নাটকের দৃশ্যে ঋদ্ধি-কৌশিক। —নিজস্ব চিত্র।
গত ৩ ডিসেম্বর অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের মঞ্চে সায়ক নাট্যগোষ্ঠীর সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে উপস্থাপিত হল স্বপ্নসন্ধানীর ‘হ্যামলেট’ নাটকটি। নির্দেশনা ও নির্মাণে কৌশিক সেন। শেক্সপিয়রের অতি প্রসিদ্ধ ‘হ্যামলেট’ নাটকটি নিয়ে প্রখ্যাত কবিদের মধ্যেই মতানৈক্য রয়েছে। উনিশ শতকে রোম্যান্টিক কবি কোলরিজ হ্যামলেটে মুগ্ধ হয়েছেন এবং তিনি হ্যামলেটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অপারগতাকে মনুষ্যচরিত্রের একটি স্বভাব বলেই বিশ্লেষণ করেছেন। একটি ছেলে ভাবছে, কিন্তু কাজে সেই ভাবনাকে প্রতিফলিত করতে পারছে না। পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইছে সে, কিন্তু পারছে না। কোলরিজ মনে করেন এই স্বভাব আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু হ্যামলেটের মধ্যে এর আতিশয্য ঘটেছে কারণ শেক্সপিয়র এটা ঘটিয়েছেন— ‘মরবিড এক্সেস’-এর মাধ্যমে। পরের শতকে প্রখ্যাত কবি টি এস এলিয়ট লিখলেন, ‘দ্য প্লে ইজ় মোস্ট সার্টেনলি অ্যান আর্টিস্টিক ফেলিয়োর’। এরও পরে উত্তরাধুনিক সময়ে প্রখ্যাত ইংরেজ সমালোচক ও পণ্ডিত অধ্যাপক হ্যারল্ড ব্লুম বলেছেন, ‘হ্যামলেট... ইজ় আ রিভেঞ্জ অন রিভেঞ্জ ট্র্যাজেডি। ইট ইজ় আ কসমোলজিক্যাল ড্রামা...’। যুগের পর যুগ ধরে হ্যামলেট সমালোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হ্যামলেট আজও সচল, প্রাণবন্ত, আজও অভিনীত হচ্ছে পৃথিবীর নানা শহরে। স্বপ্নসন্ধানীর ‘হ্যামলেট’কেও তাই পাঁচশো বছর পুরাতন একটি দীর্ঘ পরম্পরার মধ্যেই ধরতে হবে। কিন্তু দেখার বিষয় এটা যে তাঁরা এই নাটকটিকে কী ভাবে দেখেছেন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবে ‘ইন্টারপ্রিট’ করেছেন নাট্যবস্তুটিকে।
প্রথমেই নাটকটি দেখতে গিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কেন হ্যামলেটকেই বেছে নিলেন কৌশিক সেন? তিনি কি প্রকৃতই শেক্সপিয়রের হ্যামলেটকে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন? নাকি এই হ্যামলেটের ‘ক্যাওটিক ওয়ার্ল্ড’-এর মধ্য দিয়ে কোনও বার্তা দিতে চেয়েছেন? নাটকটি দেখতে দেখতে এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল যে এই হ্যামলেট এখনকার কথা বলছে, এই সময়ের ঘটে-চলা দমবন্ধ-করা অন্যায়ের কথা বলছে। ফলে চৈতি মিত্রর সাবলীল নাট্য-অনুবাদের পাশাপাশি ঢুকে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলালের গান। ঢুকে পড়েছে বাংলা কবিতার পঙ্ক্তি। মূল টেক্সটকে ভেঙে তাকে এই সময়ের প্রতীক করে তোলার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
এই নাটকটিতে মঞ্চভাবনা, পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে দর্শককে প্রথমেই বাস্তব পৃথিবীর বাইরের এক অন্য-পৃথিবীর ভিতর এনে ফেলা হল। এ হ্যামলেটের জগৎ কিন্তু আবার এখনকার নানা চিহ্ন বহন করছে। শুরুতেই দেখা যায় মঞ্চে উপস্থিত বৃহৎ একটি করোটি, যার চারপাশে অজস্র প্লাস্টিকের দোমড়ানো মোচড়ানো বোতল আর তার মাথায় ঝুলছে রাজছত্রের জায়গায় ভাঙা পাখা, এগজস্ট ফ্যান, পরিত্যক্ত পুতুল। এই মঞ্চভাবনাটি নিঃসন্দেহে এই ‘হ্যামলেট’-এর মূল সুরটি বেঁধে দেয়। এর পরেই চমৎকৃত করে হ্যামলেটের প্রথম দর্শন। হ্যামলেট একটি মশারির ভিতর অন্তর্বাস-পরিহিত অবস্থায় নিদ্রামগ্ন। সে যেন মাতৃজঠরের অসীম নিরাপত্তার ভিতরে শায়িত। এই ঘুম তার ভেঙে যায় পিতার মৃত্যুর খবরে। এইখান থেকে শুরু হয় তার প্রতিশোধকামিতা, তার উন্মত্ততা, তার চাতুর্য। হ্যামলেটের নামভূমিকায় ঋদ্ধি সেন বলিষ্ঠ ও সাহসী কাজ করেছেন। হ্যামলেট চরিত্রটি সহজ নয়, এ কথা সকলেই জানেন। বহুপঠিত ও অভিনীত বলে, হ্যামলেটের চরিত্রে উত্তীর্ণ হওয়াও সহজ নয়। এই চরিত্র করতে গেলে যথেষ্ট পরিমাণে পঠন-পাঠন ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতেই হবে, না হলে হ্যামলেট চরিত্রের জটিল স্তরগুলো প্রকাশিত হবে না। ঋদ্ধির অভিনয় দেখে বোঝা যায় যে দীর্ঘ সময় ধরে এই চরিত্রটির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। বিশেষত হ্যামলেটের উন্মত্ততার সময়গুলোয় একটা অতি-অভিনয় ও মেলোড্রামার ভয় থেকে যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ঋদ্ধি সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। শেক্সপিয়রের অতি-বিখ্যাত ‘টু বি অর নট টু বি’ এই স্বগতোক্তিটি মূল ইংরেজিতেই রয়েছে এবং ঋদ্ধির স্পষ্ট উচ্চারণে তা শুনতে ভাল লেগেছে।
হ্যামলেটের কাকা ক্লডিয়াসের চরিত্রের খলতা, চতুরতা, স্নেহ, বিপন্নতা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে এনেছেন কৌশিক সেন। তাঁর অভিনয়ের একটি বিশেষ ধারা রয়েছে, যার সঙ্গে সকলেই পরিচিত। সেই ধারার মধ্যে থেকেই তিনি ক্লডিয়াসকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে রূপদান করেছেন। হ্যামলেটের মা গারট্রুডের ভূমিকায় রেশমী সেন বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এক দিকে ক্লডিয়াসের প্রতি প্রেম ও স্বামী-হত্যার অপরাধবোধ, অন্য দিকে ছেলের দুর্বিষহ উন্মত্ততার মধ্যে আটকে পড়া নারীর অসহায়তার জটিল অভিব্যক্তি তিনি সার্থক ভাবে তুলে ধরেছেন। ভাল লেগেছে ওফেলিয়ার চরিত্রে সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ। হ্যামলেটের প্রত্যাখানের ফলে নিষ্পাপ সুন্দর ওফেলিয়ার সম্পূর্ণ উন্মাদিনী অবস্থায় পৌঁছে-যাওয়ার জায়গাটি তীব্রতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
পৃথিবীতে হ্যামলেট নিয়ে কম কাজ হয়নি। অস্ট্রিয়ান টেলিভিশনেও ‘নেকেড হ্যামলেট’ নামে ফিল্ম হয়েছে। সুতরাং এই নাটকটি নিয়ে পূর্বেও ভাঙচুর হয়েছে, পরেও হবে। তবে কৌশিক সেন পরিচালিত ‘হ্যামলেট’ দর্শককে সম্পূর্ণ অন্য এক চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। নাটকটি শেষ হওয়ার পরেও মনে ছাপ রেখে যায়। নাটকটির উপস্থাপনায় নতুনত্ব রয়েছে। স্বপ্নসন্ধানীর ‘হ্যামলেট’-এর বিশেষত্ব এখানেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy