জিম মারে। —ফাইল চিত্র।
হুইস্কি আস্বাদ যে শিল্প এবং বিজ্ঞান দুটোই, তা বোঝা গেল— বলছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্তা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী। ‘হুইস্কি গুরু’ জিম মারের ‘হুইস্কি শিক্ষার আসর’ তখন সবে শেষ হয়েছে। হুইস্কিতে বুঁদ হওয়া কনকনে ঠান্ডা আর কোথায় পাবে কলকাতা। তবে দক্ষিণ কলকাতার পাঁচতারা হোটেলের ঝিলপাড়ে মোলায়েম বসন্ত সন্ধ্যার আমেজটিও মন্দ ছিল না।
তিন দশক ধরে এ দেশে আসছেন জিম। নামজাদা সব হুইস্কি ডিস্টিলারির বিবর্তন দেখেছেন। কিন্তু কলকাতায় এই প্রথম। বছর, বছর প্রকাশিত তাঁর হুইস্কি বাইবেলের জন্য অন্তত ৪৫০০ হুইস্কির মান চেখে জরিপ করেন মারে। রথী-মহারথীদের বিষয়ে যা মন চায় লেখেন। মধ্য ষাটের দুর্মুখ ব্রিটিশের কথায় খেপলেও কেউ তাঁকে অস্বীকার করতে পারেন না। নামী, দামি কত ব্র্যান্ড জিমকে উপদেষ্টা হিসেবে পেতে পাগল। তবে পেশাদার স্বাদ-সন্ধানীর হুইস্কিময় জীবনও উঁচু জাতের স্কচ হুইস্কির মতো ‘স্মুদ’ বলা যায় না।
প্রেমে পড়া বারণ
জিম বলছিলেন, “আমার বরাতে কিন্তু আপনাদের বিরিয়ানি-টানি চাখার সুযোগ হয়নি। হুইস্কি টেস্টিংয়ের দিনে প্রায় না-খেয়ে থাকি! আজ পাতি চিজ় চিকেন স্যান্ডউইচ, জলটল খেয়ে আছি। উটকো স্বাদে জিভকে ক্লান্ত করা চলবে না। নাকে সিগারেটের ধোঁয়া ঢুকলেও বিপদ।” তাঁর হৃদয়রাজ্যে হুইস্কি একেশ্বরী। আর কাউকে এক ছটাকও ভালবাসার ভাগ দেবে না। জিম শোনালেন, ২০২২-এ কোভিডে ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে হুইস্কি মূল্যায়নের কাজে কয়েক হাজার পাউন্ড খেসারত দেন তিনি। হুইস্কি বাইবেলও পরের বছর দু’মাস বাদে বেরোয়। হুইস্কির গন্ধে গন্ধে বিশ্ব ভ্রমণে এই মুহূর্তে প্রেমও নেই জিমের জীবনে। বললেন, “প্রেম, ভালবাসার জন্য একটু থিতু হওয়া লাগে। তার উপরে আমি তো চুমু খেতেও ভয় পাই। কার থেকে কী ঠান্ডা লেগে, নাক বন্ধ হয়ে গেল।” জিমের মতে, হাজারো হুইস্কির স্বাদের মোচড় খুঁটিয়ে বুঝে তার উন্মোচনেই জীবনের এ কৃচ্ছ্রসাধন। সব চুম্বন হুইস্কির পেয়ালার জন্যই গচ্ছিত রেখেছেন জিম মারে।
ব্যাকরণ মানি না
টেবিলে সাজানো সাত রকমের উৎকর্ষ তরলের গ্লাস। সিঙ্গল মল্ট বা ব্লেন্ডেড হুইস্কি। পেয়ালা ধরা থেকে ঘ্রাণ নেওয়ার কসরত ধরে ধরে শেখালেন জিম। জিমের দাওয়াই, হাতের তেলোয় গ্লাসটা চেপে উত্তাপ ছড়ান। পদার্থবিদ্যার সোজা নিয়ম, হুইস্কির মলিকিউলগুলো আরও ছড়িয়ে যাবে। তাতে স্বাদ-সুরভির বিস্ফোরণ। জল দিলেই জিমের মতে, হুইস্কির স্বাদ তেতো হয়। হুইস্কি তেল ছাড়ে। চুমুকের সময়ে মুখে সেই তেলের ধাক্কা। হুইস্কিতে বরফও উৎপাত। তা ছাড়া জল মিশলে হুইস্কির ফিনিশ বা জিভে স্বাদরেশ চুমুকের পরেই উবে যাবে। জিম বললেন, “জানেন, হুইস্কি ও খাবার নিয়ে টিভি শোয়ের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছি। ওরা অনেক টাকা দিত! কিন্তু হুইস্কির সঙ্গে কোনও খাবারই যায় না।” দ্য ক্যালকাটা মল্ট অ্যান্ড স্পিরিট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় পরে বলছিলেন, “আমরা হুইস্কির আধ পেগের শেষটুকু সামান্য জল ছিটিয়ে খাই। হুইস্কির সঙ্গে মিলিয়ে এক পদ খাবারও খাওয়া হয়! জিমের শৈলী শেখার মতো! তবে ওঁর কসরত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার ধাঁচের। সামাজিক সংস্কৃতির বিষয়টা আলাদা। আমাদের আবহাওয়াও অন্য রকম।”
জিমের সরস হুইস্কি-বন্দনায় তবু অনেকেই মুগ্ধ। হাতের তেলোর উত্তাপে চুমুকে চুমুকে হুইস্কি চরিত্র পাল্টায়। গন্ধে, স্বাদে, স্পর্শে হালকা, মিষ্টি বা ধোঁয়াগন্ধী নানা কিসিমের হুইস্কির সঙ্গে জিম ভাব-ভালবাসা শেখান। এই ক্লাসের মনোযোগী ছাত্রী, কফি, ওয়াইনপ্রেমী শিল্পা চক্রবর্তী বললেন, “আমি এত দিন নাগাড়ে হুইস্কি পান বড্ড উগ্র ভাবতাম। আজ বুঝেছি, ওয়াইনের মতো নানা হুইস্কিরও আলাদা ব্যক্তিত্ব।” জিমের স্বাদ-পাঠশালার নিয়ম মেনে, সাতটি হুইস্কির পাঁচটিই থু-থু করে ফেলে দিতে হল। জিম বললেন, "সাত রকম এক সঙ্গে চাখলে নেশায় স্বাদই পাবেন না। হুইস্কি বাইবেলের জন্য দিনে গোটা কুড়ি হুইস্কি আস্বাদের সময়ে আমিও তাই করি। গন্ধে, স্পর্শে বোঝাটাই আসল।"
মেয়েদের শত্রু
সাংবাদিকতা ছেড়ে ১৯৯০ থেকে একনিষ্ঠ হুইস্কি লেখক জিম। তবে তাঁর লেখা বার বার 'সেক্সিস্ট' তকমা পেয়েছে। পছন্দের পানীয় আস্বাদ কোনও মধ্যযৌবনা নারী সম্ভোগের সঙ্গে তুলনা করা নিয়ে সমালোচকেরা মুখর হয়েছেন। বিষয়টি পাড়তে জিম বললেন, “আমি বরাবর ডিস্টিলারিতে মহিলা ব্লেন্ডারদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে বলেছি। হুইস্কির বিজ্ঞাপনে নারীদেহের অমর্যাদাকর ছবির প্রতিবাদ করেছি।” জিভে হুইস্কির স্পর্শ নিয়ে কাটাছেঁড়া করেন জিম। তাঁর কথায়, “স্পর্শ ছাড়া হুইস্কিকে বোঝা যাবে না। আর স্পর্শে যৌন অনুষঙ্গ থাকতেই পারে! তা নারী বিদ্বেষ হবে কোন দুঃখে!”
জগৎসভায় ভারত
জিমের বাইবেলে জাপান বা কানাডার হুইস্কিও শিরোপা পেয়েছে। ২০১০ সালে অম্রুত ফিউশন সিঙ্গল মল্টকে বিশ্বের তৃতীয় সেরা হুইস্কির মর্যাদা দেন তিনি। সেটাই বিশ্ব মানচিত্রে ভারতীয় সিঙ্গল মল্টের আত্মপ্রকাশের যুগারম্ভ! জিম বলেন, “শুধু অম্রুত বা পল জন নয়, গর্ব করার মতো বিশ্বমানের ভারতীয় সিঙ্গল মল্ট আরও অনেক আছে।” শুভাশিসের মতো হুইস্কি রসিকের অবশ্য একটু সংশয়ও আছে। এ দেশে সিঙ্গল মল্টের বোতলে বয়স লেখার আইন নেই। কারণ বেঙ্গালুরুর ডিস্টিলারিতে স্কটল্যান্ডের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি বাষ্পায়ন হয় হুইস্কির। এখানে হুইস্কি ঢের দ্রুত পরিণতি পায়। জিম বলছিলেন, ১৫ বছর বয়সি স্কচও কোনও কোনও চার বছর বয়সি ভারতীয় সিঙ্গল মল্টের তুলনায় আনকোরা। কিন্তু শুভাশিসের মত, “বয়স না লেখা সিঙ্গল মল্টে কিছু ক্ষেত্রে হতাশও হয়েছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy