Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Subhash Mukhopadhyay

তিনি ছিলেন ভারতের পাবলো নেরুদা

কখনও ভোপালের পুকুরপাড়ে, কখনও পাঁচতারা হোটেলের ভোজে, কখনও বা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কাছ থেকে দেখার স্মৃতিরোমন্থন করলেনকখনও ভোপালের পুকুরপাড়ে, কখনও পাঁচতারা হোটেলের ভোজে, কখনও বা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কাছ থেকে দেখার স্মৃতিরোমন্থন করলেন

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সুবোধ সরকার
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

এন্ট্রি ১

তিরিশ বছর আগে ভোপালের ‘ভারতভবন’। ভারতের শিল্প সাহিত্য নিয়ে গড়ে উঠেছে একটা ‘মাল্টি আর্টস কমপ্লেক্স’, এক অপূর্ব স্থাপত্য। বানিয়েছেন ভুবনবিখ্যাত স্থপতি চার্লস কোরিয়া। সিঁড়ি নেমে গিয়েছে ভারতভবনের সিংহদুয়ার থেকে। নামতে নামতে একটা সমতল। বাঁ দিকে করমণ্ডলম, তার পর নাটকের রেপার্টরি, তার পর এ পাশে বাগর্থ, ভারতীয় সাহিত্যের বিশেষ করে ভারতীয় কবিতার দলিলঘর, জ্ঞান চর্চার উপাসনাগৃহ, তার পর একটা বিশাল আর্ট গ্যালারি— স্বামীনাথন থেকে গণেশ পাইন, তার পিছনে ভারতীয় সঙ্গীতের আকাশ। সারা ভারতের কবিরা সে দিন জড়ো হয়েছেন আরও অনেক সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা পুকুরপাড়ে। ভোপালের লোকেরা যাকে বলেন ‘বড়ে তালাও’। সেই পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তাঁর পিছনে জল ও আকাশ। তাঁর সামনে ভারতের কুড়িটি ভাষার শতাধিক কবি এবং এশিয়া মহাদেশ থেকে আমন্ত্রিত কবিরা। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংহ এসে দাঁড়ালেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে ‘কবির সম্মান’ তুলে দেবেন। বাংলা কবিতার জন্য এ রকম একটা মুহূর্ত গত তিরিশ বছরে ভারতের আর কোথাও দ্বিতীয় বার তৈরি হয়নি। জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অনেক বড় পুরস্কার, কিন্তু সে দিন ‘কবির সম্মান’ উপলক্ষে যে আয়োজন হয়েছিল, তা ইতিহাসে এক
বারই ঘটেছে।

কেন এক বার? তার পিছনে একটা গ্লোবাল রাজনীতি ছিল। সারা পৃথিবীর চোখ তখন ভোপালের গ্যাস ট্র্যাজেডির দিকে। হাজার হাজার গরিব মানুষ বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছেন। ব্রিটিশ কবি স্যর স্টিফেন স্পেন্ডারকে একঝাঁক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘যখন গরিব মানুষ মারা যাচ্ছেন, তখন আপনারা কবিতা নিয়ে মহোৎসব করছেন! টাকাটা তো গরিবের ঘরে
যেতে পারত?’’

স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে অংশ নেওয়া স্পেন্ডার তেতে উঠে উত্তর দিলেন, ‘‘এখনই তো সময় কবিতার! কী বললেন, টাকা? সংস্কৃতির জন্য সব সরকারের আলাদা ফান্ড থাকে। সেটা টোটাল বাজেটের ওয়ান পার্সেন্টও নয়। যাঁরা গ্যাস ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী, তাঁদের বলুন! ইউনিয়ন কার্বাইডকে টাকা দিতে বলুন! কবিদের বলছেন কেন? কবিরা আপনাদের সব সময়ের টার্গেট, তাই না?’’

সুভাষদা মুখে একটা বাদাম দিতে দিতে অর্জুন সিংহের দেওয়া নৈশভোজে আমাকে আস্তে আস্তে বললেন, ‘‘জানো তো, আমরা হলাম নরম মাটি। আঁচড়ানো সোজা।’’ অনেক আগেই শুরু হয়েছিল সুভাষদার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের বিষ-মেশানো তরজা। সুভাষদার হাতে সম্মান তুলে দিচ্ছেন অর্জুন সিংহ, সেই ছবি ঘি ঢেলে দিল আগুনে। দ্বিতীয় একটা বাদাম মুখে দিতে দিতে সুভাষদা বললেন, ‘‘তোমরা তালাওয়ের জলটা দেখেছ? কী সুন্দর, রাতের আঁধারেও চকচক করছিল।’’ এই হল সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি জানেন, কলকাতায় ওরা ছিঁড়ে খাচ্ছে তখন। কিন্তু কী সহজে তৃতীয় আর একটা বাদাম তুলে নিলেন ঠোঁটে। আমরা তখন গোল হয়ে বসে আছি সুভাষদাকে ঘিরে। আমরা মানে ভারতের একঝাঁক তরুণ কবি—কন্নড় ভাষার শিবপ্রকাশ, তামিলের রাজারাম, হিন্দি থেকে ধ্রুব শুক্ল, মালয়ালমের চুল্লিকাড়। একজন উঠে দাঁড়িয়ে আবেগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘‘আপনিই ভারতের প্রথম ও শেষ পাবলো নেরুদা।’’ যে ভাবে নারকেল গাছ মাটিতে পড়ে, ঠিক সে ভাবেই সে মাটিতে পড়ে গেল। অনেকটা মদ খেয়ে ফেলেছিল বেচারা, তবু সুভাষদাকে চোখে দেখার পর সে আত্মহারা সে দিন! এই তরুণ কবির নাম আমি বলব না— সে এখন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর।

এন্ট্রি ২

একাধিক বার জেলে গিয়েছেন সুভাষদা। স্বাধীনতার পরে এ রকম সৌভাগ্য কোনও বাঙালি কবির কপালে আর জোটেনি। নকশাল আন্দোলনের সময়ে কিংবা ইমার্জেন্সির সময়ে কেউ জেল খেটেছেন। তবে তাঁরা কেউ সুভাষ মুখোপাধ্যায় নন। আমাকে চিলির কবি নিকানর পাররা বলেছিলেন, ‘জেল না খাটলে সে আবার কবি নাকি?’ পাররা কখনও জেলে যাননি। আর সে দেশেরই রাউল সুরিতা বলেছিলেন, ‘জেলের দেওয়াল কবিতাকে শেষ করে দেয়।’ কী আশ্চর্য, সুরিতা পিনোশেতের অত্যাচার সহ্য করে জেলে গিয়েছিলেন। জেলে থাকাকালীন (যে সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ) সাধারণ দু’জন বন্দি বলেছিলেন, ‘আপনি আর লেখেন না কেন? আপনার লেখা পড়ে রাস্তায় নেমেছি, আপনার লেখা পড়েই তো জেলে এলাম।’ আমার মনে হয়, কোনও কবিরই এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি হতে পারে না।

‘টোটো কম্পানি’তে লিখছেন, ‘‘যখন জেলে গেলাম, মনে হল সেও এক ভ্রমণ... দড়িচালী থেকে ঘানিঘর ঘুরে ঘুরে দেখা। মানুষগুলো প্রত্যেকেই যেন রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের বই। পড়ে শেষ করা যায় না। মামলা থাকলে জাল দেওয়া গাড়িতে রাস্তা দেখতে দেখতে কোর্টে পৌঁছনো। ভ্রমণ বৈকি। রীতিমতো ভ্রমণ। তার ওপর আছে এক জেল থেকে অন্য জেলে যাওয়া। শুনলে অনেকে হিংসে করবে। জেলে থাকার সুবাদেই আমার জীবনে প্রথম এরোপ্লেন চড়া।’’ হাজতবাসকে এত সহজ করে নিতে পারে কেউ? যে সব তরুণ কবি আজকাল কথায় কথায় ডিপ্রেশনে চলে যান, তাঁরা সুভাষদার জেলজীবন পড়ে দেখলে তাঁদের আর ঘুমের বড়ি খেতে হবে না।

এন্ট্রি ৩

শহরের এক পাঁচতারা হোটেলে একটি অনুষ্ঠানের পর সুভাষদাকে আশ্চর্য ভূমিকায় দেখেছিলাম। টেবিলে টেবিলে অফুরন্ত খাবার। তিনি নিজে একটি খাবারও মুখে দিলেন না। অথচ ঘুরে ঘুরে রুমালে তুলে নিলেন মাছের চপ আর মাংসের টুকরো। আমার এক বন্ধু সুভাষদার কাছে গিয়ে খুব জোরে জোরে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন (জোরে, কেননা তিনি তখন বাঁ কানে প্রায় কিছুই শুনতে পেতেন না)। সুভাষদা আন্দাজেই উত্তর দিলেন, ‘‘ওরা বসে আছে না খেয়ে, আমি বাড়িতে গেলে ওরা একটু খেতে পাবে।’’ এই ওরা কারা?
ওরা হল ধুলো আর বালি। দুই বেড়ালের নাম।

এন্ট্রি ৪

রবীন্দ্রনাথের যেমন বোলপুর, তারাশঙ্করের যেমন লাভপুর, বিভূতিভূষণের বনগাঁ, সতীনাথের পূর্ণিয়া (সতীনাথ ভাদুড়ির সঙ্গে সুভাষদার দু’জায়গায় মিল—জেল খেটেছেন দু’বার এবং রাজনৈতিক মত পাল্টেছেন), জীবনানন্দের বরিশাল, হেমিংওয়ের হাভানা, কনরাডের মালয়দ্বীপ, গ্রাহাম গ্রিনের আফ্রিকা— তেমনই হল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বজবজ। এই বজবজ থেকে তিনি একটার পর একটা কবিতা পেয়েছেন। বজবজ তাঁর জীবনে একটা বিরাট স্থান করে নিয়েছে। কত মানুষ তাঁর জীবনে এসেছে, মানুষের পিছনে পিছনে এসেছে কবিতা।

বজবজ ছিল তাঁর নিঃশ্বাস। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি তিনি ছিলেন চটকলের শ্রমিকদের সঙ্গে। এরাই ছিল তাঁর কবিতার আত্মা। লোথার লুৎসেকে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমি জেলখানায় কিছু লিখিনি। বরং আন্দোলন করেছি, রাজনীতি পড়েছি। কিন্তু লেখা আমি শুরু করলাম এর পর জেল থেকে বেরিয়ে— যখন চটকল শ্রমিকদের গ্রামে গিয়ে থাকলাম। শ্রমিক আন্দোলন করতে করতেই আমার চারপাশের জীবন আমাকে লেখার দিকে ঠেলে দিল।’’

কলকাতা ছিল তাঁর কবিতার ত্বক। রাজনীতি ছিল তাঁর কবিতার হাড়মাস। রাজনীতি তাঁকে যেমন দিয়েছিল, তেমনই তাঁকে নিয়েছিল। এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে থেকেও সুভাষ মুখোপাধ্যায় আকাশের কবিতা লিখতে পারতেন। মুখ থুবড়ে পড়তে তো হয়ই, কিন্তু ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানোর নাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

এন্ট্রি ৫

আমরা তখন থাকতাম লেক গার্ডেন্সে। ফোন ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ সন্ধেবেলায় গিয়ে দাঁড়াতাম সুভাষদার কাছে। সুভাষদা তখন একটা ছোট টাইপরাইটারে একটা করে লাইন লিখতেন, তার পর সেটাকে টাইপরাইটার থেকে খুলে গোল্লা করে মেঝেতে ছুড়ে ফেলতেন। সারা ঘরে ছড়িয়ে থাকত, উড়ে বেড়াত গোলা পাকানো লাইন। বিড়াল গোলাগুলো নিয়ে খেলে বেড়াত। সে কথাও তাঁর কবিতায় আছে। গীতাদি (সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী) মজা করে হাসতে হাসতে বলতেন— ‘‘এই দ্যাখো, তোমাদের সুভাষদা গড়াগড়ি খাচ্ছেন।’’ বহু দিন কোনও কথা না বলে বসে থেকেছি। কথা প্রায় বলতেনই না। তাঁর উপর নেমে আসা খড়্গ আমি দেখতে পেতাম। তিনি নিজের মুখে কোনও দিন বলেননি।

এন্ট্রি ৬

নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে সে বার গিয়েছি। ওঁরা বললেন, ভারতবিখ্যাত এক জন বাঙালি কবিকে আমরা ডেকেছি, সঙ্গে এক জন নবীন কবি। সুভাষদার সঙ্গে আমাকে ডাকার কোনও কারণ ছিল না। কিংবা একটা কারণ ছিল বটে। সে সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল, নাম ‘রূপম’। কবিতাটি ফোটোকপি করে হস্টেলের দরজায় দরজায় টাঙানো হয়েছিল। সেই গল্প ছাত্র আর মাস্টারমশাইদের মুখে শুনে মনে হল, এ জন্যই আমায় ডেকেছে।

দুপুরবেলা সুভাষদা কবিতা পড়তে শুরু করলেন। কী সব কবিতা! পাগল বাবর আলির চোখের মতো আকাশ (সালেমানের মা), মিছিলের মুখ, কুকুরের মাংস কুকুর খায় না, ভেঙো নাকো শুধু ভাঙা নয়, ফুল ফুটুক না ফুটুক, ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমি যত দূরেই যাই, ঘোড়ার চাল (ঘোড়াগুলো বাঘের মতো খেলছে), ছেলে গেছে বনে, কাল মধুমাস (ওঁর দীর্ঘতম কবিতা)। প্রতিটা কবিতাই ইতিহাস! সারা গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। জানালার শিক ধরে ছেলেমেয়েরা কবিতা শুনছিল। এক-একটা লাইন বলছিলেন আর চাপা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছিল হলঘর। আর আমি ভাবছিলাম, এর পরে আমাকে কবিতা পড়তে হবে, ধরণী দ্বিধা হও! কিন্তু বাংলা কবিতার অভিভাবক অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদার, সে দিনের সভাপতি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন সাহস দিয়ে, স্নেহ দিয়ে। রাতের বেলায় গেস্ট হাউসে সুভাষদার সঙ্গে কত গল্প! আমি প্রথমেই বললাম, আপনি বাসে চড়ে ৩৭ নম্বরে মস্কো যেতেন? একটু হাসলেন। ‘‘হ্যাঁ, আমি একটু বেশি বেশি মস্কো গিয়েছি। তবে শোনো— তোমরা নতুন এসেছ, তোমাদের বলি। রাশিয়াতে চুরি হত, ডাকাতি হত, ধর্ষণ হত। আমি সেগুলো লিখতে পারিনি, আমাকে লিখতে দেয়নি ওরা।’’ আমি বললাম, কারা দেয়নি? ‘‘এই আমাদের পাড়ার স্তালিনগুলো। তবে শোনো, রাশিয়ার একটা জিনিস খুব ভাল। তার নাম ভদকা। লেক মার্কেট থেকে আমি ছোট ছোট আলু কিনি। কম দাম। মার্বেলের মতো ছোট। ওগুলো সেদ্ধ করে নুন-মরিচ দিয়ে খেতে খুব ভাল লাগে। সঙ্গে একটু ভদকা। তোমাকে ফিরে গিয়ে বলব।’’ আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম— পরেন একটা ফতুয়া, প্রিয় খাবার আলুসেদ্ধ, পায়ে একটা চপ্পল, লেখেন দুটো কবিতা, ঘুমোন একটা চৌকিতে। অথচ এত আয়োজনহীন একটা মানুষ— তাঁকেও কিনা শুনতে হচ্ছে মদ-মেয়েমানুষের বদনাম!

উত্তরবঙ্গের ওই অসাধারণ আড্ডায় এক বারও কারও নামে নিন্দে করেননি। ‘পাড়ার স্তালিন’রা তাঁকে ছিঁড়ে খাচ্ছে তখন। তবুও মুখ খোলেননি। দুটো ছোট আক্ষেপ তিনি করেছিলেন অবশ্য, ‘‘শক্তিকে (কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়) বলেছিলাম, ‘শক্তি, অনেক দিন বাঁচতে হবে, না হলে জ্ঞানপীঠ পাবে না।’ শক্তি আমার কথা শোনেনি।’’ ওঁর দ্বিতীয় আক্ষেপটি বড় তিক্তমধুর, ‘‘নীরেনের (কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) কবিতা আমার খুব ভাল লাগে, সেটা আমি কাউকে বলতে পারিনি। বললে ওরা আমার দিকে খারাপ চোখে তাকাত।’’

এন্ট্রি ৭

আমি পরের দিন সকালেই কলকাতায় ফিরে আসি। দুপুরবেলা খবর পেলাম, তিনি গেস্ট হাউসে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছেন। আঁতকে উঠলাম। উনি তো পা দিয়ে কবিতা লিখতেন। মানে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে না বেড়ালে উনি লিখতে পারতেন না। তা-ই হল। এর পর সুভাষদার লেখা কমে গেল।

এন্ট্রি ৮

এত অনুবাদ করেছেন, ভাবা যায় না। বুদ্ধদেব বসু অনুবাদক হিসেবে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। তিনি বাংলায় ইউরোপ নিয়ে এসেছেন, উজ্জয়িনী নিয়ে এসেছেন, রাশিয়া নিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনের ৬০০ পৃষ্ঠা দিয়েছেন অনুবাদের জন্য। অসামান্য অনুবাদ করেছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু কারও অনুবাদ মুখে মুখে ঘোরেনি— যেমন নাজিম হিকমতের ‘জেলখানার চিঠি’ কিংবা পাবলো নেরুদার কবিতা, ফয়েজের কবিতা, গাথাসপ্তশতী, চর্যাপদ, অমরুশতক... কী অনুবাদ করেননি! অনুবাদ না করলে এক জন কবির হাত পবিত্র হয় না, সেটা বিশ্বাস করতেন সুভাষদা।

এন্ট্রি ৯

যে দিন চলে গেলেন, সে দিন ওঁরা কেউ এলেন না। ওঁরা মানে ওঁরা। যাঁরা সুভাষদার রাজনীতি করে বড় হয়েছেন, মিছিল করেছেন, রাস্তায় নেমেছেন, পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা এলেন না। শ্মশানে মাত্র কয়েক জন। ভাবা যায় না। সবচেয়ে জনসমাদৃত একজন আধুনিক কবি ঢুকে গেলেন চুল্লিতে।

এন্ট্রি ১০

তবে যে নাজিম হিকমতকে তিনি বাঙালি ঘরে বসিয়ে গেলেন, যে নেরুদাকে তিনি ডাল মাখা ভাতের পাশে রেখে গেলেন, যে ফয়েজকে তিনি লাহৌর লখনউ থেকে কলকাতার গলিতে রেখে গেলেন, এ রকম একটা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে গেলেন— তাঁকে কে কোথায় কোন তামিলে, কোন মরাঠিতে, কোন স্প্যানিশে, কোন ফরাসিতে তুলে আনলেন? আজ পর্যন্ত সুভাষ মুখোপাধ্যায় বড় করে ইউরোপ এশিয়া আমেরিকায় পৌঁছতে পারেননি। সেটা ২৫ কোটি বাঙালির দুর্ভাগ্য। দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমার বিনীত প্রশ্ন— আপনাদের পোস্ট কলোনিয়াল প্যাকেজে কি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামটা তোলা যায় না?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy