রঙে-রেখায়: লালুপ্রসাদ সাউের আঁকা ছবি
উপরের ওই তিনটি শব্দ যেন শিল্পী লালুপ্রসাদ সাউয়ের জীবনের ধ্যান এবং জীবনদর্শন। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে ছেলেবেলা কাটেনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা এবং শিল্পশিক্ষা গ্ৰহণ। সনৎ করের কাছে এচিং শেখা এবং তার পরে সত্তরের দশকের অন্যতম এক গ্ৰাফিক শিল্পী হয়ে ওঠা, যিনি আঠারো বছর গ্রাফিকের কাজই করেছেন। শিক্ষকতাও করেছেন, বহু জায়গায় পুরস্কৃত হয়েছেন, তবু শেষ পর্যন্ত তিনি গ্ৰাফিক নিয়ে চলতে পারেননি। সেটা খানিকটা আর্থিক কারণেই, বলেছেন শিল্পী নিজেই। বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের ভিতর দিয়ে বহু পথ চলে শেষে গোয়াশ এবং টেম্পারায় এসে থেমেছেন। তাঁকে ছাপাই ছবি এবং টেম্পারার মাস্টার বলে মনে করা হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সংস্কৃতিকে নিজের কাজে ধরার চেষ্টা করে গিয়েছেন শিল্পী। সেই সব কিছুরই বীজ বপন হয়েছিল ছোটবেলায়। যখন গ্রামে পটুয়াপাড়ায় পটচিত্র এবং মূর্তির চালচিত্র আঁকা হত, সেই সব দেখে দেখে। পরবর্তী কালে শান্তিনিকেতনের মেলা প্রাঙ্গণে পেয়েছিলেন এক ধরনের মানুষের সাক্ষাৎ। ধুতিপরা লোকের পাশে তাঁর আটপৌরে শাড়ি পরা স্ত্রী। এ ছাড়াও কালীঘাটের পটচিত্রের প্রভাবও পড়েছে তাঁর ছবিতে। পটুয়াদের আঁকা বাঙালিবাবুর ছবি সে কালের ‘বাবু কালচার’-এর স্বাক্ষর বহন করে। শিল্পী লালুপ্রসাদও অনেক ছবি এঁকেছেন এই বাবু-বিবিদের নিয়ে। তবে তাঁর কাজ পটচিত্রের চেয়ে অনেক পরিশীলিত।
দেবভাষা গ্যালারিতে শিল্পী লালুপ্রসাদ সাউয়ের সাম্প্রতিক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন প্রবীণ শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রদর্শনীটির নাম, ‘ক্রেয়নস’। কারণ, এখন লালুপ্রসাদ ওই মাধ্যমেই কাজ করছেন। দেবভাষায় শিল্পীর গ্ৰাফিকের কাজ ছিল না। মোট ২৯টি কাজের মধ্যে ২৭টি ক্রেয়নে করা। বাকি দু’টি ক্রেয়ন ও অ্যাক্রিলিকের মিশ্র মাধ্যমের কাজ। এ ছাড়াও শিল্পী সর্বসমক্ষে একটি ছবি এঁকে উপস্থিত দর্শককে চমৎকৃত করেছিলেন প্রদর্শনী চলাকালীন। সেটিও ক্রেয়ন পেনসিলে। একটি ছবি বোর্ডের উপর ক্রেয়নে করা। হাত-আয়নায় এক নারীর প্রতিবিম্ব। কিন্তু আসল মানুষটির দেখা নেই। ছবিটি যেন সেই মানুষটিকে দেখার বাসনা জাগায়। পটের বিবির মতো চেহারা। সুন্দর খোঁপা করা একটি পার্শ্বমুখ। ক্রেয়নের লাল মাটির রঙে বেশ কাজটি।
প্রদর্শনীর অনেক কাজেই উত্তর কলকাতার বনেদি বাঙালির চেহারা ও চরিত্র নিখুঁত ধরা পড়েছে। যেমন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা ধুতি পরা বাঙালিবাবুর ছবি। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, হাতে সম্ভবত একটি ছড়ি, অন্য হাতে একটি সিগারেট, ডান পা’টি বাঁ-পায়ের উপরে তোলা। পায়ের কাছে একটি পোষা কুকুর। প্রদর্শনীর এই ছবিটিও বোর্ডের উপরে ক্রেয়ন এবং ক্রেয়ন পেনসিলে আঁকা। খুবই সুন্দর।
অবন ঠাকুরের ছবি ভালবাসতেন লালুপ্রসাদ। সেই ভাবে ওয়াশ পেন্টিংও শুরু করেছিলেন এবং সেই কাজে মজাও পাচ্ছিলেন। তারপর টেম্পারায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু বুঝলেন যে, টেম্পারার কাজে বেশি মনোযোগ লাগে। কোনও ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনের বিশেষ জায়গা থাকে না, যেটা ওয়াশে করা যায়। এ ছাড়াও অবন ঠাকুর এবং গগন ঠাকুরের লিথোগ্ৰাফ (লাইমস্টোন বা ধাতুর প্লেটের থেকে ছাপা) ভালবাসতেন শিল্পী। আর রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে গেলে কথা শেষই হবে না, বলছিলেন শিল্পী লালুপ্রসাদ। কারণ তাঁর ছবির অতীন্দ্রিয় ভাবের তুলনা হয় না। ওই রহস্যময়তাই রবি ঠাকুরের ছবির প্রধান আকর্ষণ।
এই প্রদর্শনীর প্রধান ছবি শিবের মুখাবয়ব। শিবকে ঠিক ঈশ্বররূপে দেখানো হয়নি এখানে। মাথায় ফুল গোঁজা, জটায় সাপ এবং অর্ধচন্দ্র। চোখের ভাবে আধ্যাত্মিকতা নেই, আছে সম্মোহন। কাঁধটা সোজা হয়ে সরল রেখায় চলে গিয়েছে দু’দিকে। মার্ক রথকোর মতো রেক্ট্যাঙ্গুলার এরিয়া ভাগ করেছেন হয়তো। হিন্দু দেবদেবীর ছবি খুব একটা আঁকেন না শিল্পী। সেই হিসেবে এই ছবির বিশেষত্ব রয়েছে নিশ্চয়ই।
লালুপ্রসাদের ছবিতে কাংড়া পেন্টিং ও মুঘল মিনিয়েচার ছবির কিছু ছাপ হয়তো দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু তার ব্যবহার একেবারেই অন্তরিন। দেবভাষায় প্রদর্শিত ছবিগুলির মধ্যে একটিতে দেখা গেল ফুলদানিতে ফুল, পাশে মধুলোভী এক প্রজাপতি এবং উপর থেকে দর্শনরতা এক মহিলা। প্রজাপতিকে তিনি প্রেমের প্রতীক হিসেবেই দেখেছেন। কিন্তু এখানে আবার ছবির অবয়ব ভেঙেছেন লালুপ্রসাদ। মজার এক জ্যামিতিক বিন্যাস সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম ভাবে ছবির গঠন তিনি বারবার ভেঙেছেন। এ ছাড়া বাবুবিবিদের অনেক ছবিতেই প্রহসন অথবা ব্যঙ্গ দেখতে পাই। লালুপ্রসাদের ছবিতে অদ্ভুত এক মজার উপাদান সব সময়েই দেখা যায়। আর একটি ছবিতে আধুনিকতা এসেছে এক মধ্যবয়সি পুরুষের মুখাবয়বে। পরনে পাঞ্জাবি ও হাতে সিগারেট। সুন্দর প্রতিকৃতি, বাস্তববাদী। ক্রেয়ন ও পেনসিল লাইনের কাজ। আরও একটি ছবিতে চশমা পরা এক আধুনিকার মুখে কাঠিন্য বা কিছুটা আশঙ্কা দেখা যায়। এই দু’টি কাজে তাঁর স্বভাবসুলভ ব্যঙ্গ নেই।
একটি ছবিতে বিড়াল, মুখে মাছ। গঠনে মজা আছে, বাস্তবধর্মী নয়। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন গাছপালা, পশুপাখির ড্রয়িংও করেছেন শিল্পী। এই ছবিটি অবশ্য ২০২২ সালে আঁকা। বোর্ডের উপরে ক্রেয়নের কাজ। শিল্পীর কাজে পরিচয় পাই, তিনি সহজ, সরল, নির্ভেজাল এক মানুষ। ছবি আঁকেনও সহজে, সবল রেখায়, আনন্দমনে। মানুষকে আনন্দ বিতরণের জন্য। তাতেই তাঁর চরম প্রাপ্তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy