ছবি: কুনাল বর্মণ।
বহু দূর থেকে, ইতিহাসের পাতার দূরসীমা থেকে ভেসে আসছে সুর। দেখতে পাচ্ছি না! বহু অতীত থেকে, স্মৃতিপল্লবের মায়ার মতো ভেসে আসছে রং। শুনতে পাচ্ছি না! কিন্তু সে তো না-দেখার, না-শোনারই কথা। সুর কি দেখা যায় নাকি! শোনা যায় নাকি রং?
সত্যিই যায় না? তাই যদি হবে, তবে আমির খসরু কেন গাইছেন ‘আপনি সি রং দিনি রে মোসে নয়না মিলাইকে’? এক পলক তাকিয়েই তুমি কী ভাবে তোমার রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারো আমায়? নয়নে নয়ন মেলালেই কী ভাবে শরমের রং লাগে গালে? এ কি সব তরঙ্গের খেলা? মিশ্র তরঙ্গ? বিপুল তরঙ্গ? যে তরঙ্গ আলো-শ্রুতি-মন মিলিয়ে আসলে অলক্ষ্য এক রং? অকারণের সুখে যা দরগায় বেজে ওঠে, মন্দিরে শ্রীখোলে মাতে, গির্জায় প্রার্থনা-প্রতিমা রচনা করে আর কাছে-দূরে জলে-স্থলে ভালবাসি-ভালবাসি বলে ভেসে বেড়ায়?
নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দৃষ্টিরঞ্জনে আঁকা আমির খসরু। পলাশ যৌবনবাউল বসন্তের প্রতিসরণে। শ্রীচৈতন্যের ডুব নয়নপথগামীর রসসমুদ্রে। তা হলে রং কি সুরেরই অন্য নাম, যাকে শৈশবে পেয়েছি মায়ের গন্ধে, কৈশোরে মহাষ্টমীর অঞ্জলিতে, যৌবনে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে সদ্যপ্রেমের হাত খামচে ধরে আর বার্ধক্যে রোমন্থনে? রং কি তা হলে জন্মান্তরেরই উষ্ণীষ-উপাধি?
আসল নাম আমার তা হলে রং? বলেনি তো কেউ কখনও!
(২)
প্রহ্লাদ-জন্মে পিতৃস্বসা হোলিকার ক্রোড়ে উঠেছিলাম। আমায় পুড়িয়ে মারার জন্য অগ্নিজয়ী তিনি আগুনে প্রবেশ করেছিলেন। বেঁচে গিয়েছিলাম আমি। দগ্ধতা ছিল তাঁরই। তাঁর ক্ষয়ের আনন্দ আমার জয় এনে দিয়েছিল। প্রতিশোধের রং ছড়িয়ে পড়েছিল। বারণ করেছিলাম। পাতাঝরা সেই সোনালি ঋতুর ডালপালারা শোনেনি আমার কথা। উড়ে উড়ে এসে জড়ো হয়েছিল। উৎসব হয়েছিল। আগুনের উৎসব। আনন্দের উৎসব। আকাশ হয়ে উঠেছিল অগ্নিবর্ণ। বিষণ্ণ আমি তখন গঙ্গাতীরের এক জনপদের কথা, নবদ্বীপের কথা ভাবছিলাম।
দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যা। জীবনানন্দের কবিতার মতো অপলক চাঁদ উঠেছিল গগনে। চুয়াচন্দনচর্চিত ঘরে জন্ম হল আমার। বৃন্দাবনি সারংয়ে লাগল তান। সে আমার আর এক রং-জন্ম। সে এক জীবন, আয়ু-উজাড় সেই রং তাড়িয়ে বেড়াল আমায়। টোল থেকে নদীবক্ষে, শ্রীবাস-অঙ্গন থেকে বনান্তে একা শিমুলতলে, অহঙ্কার থেকে বিনয়ে, ভক্তি থেকে বৈরাগ্যে, মৃদঙ্গ থেকে নগরপরিক্রমায়, সংসার থেকে অসংসারে, বস্তু থেকে পরমশূন্যে, মাটি থেকে ইতিহাসে। সে রঙের জাত ছিল না, গোত্র ছিল না, স্পৃশ্যতা ছিল না, ক্লেদ ছিল না, প্রজ্বলন ছিল না। শুধু, ধর্ম ছিল, মানুষের ধর্ম। ক’জন নিল সে রং? ক’জন রঙিন হল বিষ্ণুপ্রিয়ার মতো? শচীমার মতো? জয়দেবের মতো? আউলের মতো, বাউলের মতো, সুফির মতো? জগন্নাথদেবের মতো? রঙের মতো রঙিন হয়ে ওঠা সহজ নয় বোধ হয়। চৈত্রবাতাসের বিরহ-বেহাগে ‘কোন ভুলে এল ভুলি... পুরানো আখরগুলি’!
(৩)
আখরে লেগেছে রং বার বার। আখর উত্তপ্ত হয়েছে, আখর অধৈর্য হয়েছে, আখর উন্মাদ হয়েছে। আখরই স্বয়ং হয়ে উঠেছে রং। দোলাচলের দোলায় কতবার পতন ও মূর্ছা, কতবার গড়িয়ে যাওয়া অনির্দেশের সানুতল বেয়ে! তাই যমুনা-বিপিনে লুকিয়ে দেখা গোপিনীদের স্নান আমারই রং। শ্রীমতীর অঙ্গবস্ত্র খসে পড়ার পিছনে আমারই রং, অপ্রস্তুত মেয়ের লজ্জা নিবারণে রঙের পোশাক তৈয়ার করার পিছনেও রং আমারই তো!
হৃদয়পুর স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যে দিন কেউ ছিল না, সে দিন ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে’। বয়সে কত বড়, আঁকার মাস্টারমশাই হিসেবে কত নাম হয়েছে আমার, তাও লজ্জা পেয়েছিলাম তোমার কিশোরী মুঠোয় হলুদ আবিরের সূর্যোদয় দেখে। সেই গাঢ় দুপুরের কথা মনে আছে? কী অকারণ প্রশ্ন করেছিলাম— কোথা থেকে পেলে এই রং? আর কাকে মাখিয়েছ? জানি তো মাখিয়েছ! কাকে, বলো! হেসেছিলে কী অদ্ভুত করুণায়! চোখ নামিয়ে নিয়েছিলে! আসলে, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, সত্যি ভুলে গিয়েছিলাম, একটু আগেই তো আমরা দু’জনে দু’জন পরস্পরের বুক থেকে মুঠোভরে তুলে নিয়েছিলাম আঁজলা-আঁজলা রং। সিগন্যাল সবুজ ছিল। তখনও আসেনি কোনও ট্রেন। আমাদেরই রং তুলে নিয়েছিলাম আমরা আঁজলাভরে। তোমার রং, আমার রং। সে কথা স্বীকার করায় ফের মুখ তুলেছিলে তুমি, একটু মাথা ঝাঁকিয়ে। চুল থেকে আদরের মাধ্যাকর্ষে ঝরেছিল আবিররেণু দু’জনের নির্জন প্ল্যাটফর্মে। আরও এক দোলের দিন দেখা হয়েছে। এখন তুমি অন্যরকম। লজ্জা যেন বেড়েছে অনেক। বেড়েছে বয়সও। দেখা হয়েছে সেই একই হৃদয়পুরে। সেই একই প্ল্যাটফর্ম। একইরকম নির্জনতায়। অস্ফুট ভাবে প্রশ্ন করেছ, ‘আমাদের গেছে যে দিন/একেবারেই কি গেছে/কিছুই কি নেই বাকি?’ বলেছি— বোধ হয় কিছুই নেই বাকি! আমার কথায় প্রশ্ন ঘনিয়েছে তোমার চোখে। একটু থেমে বলেছি— আমাদের তমালতরুমূল নেই, এসেছে বনসাই! আমাদের পরাগ-রং নেই, এসেছে কালিমার বিভূতি! আমাদের দোল নেই, নেই হোরিখেলাও! ‘কালের যাত্রার ধ্বনি এমনই কি হয়?’ বলেছি— জানি না। কথাও হয়নি আর। ট্রেন ঢুকেছে। ট্রেনে উঠে গিয়েছ তুমি। প্ল্যাটফর্মে নেমেছে গুটিকয় রঙিন মানুষ। তাদের চেনা যাচ্ছে না। একজন কাছে এল। বলল, ‘হ্যাপি হোলি!’ চিনতে পারিনি! বন্ধুজনই বোধ হয়। এক অদৃশ্য বালুঘড়ি ঘনিয়ে এল হৃদয়পুরে, জটিলতার!
(৪)
রং-জন্মে সব চেয়ে বেশি নাজেহাল করেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে। বৃন্দাবনও বোধ হয় এত রং দেখেনি কখনও, এত ঝলসে যায়নি কোনওদিন মাধুর্যে, বিরহে বা প্রেমে। কী না করেছি! কুঁদফুলের মালা পদ্মপাতায় ঢেকে আনতে বলেছি! ডান হাতে পরতে বলেছি রক্তকরবীর মালা! দেহের বীণার তারে তারে জাগাতে বলেছি সোহিনী রাগিণী! এক ফাগুনের মনের কথা সংগোপনে জানিয়েছি অন্য ফাগুনের কানে কানে! পুরনো বিরহের প্রতিশোধে রটিয়েছি কত নবীন মিলনের মধুর কুহক! সে ফল্গু বইয়ে দিয়েছি প্রজন্মস্নায়ুতে।
আনন্দ পেয়েছি! এক পরম নিশ্চিত নিঠুর আনন্দ! তাই বুঝি গৌরপ্রাঙ্গণের দোলসন্ধ্যায় ‘তাসের দেশ’ দেখতে আসা তরুণের হাতে শুকনো অশ্বত্থ পাতার জয়পতাকা গুঁজে দিয়ে ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যায় কলেজকালের বিবাহিত প্রেম। আর তাকে খুঁজতে-খুঁজতে-খুঁজতে কবির সঙ্গে দেখা। কবির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে অপ্রস্তুত এক রাঙা বেদনা। সকালের না-ওঠা রঙের প্রলেপ অবজ্ঞা করে গাল বেয়ে নেমে আসে জলবিন্দু, মোহনা খোঁজে আশ্রয়ের। আশ্রয় পায় উপাসনাগৃহের কাচের জানালায়। সাদা শাড়ির এসরাজের চোখে চোখ চলে যায়। শান্তি নেমে আসে এক চকিতের। পরমুহূর্তে এসরাজের চোখ নেমে যায়। অধৈর্য রাগ হয় তখন! কী ক্ষতি হয় ছড়ের দিকে না-তাকিয়ে বাজালে! এমন কি কোনও বাদ্য নেই এ-গোলকে, যা চোখের আঠায় আপনি বেজে ওঠে?
(৫)
বসন্তের প্রতিষেধক হয় না। যারা বলে হয়, তারা কোনওদিন দিনান্তে গিয়ে দাঁড়িয়েছে স্বচ্ছ নদীর আয়নার সামনে? ঢলে পড়া সূর্যের আভায় দেখেছে নিজেদের মুখ? ধরা পড়েনি সেখানে, বসন্ত এক চিরঞ্জীবী অসুখ? লালদিঘির সামনে দাঁড়ালে আজও আমার মুখের ছায়া পড়ে। চার্নকের সঙ্গীদলের কলরব শুনতে পাই। রং-মাখা নবীনাদের দেখে যারা সেদিন বুঝেই উঠতে পারেনি যে, ওরা সবাই পুরুষ! একই ভাবে ঠকেছে ইতিহাসও! হ্যাঁ, মেটিয়াবুরুজের সেই সুরশৃঙ্গারের কথাই বলছি। বলছি ঘুঙুর পরে মধ্যরাতে একাকী নাচে বুঁদ সেই নির্বাসিত নবাবের কথা। বসন্তের বিশুদ্ধ আচমন জানতেন যিনি। মেটিয়াবুরুজের গা-ঘেঁষে নীলযমুনার জল গড়িয়ে যেতে দেখতেন। নারীর আবরণে-আভরণে দেহ ঝেঁপে বাহার নেমে আসত যাঁর! সেখানে, তাঁর সেই চিরসঙ্গীতময় দরবারে, নির্জনে সোনার পানপাত্রে তিনি পেতেন আমাকেই। কত বসন্তে দখিনসমীরে ভরে উঠেছে তাঁর সাজি! আমারই রঙে। সে রং পান করতে করতে একদিন শেষচৈত্রে তিনি স্বয়ং স্বচ্ছ-বিহ্বল রং হয়ে উঠলেন! উপমহাদেশের সঙ্গীতের রং! তাঁর বসন্ত-নৈহার অক্ষত হয়ে রইল দারা-দ্রিম রঙিন জন্মে।
আমি ফুটে উঠেছিলাম একই ভাবে একদিন শহর কলকেতার এক রাজবাড়িতে। ঝাড়বাতির আলোয় সেদিন তাপ ছিল না তেমন। সব তাপ গিয়ে মিশেছিল শ্বেতপাথরের মেঝেয় পাতা গালিচার উপর। না, ঠিক গালিচার উপর নয়। গালিচার তলায় বিছিয়ে রাখা পুরু আবির-আস্তরে। গালিচার উপর গওহরজান। মূর্ছনায় অন্ধ সব। উন্মীলিত চোখেও অন্ধ! লাবণ্য চুঁইয়ে পড়ছে কণ্ঠ থেকে পদপল্লবে। এক সময় থামলেন সরস্বতী। যে যার মতো বিদায় নিলেন। তোলা হল গালিচা। সেই বসন্তপূর্ণিমায় গালিচার নীচে আমারই মুখ অবিকল ফুটে উঠেছিল! আবিরের আস্তরে আঁকা শতদল! জন্ম-জন্মান্তর ধরে করিছে সে টলমল!
(৬)
রং হিসেবেই আমি দাম পেয়েছিলাম বেদ-পুরাণে, জিশুজন্মের তিন শতাব্দীরও আগের এক পাথরে। স্পেনে টম্যাটো ছোড়ার লা তোমাতিনা উৎসব ক্রুদ্ধতা থেকে আনন্দে উত্তীর্ণ আমারই সূত্রে। গ্রিসে ব্যাকানালিয়ায় সুগন্ধি কামায়োজনে, কামসূত্রের দোলায় মধুযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম আমিই রং হিসেবে। ইদ-ই-গুলাবি উৎসবে পরিচয় হয়েছিল শাহজাহানের সঙ্গে। পাঠক, আপনার হৃদয়, আপনার প্রেম, আপনার আবির-গুলাল, আপনার কস্তুরী-চন্দন, আপনার অভিমান, আপনার রাইকিশোরী-মধুমাধব আমারই কাছে ঋণী। আমি ঠোঁটে এবং গোঠে। বিশ্বাস করুন, আমি অবিনশ্বর। জল আমায় ধারণ করে, ধুতে পারে না। বাতাস আমার বাহক হয়, ওড়াতে পারে না। আগুন আমার বেশ ধারণ করে, পোড়াতে পারে না।
আমি রং। রং অনন্তম্।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy