আপনি কি গ্রেগ হেফলিকে চেনেন? ছেলেটার বয়স বারো কি তেরো। কাঠির মাথায় আলুরদমের মতো চেহারা। প্রায় নেড়ুমুন্ডু। শুধু অ্যান্টেনার মতো তিন গাছি চুল খাড়া হয়ে থাকে। কালো হাফপ্যান্ট আর হাফহাতা টিশার্ট পরে ঘোরে। রাজ্যের অকাজ করতে তার জুড়ি নেই। আর, নিক্কি জে ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে আলাপ আছে আপনার? টমবয় গোছের বছর চোদ্দোর কিশোরীটি লিপস্টিক নেলপলিশ সাজগোজের ধার ধারে না, হাতে রং পেন্সিল দিলে কামাল করে।
এদের নাম বলে দেখুন বাড়ির খুদে দস্যিটিকে। স্মার্টফোন, ই-গেমস উল্টিয়ে এসে সে আপনাকে তাদের জীবনকাহিনি গড়গড় করে শুনিয়ে দেবে। গ্রেগ-নিক্কিরা ওদের প্রিয় ডায়েরি সিরিজ়গুলোর চরিত্র। বিশ্বজুড়ে শিশুরা এখন গোগ্রাসে গিলছে ‘কিডস ডায়েরি’। লেখকেরা ডায়েরিগুলো লেখেন একেলে কোনও খুদের জবানিতে। যেন সে, তার মতো করে তার স্কুলের, বাড়ির, বন্ধুবৃত্তের দুষ্টুমির চমকপ্রদ সব ঘটনা বার-তারিখ সমেত টুকে রাখছে। যেখানে সে বন্ধুর জন্মদিনে দেওয়ার খেলনা আগে নিজে খেলেটেলে, ভেঙে তাকে গছিয়েছে, স্টিকার আটকে বাবার নতুন গাড়ির কী ভাবে বারোটা বাজিয়েছে... সব লিখেছে। আর স্কুলের ওয়ার্কবুকে যে ভাবে আরশোলা আঁকতে গিয়ে নৌকো আঁকে, থার্মোমিটারকে তরোয়ালের মতো দেখতে করে ফেলে, ঠিক সেই রকমই সে সব রোমহর্ষক ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ ‘ডায়াগ্রাম’ও এঁকেছে। তার আঁকা ছোট ভাইয়ের ছবি দেখে মনে হয় টি রেক্সের লেজকাটা ছানা, খিটখিটে প্রিন্সিপালকে মুগুরধারী একচক্ষু দৈত্যের মতো দেখায়!
হেফলিদের বাঁদরনেত্য
এই ধরনেরই মজারু ডায়েরি জেফ কিনি-র ‘ডায়েরি অফ আ উইম্পি কিড’। ২০০৭ থেকে খান আঠেরো বই ছাপা হয়েছে আর প্রতিটিই বেস্টসেলার। এই সিরিজ়েরই মুখ্য চরিত্র গ্রেগ হেফলে। মূর্তিমান মিডল স্কুলে পড়ে, পরীক্ষায় যা নম্বর পায় তা কহতব্য নয়। বন্ধুমহলে কল্কে পায় না, মেয়েরা তাকে ফিরেও দেখে না। তবুও গ্রেগের জীবনে ঘটনার ঘনঘটা। সে ছোট ভাইকে সুতোর ডেলা দেখিয়ে মিছিমিছি বলেছিল, ‘এই দ্যাখ মাকড়সা’, ভাই ছুট্টে গিয়ে বড়দের বলে দিল, দাদা তাকে মাকড়সা খাওয়াচ্ছে। অনেক ফন্দিই গ্রেগের মাথায় কিলবিল করছে, কিন্তু সব ক’টা করা হচ্ছে কই? কারণ, সে যেখানেই যাচ্ছে সেখানে গ্যাঁট হয়ে বসে তাকে নজরে রাখছে একটা বিদঘুটে পুতুল। গড়বড় দেখলেই পুতুলটা সান্তা ক্লসকে রিপোর্ট করবে, ‘গ্রেগকে কিচ্ছু দেবেন না।’
খানিকটা করে ছোটবেলার মস্তি, তার সঙ্গে হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো ছবি— এই দিয়েই মাত করেছেন উইম্পি কিড-এর লেখক-কার্টুনিস্ট জেফ কিনি। ছোটরা হইহই করে জানিয়েছে, গ্রেগ তাদেরই মতো। ক্লাসের হিরো নয়, টিচারদের প্রিয় নয়, কুঁড়ের বাদশা, চোট্টামির মহারাজা। কমিকস আর উপন্যাসের মাঝামাঝি গোত্রের, ডায়েরি (গ্রেগ বলে জার্নাল) স্টাইলে লেখা বাস্তবধর্মী কার্টুন-নভেলগুলো আট-দশের কচিদের বই পড়ার অভ্যেসটা পোক্ত করছে, মা-বাবারাও খুশি। মৃদু অভিযোগ, লেখক টয়লেট-হিউমার মিশিয়েছেন। ‘মোরন’, ‘হট গার্লস’, ‘জার্ক’— এমন দুষ্টু শব্দও লিখেছেন। জেফ বলেছেন, ‘‘গ্রেগ যা করে, যা ভাবে— সেটা যে ঠিক নয়, আমার একরত্তি ছেলেও বোঝে। সোজাসুজি ভাল-মন্দ দেখিয়ে দিলে বাচ্চারা শুনবেই না। খেলাচ্ছলে গল্প করে বললে ঠিক শিখে নেবে।’’
নিক্কির দোস্তি দুশমনি
নরম মনের খুকিদের পছন্দ রেচেল রেনে রাসেলের ‘ডর্ক ডায়েরিজ়’। এই ডিজ়নি চ্যানেল গোত্রীয় সিরিজ়ে আছে টিনএজারদের ‘হ্যাপিনেস’-এর চার ফান্ডা। ‘ফ্রেন্ডস, ফান, ফ্যাশন, ফ্লার্টিং’। স্কুলের ‘মিস পারফেক্ট’ হিংসুটি ম্যাকেনজ়ি ও তার ফ্যাশনিস্তা গার্ল গ্যাং সাদামাঠা নিক্কি-কে ‘বুলি’ করে। নিক্কির মুড ভাল করে দেয় তার দুই বেস্ট ফ্রেন্ড। আর আসল সিক্রেট, হ্যান্ডসাম ব্র্যান্ডন কিন্তু ম্যাকেনজ়িকে নয়, পছন্দ করে নিক্কিকেই। মিউজ়িক ব্যান্ড, কম্পিটিশন, বার্থডে পার্টি— টিনএজের টুকিটাকি ঘিরে লেখা ডায়েরিগুলোর সম্পদ জাপানি মাঙ্গা আর গ্রিটিংস কার্ডের ঢঙে আঁকা পাতাজোড়া ছবি। মনস্তত্ত্ববিদরা বলেছেন, পৃথিবী জুড়েই স্কুলগুলোর সমস্যা দামি ফোন, পোশাকআশাক নিয়ে শ্রেণিবিদ্বেষ ও বুলিং। তাদেরই জীবনঘেঁষা ছবি-গল্পে মজিয়েই ‘ডর্ক ডায়েরিজ়’ ছোটদের মন থেকে এই সব কালের কলুষতা মুছে দেয়। বুলিংয়ের বিরুদ্ধে আত্মবিশ্বাস জোগায়।
বড়রাও মায়াজালে
ডায়েরিগুলির শিশুপ্রিয়তার অন্যতম কারণ যুগোপযোগী ঝরঝরে ভাষা। উইম্পি কিড-এ সোশ্যাল মিডিয়ার মিম-এর মতো ছবির কোলাজ, চরিত্রদের চেহারা ইমোটিকনসের মতো। রেচেলের লেখায় ‘ওএমজি’, ‘সিসিপি’-র মতো শর্ট ফর্ম, স্মাইলি। শিল্পবিন্যাসের জন্যই দারুণ উপভোগ্য লিজ় পিশোন-এর ‘টম গেটস’ সিরিজ়। ডুডল বানাতে ওস্তাদ এই ছেলের জার্নালটি এন্টার, স্পেস, থ্রিডি লেটারসে ভরা কি-বোর্ড ল্যাঙ্গোয়েজে লেখা। দিদির সাধের সানগ্লাস দিয়ে কী ভাবে গা চুলকানো যায়, ক্লাসে মিসের গোঁফ গুনতে গিয়ে ধরা পড়লে কী করতে হয় ইত্যাদি জরুরি বিষয় জার্নালটি পড়লে জানতে পারা যায়!
জেফ কিনির-ই তৈরি রোলি জেফারসনের অ্যাডভেঞ্চার, সীতা ব্রহ্মচারীর লেখা ‘আর্টিচোক হার্টস’ও কয়েক ঘণ্টায় শেষ করে দেয় বাচ্চারা। ছোটদের ডায়েরি আগেও লেখা হয়েছে, তা বশ করেছে বড়দেরও। বিশ্বযুদ্ধ-কালে বাচ্চাদের লেখা ডায়েরি পড়ে সময়টাকে অনুভব করে মূক হয়ে গিয়েছি, নতুন সহস্রাব্দে লেখা ‘ডিয়ার ডায়েরি’ ফরম্যাটের আত্মকথনগুলিতে কিশোরীদের রঙিন হৃদয়টাকে চিনে মুচকি হেসেছি। ছোটরা এই ধরনের লেখায় যেমন নিজেদের জগৎ খুঁজে পায়, তেমনই বড়দের মনে পড়ে যায় ছোটবেলার দুষ্টুমি। যেমন, গ্রেগ স্কুলে হাস্যকর অপকীর্তি করে বাড়ি ফিরে কাঁপছে— এই বুঝি পুলিশ ধরতে এল! এমন পরিস্থিতিই তো পরবর্তী কালে ‘ছোটবেলার সুখস্মৃতি’-র অঙ্গ। বাংলায় শিশুর লেখনীতে ডায়েরি বোধহয় নেই, তবে এগুলি পড়ে আমাদের সাহিত্যিকদের স্মৃতিকথায় পাওয়া দুষ্টু-মিষ্টি গপ্্পো মনে পড়ে। পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’-তে পটগুলটিশ ওয়ারে, ডাক্তার ডাক্তার খেলতে গিয়ে মামার পিঠে সত্যিকারের চাকু চালিয়ে ফেলা-য় এই স্বাদেরই বজ্জাতি। শঙ্খ ঘোষের ‘ছোট্ট একটা স্কুল’-এ রসগোল্লা ছুড়ে কুল পাড়ার, লীলা মজুমদারের ‘খেরোর খাতা’-য় শিরোমণি কুকুরের শেয়ালপণ্ডিত হয়ে ওঠার কাহিনি পড়ে লুটোপুটি খেয়েছি।
আসলে বাস্তবজীবনের ঘটনাগুলোকেই রসিয়ে রাঙিয়ে পেশ করতে পারলে, তাতেই আসর জমে ক্ষীর হয়। কৌশলী বিপণন আর ঝকঝকে উপস্থাপনার জোরে সে কাজটা দুরন্ত করাতেই ডায়েরিগুলোর এত কদর। জেফ বলেছেন, ‘‘ডায়েরি পড়েই বই ভালবাসতে শিখুক ছোটরা। পরের ধাপে পার্সি জ্যাকসন, হ্যারি পটার পড়তে সুবিধে হবে।’’
তেমনটাই হচ্ছে। ডায়েরির অনুপ্রেরণায়, নিজেদের জীবন নিয়েও লিখতে আঁকতে বসে যাচ্ছে ছোটরা। তাই হোক। ওরা পড়ুক, লিখুক, যেমন খুশি মজার চশমায় দেখুক নিজেদের পৃথিবী আর মা-দিদি-ক্লাসটিচার সব্বাইকে। ‘দ্য প্রিন্সেস ডায়েরিজ়’-এর মতো হুল্লোড়-তামাশা আর রূপকথায় উপচে উঠুক ওদের জীবন, মন আর কলম। শুধু যাতে কখনও আর আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়তে না হয়, সেই দায়িত্বটা কিন্তু বড়দের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy