নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে জাপান? কেন উঠছে এমন প্রশ্ন? কোনও পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ অথবা প্রকাণ্ড জলোচ্ছ্বাস নয়, কেবলমাত্র মানুষের অনিচ্ছার কারণে ভীতি জন্মাচ্ছে জাপান সরকারের মনে। ২০২৪ সালে জাপানে জন্মহার সর্বনিম্নের ভিত্তিতে রেকর্ড গড়ে ফেলেছে। এই নিয়ে টানা ৯ বছর ধরে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সে দেশে। যদি এমনই চলতে থাকে, তবে ২৭২০ সালের জানুয়ারিতে (এখন থেকে ৬৯৫ বছর পর) জাপানে শিশুর সংখ্যা মাত্র একটিতে নেমে আসবে।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, জন্মহার না বাড়লে দেশটিই একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিদেশি নাগরিক-সহ মাত্র ৭,২০,৯৮৮ শিশুর জন্ম হয়েছে জাপানে। ২০২৩ সালে সে দেশে ৭,৫৮,৬৩১ শিশুর জন্ম হয়েছিল। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে শিশুজন্মের সংখ্যা পাঁচ শতাংশ কমে গিয়েছে। যেখানে, ভারতে ২০২৪ সালে ২,৯৪,৬৬,৩৬৬ শিশুর জন্ম হয়েছে। প্রথম বার এই প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল ১৮৯৯ সালে। তার পর থেকেই ধীরে ধীরে সন্তানের জন্ম দেওয়ার বিষয়ে অনীহা বেড়েছে জাপানের নাগরিকদের মধ্যে।

জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, জন্মহার না বাড়লে দেশটিই একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ছবি : এপি।
কিন্তু প্রজনন নিয়ে এই ধরনের অনিচ্ছা কেন জন্ম নিল জাপানে?
জাপান রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ তাকুমি ফুজিনামি এই বিষয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, বিয়ের সংখ্যা কমতে শুরু করার পরেই প্রজনন নিয়ে অনীহা মানুষের মধ্যে। গত বছর জাপানে বিয়ের হার ৪৯৯,৯৯৯ শতাংশ ছিল। যা তার আগের বছরের তুলনায় ২.২ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু ২০২০ সালে, কোভিডের সময়ে ১২.৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল বিয়ের হার। তার প্রভাব এখনও টের পাচ্ছে জাপান। ২০২৫ সালেও নাকি স্পষ্ট হবে সেই প্রভাব!
কেন কমল বিয়ের হার?
অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর এথিক্স ইন এআই-এর সহযোগী অধ্যাপক একাতেরিনা হার্টোগের মতে, জাপান যদি কখনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তার মূল কারণ হবে সে দেশের কর্মসংস্কৃতি। ভাল বেতনের চাকরি না করলে পুরুষদের বিবাহযোগ্য বলে মনে করা হয় না। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এই দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে বটে, কিন্তু জাপানের ক্ষেত্রে এ ছাড়া আরও কয়েকটি বিষয় রয়েছে। জাপানের বাজারে ভাল চাকরির অভাব বাড়ছে বলেই বক্তব্য বিশেষজ্ঞদের। ফলে পুরুষদের মধ্যে এমন এক শ্রেণি তৈরি হচ্ছে, যাঁরা আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে বিয়ে করতে চাইছেন না অথবা সন্তানের জন্ম দিয়ে পরিবার গড়ে তোলার ব্যাপারে সাহস পাচ্ছেন না। এ ছাড়া জাপানে অতিরিক্ত পরিশ্রমের প্রচলন তো রয়েইছে। জাপানি ভাষায় 'কারোশি' বলে একটি শব্দ রয়েছে, যার অর্থ, অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে মৃত্যু। এই শব্দের বহুল প্রচলনই ইঙ্গিত করে, কঠোর পরিশ্রমের ফলে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে দেখেই আর সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা ভাবছেন না দেশের জনগণ।মহিলাদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে বংশবৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাঁধাধরা কাজের সময় নেই। তার উপর বেতন কম। সন্তানের জন্ম দিয়ে তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করতে চান না অধিকাংশ মহিলা।

পুরুষদের মধ্যে এমন এক শ্রেণি তৈরি হচ্ছে, যাঁরা আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে বিয়ে করতে চাইছেন না। ছবি : এপি।
সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ
তোহোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজবিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যাপক হিরোশি ইয়োশিদা বলেছেন, “কম জন্মহারের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রথম দেশ হতে পারে জাপান।” এই ভীতি জন্ম নিয়েছে সরকারের মনেও। ফলে বিয়ে এবং সন্তানধারণে দম্পতিদের উৎসাহিত করার জন্য একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে জাপান সরকার। রাষ্ট্র পরিচালিত ডেটিং অ্যাপ, সরকারের পক্ষ থেকে শিশুযত্নের সুবিধা, আবাসনের সুবিধা, ৩.৬ ট্রিলিয়ন ইয়েনের (ভারতীয় টাকায় যা ২১,০১,৪৩,৯৮,৮০,০০০) শিশুযত্ন নীতি প্যাকেজের মতো কর্মসূচি চালু হয়েছে সে দেশে। যদিও তার পরেও এখনও জন্মহার বাড়েনি।