ভাস্কর্যসুলভ ফর্মেশনে খেলনা পুতুলের টুকরো রূপ, জ্যামিতিক কিছু টানটোনের মধ্যে অবস্থানরত বিপন্ন বালক বা বিক্রেতা, সারমেয় ইত্যাদি।
লিথোগ্রাফ বা এচিং, মিশ্র মাধ্যম, পেন-ইঙ্কের এমন কিছু কাজে এই এক ধরনের অতি সরলীকরণ থেকে স্বল্প রেখা ও ছায়াতপের ছড়ানো রচনায় রেখাকে অদ্ভুত ভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। সমগ্র কাজটিতে যেন একটি নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে। অতি সামান্য টোন, স্বল্প রেখা বা হ্যাচিং থেকে আপাত-অদৃশ্য ও রেখারই অপস্রিয়মাণ বা হঠাৎ থমকে যাওয়াও কিন্তু ওই কাজটির ক্ষেত্রে যথেষ্ট অর্থবহ। অর্থাৎ মাধ্যম নিয়ে তিনি যেন ছেলেখেলা করেছেন, এতটাই দক্ষতাসম্পন্ন ওই কাজগুলি। বর্ণ এসেছে অতি সংযত হয়ে, ক্রমশ বর্ণহীনতার দিকে চলে যাওয়া, সেই সঙ্গে টোন ও লাইন ভীষণ রকম কাব্যিক ও একই সঙ্গে নিরীক্ষামূলক। কোনও সংঘাত নেই, অথচ কী অমোঘ! মনে চিরকালীন দাগ রেখে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy