যে প্রেম এখনও কথা বলে। ‘... আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কত ক্ষত, কী অসীম বেদনা। সেই বেদনার আগুনে আমি পুড়ছি। তা দিয়ে কোনও দিন তোমায় দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমাণিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। তোমায় কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনে সর্বপ্রথম ভালোবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বুকে ...। দেখা? নাই বা হল এই ধূলির ধরায়। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালোবাস আমাকে চাও ওখানে থেকেই আমাকে পাবে। লায়লা মজনুকে পাইনি, শিঁরী ফরহাদকে পাইনি ...’। কুমিল্লা জেলার দৌলতপুরে সৈয়দা খাতুন নামে এক কিশোরীকে ভালবেসে তিনি এই চিঠি লিখেছিলেন।
নজরুলের প্রেম ভালোবাসার সেইসব চিঠি যেন আজও ‘ভালোবাসার পরম্পরা’ হয়ে ধরা দিল উত্তম মঞ্চে। যা অবিস্মরণীয়। অনিন্দিতা কাজী ও সৌম্য বসুর পাঠ ও গানের যুগ্ম অনুষ্ঠানে। যা শ্রোতাদের মনে ভালোলাগার আরও একটি নতুন নজির বলা যায়। ধন্যবাদ অনিন্দিতাকে। ওই প্রেমপত্রের বিভিন্ন ভাগে অনিন্দিতার পাঠ ও সৌম্য বসুর গান – দুই মিলে দর্শকদের ভাবাবেগকে যেন মাতিয়ে দিল নতুন করে। নতুন প্রজন্মের কাছেও। ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনার’ গানটি অনুষ্ঠানটিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। যেমন বলা যায়, অসাধারণ কণ্ঠস্বরে, ভাবনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠা অনিন্দিতার পাঠ ‘আবার যখন আসবে ফিরে’। এমনই দৃষ্টান্ত অন্যগুলিতেও। যেমন- ‘বন্ধু আমার’, ‘দৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি’, ‘কার বাঁশি বাজিল নদী পারে’। ভাবনায় উড়ে যাওয়া যেন দুই বাংলার মিলন।
সৌম্যর তৈরি গলা। ‘পরদেশি বধূ ঘুম ভাঙায়ো’ নৈপুণ্যে নিখুঁত। যেমন বলা যায় অন্য দুটি গানেও- ‘তোমার আঁখির মত’, ‘তোমার বুকের ফুলদানিতে’। তবে এদিনের সেরা প্রাপ্তি বলা যায় লোকগানের সুরে ‘গাঙে জোয়ার এল ফিরে’।
গানের সুরে মন ভেসে যায় কুমিল্লার সেই দৌলতপুরে। সিক্ত চোখে প্রবীণ শ্রোতার মনে হারানো দিনের কিছু স্মৃতি উঁকি মেরে যায়। কাঁটাতারের বেড়া টপকে মন চলে যায় সৈয়দা খাতুনের সেই গ্রামে। এখানেই অনুষ্ঠানের সার্থকতা।
গুরুর ছায়া
দীক্ষামঞ্জরীর অনুষ্ঠানে। লিখছেন বারীন মজুমদার
গুরুর নাম যখন কেলুচরণ মহাপাত্র। এ হেন গুরুর সান্নিধ্যে একেবারে শৈশব থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন নৃত্যশিল্পী ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি কেলুচরণের শিক্ষাভাবনাকে ও সমস্ত আসল নৃত্য রচনাগুলিকে কী ভাবে ধরে রেখেছেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘দীক্ষামঞ্জরী’-তে তার একটা সম্পূর্ণ ছবি পাওয়া গেল সংস্থার পনোরোতম বার্ষিক অনুষ্ঠানে। বেহালা শরৎসদনেও প্রায় চারশো ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে তিনঘণ্টা ব্যাপী যে শাস্ত্রীয় নৃত্যানুষ্ঠানটির তিনি সামগ্রিক দায়িত্ব পালন করলেন তা অভূতপূর্ব।
ওড়িশিতে শরীর উপস্থাপনার চারটি নাম সমভঙ্গ, আভঙ্গ, ত্রিভঙ্গ এবং চৌকা। নৃত্যপদগুলিতে ছিল এক সুষ্ঠু ছন্দোস্পন্দন। সমগ্র নৃত্যানুষ্ঠানে যে নান্দনিক সুষমা লক্ষ করা গেল তা ডোনার দীর্ঘদিনের অনুরাগ ও আত্মনিবেদন। যে নৃত্যপদগুলি তিনি উপস্থাপন করলেন তার মধ্যে ছিল প্রথাগত মঙ্গলাচরণ, সাবেরি, মোহনা ও আরবি পল্লবী, নবদুর্গা অর্দ্ধনারীশ্বর প্রভৃতি। আরবি পল্লবী ও মাতঙ্গী দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় গুরু কেলুচরণের কথা। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীই নিঃসন্দেহে নিখুঁত। কিন্তু অর্ধনারীশ্বরে নৃত্যনির্মিতিতে ও আরও কয়েকটি নৃত্যে ডোনার কন্যা সানা গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিণত নৃত্য উপস্থাপন, পরিষ্কার মুদ্রা ও ভঙ্গি সহজেই চিনিয়ে দেয় ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে। একই সঙ্গে নাম করতে হয় রঘুনাথ দাসেরও যিনি অর্দ্ধনারীশ্বরে তাঁর নৃত্যধারার জন্য স্বমহিম।
গুরুশিষ্য পরম্পরা
নৃত্যশিল্পী অলোকা কানুনগোর তত্ত্বাবধানে আইসিসিআর-এ শিঞ্জন নৃত্যালয় আয়োজন করেছিল নৃত্যানুষ্ঠান। গুরু কেলুরচরণ মহাপাত্র ও গুরু রঘুনাথ দত্তের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ হয় ওড়িশি নৃত্যশৈলী ‘বটু’-র মাধ্যমে। কেদার রাগে নিবদ্ধ এই নৃত্যপদটি পরিবেশন করল শিশুশিল্পী প্রিয়াঙ্কা কুন্ডু। ‘দুর্গাবন্দনা’-র সংহার রূপটিকে ফুটিয়ে তুললেন সর্বানী সেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে অহল্যার আখ্যানটিকে সুন্দর নৃত্যবিন্যাস, সুদক্ষ পদকর্ম ও মুখজ অভিনয়ের সংমিশ্রণে দর্শকমন জয় করে নিলেন সুহাগ নলিনী দাস। তবে সেদিনের অনন্য প্রাপ্তি ছিল দেবী বাসুর অপূর্ব মুখজ ও শরীরী অভিব্যক্তি সমৃদ্ধ দুটি নৃত্যপদ। জয়দেবের অষ্টপদী নৃত্যপদটি বাসকসজ্জিতা নায়িকার ভূমিকায় তার সাবলীল অভিনয় মনকে বিশেষভাবে আপ্লুত করে। অনুষ্ঠানের শেষ নিবেদন ছিল তোড়ি রাগে নিবদ্ধ ‘মঙ্গলাচরণ’। যা বেশ প্রশংসনীয়।
প্রতিবাদ যখন কবিতায়
প্রতিবাদের কবিতায় দরাজ, উচ্চকিত কন্ঠে অনায়াস বিচরণ। বাংলা অ্যাকাডেমি সভাঘরে ঐকান্তিকা নিবেদিত ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’ অনুষ্ঠানে বাচিক শিল্পী ছিলেন পৌলমি ভট্টাচার্য। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘একটাই মোমবাতি’ এবং জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’-এর স্বরবিভঙ্গে যে বৈচিত্র এনেছেন তা প্রশংসাযোগ্য। সম্মেলক আবৃত্তির কবিতা নির্বাচনেও ছিল ব্যক্তিপ্রেম ও সমাজমনস্কতার এক নিবিড় চলাচল। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘বিন্নি ধানের খৈ’-এর ফ্যান্টাসি কিংবা নীলাদ্রিশেখর বসুর ‘গণটুকাটুকি’ অন্য ভাবনার জন্ম দেয় শ্রোতৃমনে। কিরণকুমার মুখোপাধ্যায়ের রচনা থেকে ‘টুপুরের গল্প’ ছিল এ সন্ধ্যার বাড়তি পাওনা।
কবিতার রূপ
বোধিদ্রুম’-এর প্রথম মঞ্চানুষ্ঠান হয়ে গেল পাইকপাড়ার মোহিত মঞ্চে। প্রথম পর্বে স্বামী ঋতানন্দ এবং স্বামী দিব্যরসানন্দ কবিতা পাঠ করেন। দ্বিতীয় পর্বে সংস্থার ছাত্রছাত্রীরা একক পরিবেশন করে। শেষ পর্বে শর্মিষ্ঠা বাগ পরিচালিত ‘নারী সংকলন’ ছিল উপভোগ্য। তিয়াসা দাসের ‘মা নিষাদ’, ঈশিতা কর্মকারের ‘স্বাধীনতার স্বাদ’, টুম্পা মজুমদারের ‘জন্মদিন’, গোপা দাসের ‘বেহুলা ভাসান’-এর মতো বেশ কিছু কবিতা ছিল শ্রুতিমধুর। জিতা দাসের নৃত্য পরিকল্পনা সুন্দর।
শান্তিনিকেতন-ঘরানা
সম্প্রতি শিশিরমঞ্চে বাসবী বাগচী শোনালেন বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত। যা তাঁর চর্চিত কণ্ঠে রাবীন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য পূর্ণ মাত্রায় রক্ষা করে শান্তিনিকেতনি ঘরানাকে। তাঁর নির্বাচিত গানগুলির মধ্যে ছিল ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’, ‘রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি’, ‘আমার না বলা বাণীর’ গানগুলি বুঝিয়ে দেয় শিল্পীর পরিণত গায়কি।
এ দিন তিনি যে গানগুলি নির্বাচন করেছিলেন তার বেশির ভাগই ছিল বিভিন্ন ঋতুপর্যায়ের। তবে শ্রোতাদের মনে থাকবে শিল্পীর গাওয়া শেষ তিনটি গান। যেমন- ‘সেই তো আমি’, ‘শীতের বনে’, ‘গানের ভিতর দিয়ে’। শ্রোতাদের করতালি তাই শিল্পীর প্রাপ্য।
চার সন্ধ্যার আমেজ
সম্প্রতি চারদিন ধরে অনুষ্ঠিত ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স’-এ রাগেশ্রী খেয়াল ও মাঝখাম্বাজ ঠুমরি শোনালেন অজয় চক্রবর্তী। শেষে মীরার ভজন ও বেগম আখতারের ঠুমরি অঙ্গের বাংলাগান শোনালেন। অয়ন সেনগুপ্তের সেতারে শ্যাম কল্যাণ যথেষ্ট পরিণত। অনিন্দিতা দেবের গাওয়া ঠুমরি, অলীক সেনগুপ্ত ও ওঙ্কার দাদারকরের কন্ঠসঙ্গীত এবং সায়নীর কত্থক উপভোগ্য। শেষ দিনে ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তীর সেতারে আলাপ ও বিলম্বিত আড়া চৌতালে পুরিয়া কল্যাণ, দ্রুত তিনতাল, ঝালা ও তার সঙ্গে পরিমল চক্রবর্তীর তবলা মন ভরিয়ে দেয়। ভাল লাগে পার্থসারথির সরোদে রাগ পটদীপ। উলহাস কোশলকর-এর ভূপালী বাহার ও স্বল্পশ্রুত রাগ পরজ কালিঙ্গড়ার নিবেদনে ছিল পাণ্ডিত্য ও মাধুর্যের মিশেল।
শুধু সুখ-দুঃখ বা প্রেম নয়
আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ বা প্রেম-বিরহই নয় – ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদন, প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ- সব অনুভূতিতেই আমরা আশ্রয় নিই রবিঠাকুরের গানে। এই ভাবধারাটিকে উপজীব্য করেই তানিয়া দাশ নিবেদন করলেন বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত-‘প্রভু আমার, প্রিয় আমার’ ‘আমার ভাঙা পথের’, ‘প্রেমের মিলনদিনে’, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে’ ইত্যাদি। এদিন তানিয়ার নিবেদন হয়ে ওঠে মনোজ্ঞ ও পরিপ্লাবী।
ডাকে যখন আমার দেশ
রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের দেশাত্মবোধক গানগুলি শোনা গেল নীলা মজুমদারের কণ্ঠে। গাথানি থেকে প্রকাশিত ‘ডাকে যখন আমার দেশ’ সংকলনে। রয়েছে ১০টি গান। শিল্পী অপূর্ব মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন ‘বঙ্গ আমার’, ‘মোদের গরব মোদের আশা’। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘এখন আর দেরি নয়’ গানটি শিল্পীর কণ্ঠে অন্য মাত্রা পেয়েছে। এখানেই শিল্পীর সার্থকতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy