Advertisement
১২ জানুয়ারি ২০২৫
Abhishek Banerjee

হীরক বন্দরে ভিড়ছে ভিন্ জেলার নৌকাও, সরকারি হাসপাতালের ‘ঝক্কি এড়াতে’ অভিষেকের সেবাশ্রয়ে ভিড়

গোটা কর্মসূচি যে বিপুল খরচসাপেক্ষ, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তবে মডেল ক্যাম্পে দেখা গেল সংগঠিত ব্যবস্থা। ছুটে বেড়াচ্ছে তরুণ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কার্যত মিনি হাসপাতালের রূপ নিয়েছে মডেল ক্যাম্প।

‘সেবাশ্রয়’ শিবিরে নাম নথিভুক্ত করার লাইনে মানুষ।

‘সেবাশ্রয়’ শিবিরে নাম নথিভুক্ত করার লাইনে মানুষ। —নিজস্ব চিত্র।

শোভন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৫৮
Share: Save:

দু’দিন আগে শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে উত্তরবঙ্গের ময়নাগুড়ি থেকে ডায়মন্ড হারবারে ছুটে এসেছিলেন এক মা। বছর দেড়েকের মেয়ের শ্রবণযন্ত্রে সমস্যা! অনেক জায়গায় দেখিয়েছেন। কমছে না। অগত্যা ডায়মন্ড হারবার।

শনিবার ভোর ৬টা নাগাদ রওনা দিয়ে হুগলির খানাকুল থেকে তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে ডায়মন্ড হারবারে ছুটে এসেছিলেন নিভারানি মাঝি এবং সনাতন মাঝি। তাঁদের মেয়ে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারে না। সমস্যা শিরদাঁড়ায়। এনআরএস, এসএসকেএম, পুলিশ হাসপাতাল ঘুরে হন্যে। সুরাহা হয়নি। বাইপাসের ধারের একটি হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছিল, তিন বছরের মেয়েটি বিরল রোগে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা করতে খরচ হবে বছরে প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা! সনাতন মুটের কাজ করেন। ৭২ লক্ষ টাকা তাঁর কাছে আলোকবর্ষ দূরের বিযয়। অতএব, ডায়মন্ড হারবার।

তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ডায়মন্ড হারবারে গত ২ জানুয়ারি থেকে যে স্বাস্থ্য পরিষেবার কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, যার পোশাকি নাম ‘সেবাশ্রয়’। সেখানেই এখন সংসদীয় এলাকার বাইরে থেকে অসহায় মানুষ আসছেন। ‘হীরক বন্দর’-এ ভিড়ছে ভিন্‌জেলার নৌকাও। এর সঙ্গে রয়েছে গোটা ডায়মন্ড হারবার লোকসভার লক্ষ লক্ষ মানুষ। সকলে পরিষেবা নিতে আসছেন সেবাশ্রয়ে। নাম নথিভুক্তকরণের কাউন্টার থেকে চক্ষুপরীক্ষা বা ইকো কার্ডিওগ্রাম করার লম্বা লাইনে দাঁড়ানো ভিড় স্পষ্টই বলছে, সরকারি হাসপাতালে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। তাই হাতের কাছে এই পরিষেবার সুযোগ নিচ্ছেন তাঁরা।

ডায়মন্ড হারবার লোকসভার সাতটি বিধানসভা জুড়ে সাত দফায় আগামী আড়াই মাস ধরে চলবে এই কর্মসূচি। শনিবার শেষ হয়েছে ডায়মন্ড হারবার বিধানসভার ‘সেবাশ্রয়’। শুধু একটি বিধানসভাতেই একটি মডেল ক্যাম্প-সহ ৪২টি ক্যাম্পে পরিষেবা নিয়েছেন প্রায় দু’লক্ষ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। গত বুধবার এই সংখ্যাটা ছিল ৮৪ হাজারের মতো। স্থানীয়েরা অনেকেই বলছেন, প্রথমে তাঁরা আসেননি। লোকমুখে শুনে শুনে এখন আসছেন। কেউ আসছেন হৃদ্‌রোগের সমস্যা নিয়ে তো কেউ চর্মরোগ। তবে ডায়মন্ড হারবার বিধানসভার সেবাশ্রয়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত চিফ মেডিক্যাল কো-অর্ডিনেটর অমিতকুমার মণ্ডল বলেন, ‘‘সবচেয়ে বেশি ভিড় হচ্ছে শিশুদের চিকিৎসা এবং চোখের সমস্যার জন্য। কার্ডিওলজিরও অনেক রোগী আসছেন।’’

মহম্মদ সাইদুল ইসলাম শেখ এসেছিলেন ডায়মন্ড হারবারেরই সাংবেড়িয়া গ্রাম থেকে। তাঁর চর্মরোগের সমস্যা। হাসপাতালে যাননি কেন? সাইদুলের সটান জবাব, ‘‘ওখানে অনেক দেরি হয়। এখানে তো সব তাড়াতাড়ি হচ্ছে।’’ আবার নুনগোলা এলাকা থেকে আসা মধ্যবয়স্কা শমিতা চক্রবর্তী চোখ দেখাতে এসে জানালেন, ‘‘পাওয়ার দেখাতে গেলে দোকানে কতগুলো টাকা নিয়ে নেয়! এখানে তো বিনা পয়সায় হচ্ছে।’’

শুক্রবার পেটের সমস্যার জন্য ন’বছরের নাতিকে সেবাশ্রয়ের ডাক্তারবাবুদের দেখিয়েছিলেন বৃদ্ধ সমরেন্দ্রনাথ কপাট। তার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি হয়েছিল। শনিবার সমরেন্দ্র এসেছিলেন রিপোর্ট নিতে। সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে সেবাশ্রয়ে কেন? ধনপুর অঞ্চলের বাসিন্দা সমরেন্দ্র হাতে থাকা লাঠি নীল কার্পেটের উপর ঠুকতে ঠুকতে জানিয়ে দিলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালের ওষুধে আমার কোনও বিশ্বাস নেই। আমার এখানেই বিশ্বাস।’’

শুধু গরিব বা প্রান্তিক মানুষ অংশের নয়। অনেক মধ্যবিত্তও আসছেন সেবাশ্রয়ে। যেমন ডায়মন্ড হারবার শহরের বাসিন্দা, পেশায় একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী গোপাল মণ্ডল এসেছিলেন ইকোকার্ডিওগ্রাম করাতে। তিনি বলছেন, ‘‘আমার সামর্থ্য রয়েছে বাইরে থেকে করানোর। কিন্তু এই সুযোগ যখন পাচ্ছি, তখন পয়সা অপচয় করব কেন?’’

(বাঁ দিকে) জলপাইগুড়ি থেকে আসা শিশুকন্যা এবং তার মা। খানাকুলের শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে মা (ডান দিকে)।

(বাঁ দিকে) জলপাইগুড়ি থেকে আসা শিশুকন্যা এবং তার মা। খানাকুলের শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে মা (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।

পাড়ায় পাড়ায় যে ৪১টি ক্যাম্প হচ্ছে, সেখানে যে রোগীদের পরীক্ষার দরকার হচ্ছে, তাঁরাও আসছেন মডেল ক্যাম্পে। আবার যে রোগীদের জন্য দরকার আরও চিকিৎসা, তাঁদের পাঠানো হচ্ছে নির্দিষ্ট করে রাখা ১২টি হাসপাতালে। সেই তালিকায় ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতাল থেকে শুরু করে এনআরএস, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজও রয়েছে। চিকিৎসকেরা যে ওষুধ লিখছেন, তা-ও বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে সেবাশ্রয়ের ক্যাম্প থেকে। সাধারণ হজমের ওষুধও পাচ্ছেন তাঁরা। এই কর্মসূচি কি সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমান্তরাল কোনও পন্থা? ডায়মন্ড হারবারের বিধায়ক পান্নালাল হালদারের কথায়, ‘‘আমরা তো সরকারি হাসপাতালের বিরোধিতা করিনি। আমাদের বস্ (পড়ুন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়) চেয়েছিলেন দুয়ারে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে। আমরা সেটাই করছি।’’

গোটা কর্মসূচি যে বিপুল খরচসাপেক্ষ, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তবে মডেল ক্যাম্পে দেখা গেল সংগঠিত ব্যবস্থা। ছুটে বেড়াচ্ছে তরুণ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কার্যত মিনি হাসপাতালের রূপ নিয়েছে মডেল ক্যাম্প। চলছে মুখের ক্যানসারের স্ক্রিনিংও। গোটা কর্মকাণ্ডে স্থানীয় স্তরের তৃণমূল যে ময়দানে রয়েছে, তা-ও দেখা গিয়েছে। মডেল ক্যাম্পের বাইরে টোটোর লাইন। বুথে ভোটার আনার মতো করে গ্রাম থেকে রোগীদের সেবাশ্রয়ে নিয়ে আসছেন স্থানীয় তৃণমূলের কর্মীরা। যদিও সেই টোটোতে কোনও ঝান্ডা নেই।

গোটা ডায়মন্ড হারবার রোডকে মুড়ে ফেলা হয়েছে অভিষেকের ছবি সম্বলিত হোর্ডিংয়ে।

গোটা ডায়মন্ড হারবার রোডকে মুড়ে ফেলা হয়েছে অভিষেকের ছবি সম্বলিত হোর্ডিংয়ে। — নিজস্ব চিত্র।

কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে ‘হীরক বন্দর’-এর দিকে গেলে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের সীমানা শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয়ে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা। কিন্তু এখন যদি কেউ সেই রাস্তায় যান, তাঁকে বলে দিতে হবে না অভিষেকের লোকসভা কোথা থেকে শুরু। কারণ, তৃণমূল সাংসদের ছবি সম্বলিত কাটআউট, হোর্ডিংয়ে ছয়লাপ গোটা লোকসভা। প্রতি কিলোমিটারে অন্তত ৫০০ করে সেবাশ্রয়ের হোর্ডিং লেগেছে। তৈরি হয়েছে কয়েকশো মিটার অন্তর অন্তর অস্থায়ী তোরণ। কাটআউট বিজ্ঞাপনী হোর্ডিংয়ে অভিষেকের একার ছবি থাকলেও দেখা গিয়েছে যে তোরণগুলি তৈরি হয়েছে, তার এক দিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্য দিকে অভিষেকের ছবি রয়েছে। রাস্তার ধারে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন দেওয়ার যে কাঠামো থাকে, তার সিংহভাগেই রয়েছে অভিষেকের ছবি দেওয়া সেবাশ্রয়ের হোর্ডিং। বিষ্ণুপুর বিধানসভা জুড়ে অভিষেকের ছবি সম্বলিত এমনও অজস্র হোর্ডিং রয়েছে যেখানে তাঁর নানা পরিচয় দেখা গিয়েছে। কোথাও তিনি ‘বাংলার বাঘ’ আবার কোনও হোর্ডিংয়ে ‘বাংলার আইকন’। ‘সেনাপতি’, ‘সবুজ সম্রাট’ এ হেন নানা বিশেষণে অভিহিত করা হয়েছে অভিষেককে। প্রচারের প্লাবন দেখলে বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ডায়মন্ড হারবার একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। যে দ্বীপের রাজার নাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

সেবাশ্রয় শিবির শনিবারই শেষ হয়েছে ডায়মন্ড হারবার বিধানসভায়। রবিবার থেকে শুরু হবে ফলতায়। তার পর ধাপে ধাপে বাকি বিধানসভাগুলিতেও। টিম অভিষেক জানাচ্ছে, লক্ষ্য ডায়মন্ড হারবারের ২৩ লক্ষ মানুষকে পরিষেবা দেওয়া। কিন্তু ‘হীরক বন্দর’-এ ভিড়ছে ভিন্‌জেলার নৌকাও। আশা নিয়ে। অসহায় হয়ে।

অন্য বিষয়গুলি:

Abhishek Banerjee Diamond Harbour TMC Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy