সোমনাথ হোরের শতবর্ষ উপলক্ষে ইমামি আর্টসে আয়োজিত প্রদর্শনী দেখার পরে মনে হয়, এই চমৎকার অভিজ্ঞতা চাক্ষুষ করা যেন সার্থক। তাঁর বিশাল কর্মজীবনের সব অংশ কোনও না কোনও ভাবে পেশ করা হয়েছে প্রদর্শনীতে। ঠিক লিনিয়ার ফরম্যাট বা একমাত্রিক ভাবে হয়তো সাজানো নয়, অনেক সময়ে এ দিক-ও দিক করেই দেখানো। কিন্তু পুরো উপস্থাপনাটি অত্যন্ত উপভোগ্য হয়েছে। এই প্রদর্শনীটি কে এস রাধাকৃষ্ণণ যে ভাবে সুসংহত রূপ দিয়েছেন, নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করে এত জিনিস আমাদের উপহার দিয়েছেন একসঙ্গে, তাতে তাঁর অভিনন্দন প্রাপ্য।
সোমনাথ হোর ১৯২১ সালে জন্মেছিলেন অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। অল্প বয়সেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের সংগঠিত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৬ সালে এই বাংলায় আর পাঁচটা সৃষ্টিশীল মানুষের মতো তেভাগা আন্দোলন তাঁকেও সাংঘাতিক ভাবে নাড়া দেয়। ১৯৪৭-এ চা বাগানের শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গেও উনি যুক্ত ছিলেন। এ কথা উল্লেখ্য যে, শিল্পী সোমনাথ হোর বামপন্থী সংগঠিত আন্দোলনের সঙ্গে খুব বেশি দিন জুড়ে থাকেননি। কিন্তু প্রায় পুরো জীবনই তিনি অবহেলিত মানুষের কথা বলেছেন তাঁর ছবিতে, প্রিন্টে, যাবতীয় কাজেই। কোনও শিল্পীর পক্ষেই এত রকমের মিডিয়ামে এত বিচিত্র ও বিবিধ রূপ দেখানো যে সম্ভব, তা কষ্টকল্পিত। সোমনাথের সারা জীবনের কাজের ভাষা কিন্তু একই থেকেছে। সেটি হচ্ছে মানুষের যন্ত্রণার ভাষা।
প্রিন্ট মেকিং-এ উৎসাহ শিল্পীর খুব অল্প বয়স থেকেই। পরে ভারতীয় আর্ট কলেজে প্রিন্টমেকিং ডিপার্টমেন্ট ওঁরই সৃষ্টি। কাঠ, ধাতু, পাথর, লিনোলিয়াম শিট ইত্যাদি জিনিসের উপরে নানা পদ্ধতিতে বিভিন্ন রকম ডিজ়াইন ফেলে সেখান থেকে ছাপ নেওয়াকে প্রিন্টমেকিং বলে। এই প্রদর্শনীতে শিল্পীর প্রথম জীবনের করা কিছু উডকাট আছে, যার মধ্যে বিখ্যাত দু’টি কাজ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ‘রাতে খুলি বৈঠক’ এবং ‘বুধিয়া বর্মনের মা’ কাজ দু’টি ১৯৪৬ সালে করা। প্রদর্শনীতে শিল্পী সোমনাথ হোরের মৌলিক পেন এবং ইঙ্কের ড্রয়িং অন্তত ৭০ থেকে ৭২টি আছে। প্রদর্শনীতে ঢুকতেই ডিজিটাল কাজ অন্তত ২৫০টির মতো রয়েছে। সেখানেই চোখে পড়ে শিল্পীর আঁকা দু’টি রঙিন ক্যানভাস। মূল ছবি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু খুব ভাল ডিজিটাল প্রিন্ট। এগুলির মধ্যে ‘মুরগি বিক্রেতা’ অসামান্য ছবি। কত কম কাজে মানুষের চরিত্র ধরে ফেলা সম্ভব তারই এক অনবদ্য প্রতীক এই কাজ। এটি ১৯৫৭ সালের কাজ।
সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে হরেন দাসের কাছ থেকে গ্রাফিক্স শেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। প্রধানত লিথোগ্রাফ এবং ইন্টাগ্লিয়োতে কাজ করার সমস্ত পদ্ধতি আর্ট কলেজেই শিখে ফেলেন। ১৯৫০ সালে দেশের প্রধান প্রিন্ট-মেকার হিসেবে নাম করেছিলেন। কলাভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ দিনকর কৌশিক শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন সোমনাথ হোরকে, গ্রাফিক এবং প্রিন্ট-মেকিং বিভাগের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।
সত্তরের দশকে ভাস্কর্যে মনোনিবেশ করেন সোমনাথ। দশ আঙুলে করা এই ব্রোঞ্জ ফিগারগুলি প্রধানত যুদ্ধ এবং মন্বন্তরের আয়না। শিল্পী এগুলিকে ভাস্কর্য বলেননি। তিনি বলতেন, এগুলি তার ‘ব্রোঞ্জ’। শিল্পীর কথায়, ‘‘আমি এগুলিকে ভাস্কর্য বলতে পারি না, কারণ এগুলির কোনও ওজন নেই, আয়তন নেই, মাত্রা নেই। এদের মধ্যে আছে শুধু আঘাতের কথা। এগুলির ভিতর দিয়ে খোলামেলা হাওয়া যাতায়াত করতে পারে। সেই জন্য আমি এগুলোকে শুধুমাত্র ব্রোঞ্জ বলি।’’
ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর হাতেগড়া মা এবং সন্তানের ভাস্কর্যটি খুবই অন্য রকম। এই মায়ের শরীরে কোনও লালিত্য নেই, মাধুর্য নেই। মায়ের বুকে আছড়ে পড়েছে শিশু। কিন্তু এই মায়ের বুক নেই, বোমায় উড়ে গিয়েছে মায়ের শরীরের উপরের অংশ। কিন্তু শিশু তা জানে না। এর সাংঘাতিক প্রভাব দর্শকের গভীরেও ছাপ ফেলে। ভাস্কর্যটি তাঁর স্টুডিয়ো থেকেই কোনও সময় চুরি হয়ে গিয়েছিল। সেটি আর কোনও দিন উদ্ধার করা যায়নি। কিউরেটর রাধাকৃষ্ণণের কথায়, শিল্পী সোমনাথ ওই কাজটি চুরি যাওয়ার পরে প্রায় ৭-৮ বছর ভাস্কর্য সৃষ্টি করাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কোনও ছাত্র সেই সময়ে কাজটির ছবি তুলে রাখায় তা এখন দেখার সুযোগ মিলছে।
সবশেষে বলতে হয়, শিল্পীর সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘উন্ডস’ নামের সিরিজ়টি। এই ধরনের অ্যাবস্ট্রাকশন বা বিমূ্র্তকরণ অত্যন্ত কঠিন কাজ। এখানে আছে মানুষের স্বাধীনসত্তার চরম বিপর্যয়। শিল্পী বলেছেন, “কিছু কথা আমি কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় বলি না। কিছু কাজ আমি নিজের ইচ্ছে মতো করি না। সেগুলি আমার ভিতরের এক গুপ্ত জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে, যা আমার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’’ কিন্তু সেখানেও তিনি তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র মানবিকতাকে ছাড়েননি।
একাধারে পেন্টার, স্কাল্পটর, মিউরালিস্ট এবং অসামান্য প্রিন্ট-মেকার ছিলেন সোমনাথ হোর। আধুনিকতার প্রতিমূর্তি এই শিল্পীর পরীক্ষানিরীক্ষার বিপুল বৈচিত্র প্রদর্শনীটি না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। চিত্রশিল্পের গুণগ্রাহী যে কোনও ব্যক্তিকেই এই প্রদর্শনী সমৃদ্ধ করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy