(ডান দিক থেকে) সেতারে সরোজ ঘোষ, নবস্বররাগিণীতে সুভাষ ঘোষ
ছ’দিনের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আয়োজন। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে। আয়োজক প্রাচীন কলা কেন্দ্র। চণ্ডীগড়ের এম এল কোসর ইন্ডোর অডিটোরিয়ামে ১৬ থেকে ২১ অগস্টের এই শ্রী-পরিসর সুপরিকল্পিত বিন্যাসে সাজা। মার্গগানের প্রসার আর প্রশিক্ষণে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে আসা প্রতিষ্ঠানের সেই প্রয়াসে স্বাভাবিক ভাবেই মিলিত হল উপমহাদেশের নানা ঘরানার সুরশ্রুতি।
প্রথম দিনের কণ্ঠশিল্পী নীরা গ্রোভার। পুরিয়া ধানেশ্রী দিয়ে শুরু করলেন। তানবিস্তারে গমকের মধুর প্রয়োগ। পরে গৌড়মল্লারে ছোট খেয়াল। ছোট করে রাগরূপ এঁকেই আগ্রা ঘরানার বন্দিশ ‘পেয়ারি লাড সে ঝুলে লাডলি লাড করে’। উস্তাদ খাদিম হুসেন খানের কণ্ঠে দ্রুত লয়ে বিখ্যাত গান। লয় প্রায় অর্ধেক করে মাধুর্যমণ্ডিত গায়কিতে গৌড়মল্লারের উপচার চয়ন করলেন নীরা। শেষে ঠুমরি ‘ঝুলা ধীরে সে ঝুলাও বনোয়ারি সাঁওরিয়া’। বারাণসীর গন্ধমাখা খাম্বাজ ঠাটের ঝুলাগানটিকে শ্লথ চলনের সোহাগে ভরিয়ে তুললেন শিল্পী। পরে ধীরে ধীরে দ্রুতি বাড়াল চার-চার মাত্রার গতিপথ। তবলায় আবির্ভাব বর্মা এবং হারমোনিয়ামে মুরলীধর মিষ্টি সঙ্গত করলেন।
দ্বিতীয় সন্ধ্যার শিল্পী নিধি নারং। আগ্রা ঘরানার শিল্পীর এ দিনের সম্ভার গজ়লের। শুরু ‘ক্যায়া ইয়ে ভি জ়িন্দেগি হ্যায়’ দিয়ে। গজ়লের রসায়নে সুরবিস্তারের তুলনায় কথাবুনটেরই প্রাধান্য বেশি। নিধি সে ধর্ম সুচারু ভাবেই পালন করলেন। কিন্তু শিল্পী খেয়ালে পারদর্শী হওয়ায় সে আঙ্গিকের পালও বিলক্ষণ উড়ল তাঁর সুরসাম্পানে। একাধিক জনপ্রিয় গজ়লের পরিবেশনা। ‘আপ কি ইয়াদ আতি রহি’, ‘ধুঁয়া উঠা থা দিওয়ানে কে’ প্রভৃতি। হ্যাঁ, বড় প্রাপ্তি ‘আজ যানে কী জ়িদ না করো’। কবি ফৈয়াজ হাশমির কলম এবং সঙ্গীতকার সোহেল রানার সুরে গাঁথা চিরন্তন এই গানে মাত করলেন শিল্পী। ইমনকল্যাণের স্মৃতি-সত্তা স্পষ্ট ফোটালেন। তবে এ গানে ফরিদা খানুমের বয়ান ভোলা যায় না। তাই মনে হল, লয় আরও কমালে অনুনয় আরও বাড়ত। রাজেশের সারেঙ্গি, সুধীর শর্মার হারমোনিয়াম, জাগ্গির গিটার, প্রবীণ রাঠির তবলা অনবদ্য।
অতুলকুমার দুবে। তৃতীয় দিন। নবীন কণ্ঠশিল্পী। ভেন্ডিবাজার এবং গোয়ালিয়র ঘরানায় প্রশিক্ষিত। শুরু ইমনে। ধ্রুপদের গমকপ্রধান আওচার। কণ্ঠলাবণ্য নজরকাড়া। নিয়ন্ত্রিত তানকারি। একতালে ‘পহেচানু সুর কি মহিমা’। পরে দ্রুত তিনতালে ‘মোরি গাগর না ভরন দে’। কিরানা ঘরানার হীরাবাই বরোদেকর গীত বহুশ্রুত বন্দিশ। নবীন অতুলকুমারের প্রতিভাও যে অতুল্য, মুহূর্তে ধরা পড়ল। পরের পেশকারি মধ্যলয়ে মেঘ-বন্দিশ ‘গগন গরজে চমকত দামিনী’। তবে, মেঘাড়ম্বর ঘটল না। এর পর মীরার ভজন। যোগ-নিবদ্ধ ‘আলি মাহে লাগে বৃন্দাবন নিকো’, পরে ‘ক্যায়সে জাদু ডারি’। এক কালে অনুপ জলোটার গায়নে এক স্বর টেনে যাওয়া, একই শব্দের পৌনঃপুনিক অনুরণনে যে মুদ্রাদোষ বহুশ্রুত ছিল, অতুলকুমারের গায়নে খানিক যেন তারই প্রতিধ্বনি। ‘ডারি-ডারি-ডারি’র ক্রম-বিলীয়মান প্রবণতার প্রতিধ্বনি। ‘এক তু হি রাখওয়ালা’ সাঁইবন্দনাতেও স্বরান্ত-ছিলা টানার ছায়া। হারমোনিয়ামে তরুণ জোশী এবং তবলায় আবির্ভাব বর্মা অনবদ্য।
চতুর্থ সন্ধ্যায় আবারও তারুণ্য। কণ্ঠশিল্পী ধ্রুব শর্মা। শুরু পুরবী ঠাটের পুরিয়া ধানেশ্রী দিয়ে। বিলম্বিত একতাল। ‘পায়েলিয়া ঝনকার’ দ্রুত তিনতালে। তাজা, মিষ্টি গলা। ‘রেঞ্জ’ ভাল এবং তা দেখানোর প্রবণতাও স্পষ্ট। তাই উচ্চ স্বরগ্রামে মাঝেমধ্যে কৃত্রিম শোনায়। তবে দীর্ঘ তানকারি, দ্রুত বোলতানে তিনি সাবলীল। পরের পরিবেশনা আভোগী। তিনতালে ছোট খেয়াল, ‘বালমা ঘর আয়ে’। এখানেও কণ্ঠলাবণ্য অনস্বীকার্য এবং দেখনদারির প্রয়াসও অস্বীকার করা অসম্ভব। মিয়াঁ কি মল্লার ধরলেন একতালে— ‘গরজে গরজে আজ মেঘ’। সুন্দর আওচারে রাগরূপ প্রকাশিত। তাঁর গুরু পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে বহুশ্রুত বন্দিশটির প্রতি সমীহ যথেষ্টই করলেন, কিন্তু তানকারি একটু-বেশি। শেষে ভজন ‘জগৎ মে ঝুটি দেখি’— গুরুবাণী, কিরওয়ানি, নানকগান। সুন্দর গাইলেন ধ্রুব। আবির্ভাব বর্মার তবলা, তরুণ জোশীর হারমোনিয়ামে আগাগোড়া নিয়ন্ত্রিত মেজাজ।
বড় প্রাপ্তি পঞ্চম সন্ধ্যার নিবেদিতা সিংহ। গোয়ালিয়র এবং সেসওয়ান ঘরানায় প্রশিক্ষিত শিল্পী শুরু করলেন মেঘ রাগে। পর পর তিনটি বন্দিশ। বিলম্বিত খেয়াল ‘আয়ি বরখা ঋতু’। পারম্পরিক বন্দিশ তিনতাল মধ্যলয়ে ‘ঘন ঘননন’ এবং একতালে ছোট খেয়াল ‘আয়ি ঋতু বরষন কি’। শুরু থেকেই মঞ্চে মেঘাড়ম্বর। দানাযুক্ত বহমান মধুকণ্ঠ। প্রতি সপ্তকে অনায়াস বিহার। দেখনদারি নেই, আছে প্রাজ্ঞতা-অনূদিত মসৃণ ধারাজল। পরের পরিবেশনা নটমল্লার। ‘এ মুরলী বোলন লাগে শাওন কি’। সমপদী ১৬ মাত্রার চলন। নট এবং মল্লারের রূপ আলাদা ভাবে ফুটিয়ে তুলেই পরম যত্নে ভাসিয়ে দিলেন মিশ্রস্রোতে। নিবেদনই নিবেদিতা সিংহের জাদুকাঠি। তাই স্পর্শস্বরে, মিড়ে নিবিড়। তাড়া নেই তাঁর বর্ষাঋতুর। তাই দেশ-জারিত ‘সখি শাওন আয়ো’ ঠুমরিতেও ওজস্বিতা অন্তর্লীন, মাধুর্য কোমলপ্রকাশ। তালবাদ্যে জয়দেব, হারমোনিয়ামে সীমা কউর সুন্দর অনুঘটক-গুণে।
সেতার এবং নবস্বররাগিণীর যুগলবন্দি। শেষ সন্ধ্যার প্রযোজনা। শিল্পী-দম্পতি সরোজ ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ। সেতারিয়া সরোজ ঘোষ উস্তাদ রইস খানের কাছে প্রশিক্ষিত, উস্তাদ আমজাদ আলি খানের কাছে দীক্ষিত। সুভাষ ঘোষও উস্তাদ আমজাদ আলি খানের শিষ্য, গিটারের তালিম দীপক রায়ের কাছে। তিনি দু’টি বাদ্যযন্ত্রের জনক। সরসবাণী, স্বররাগিণী। সরসবাণীতে বীণা, সরোদ, গিটারের সম্মিলিত আবহ। স্বররাগিণী দক্ষিণী বীণা আর সরোদের ভাবসম্মিলন। শিল্পীরা শুরু করলেন মোহনকোষ দিয়ে। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর প্রয়াণের পর মালকোষে শুদ্ধ গান্ধার আর রেখাবের আলিম্পনে এই রাগিণী নির্মাণ করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। মালকোষের মতোই প্রধানত কণ্ঠনির্ভর রাগিণী। যন্ত্রে তার ভরা-জোয়ারের আদায়কারি কঠিন। কিন্তু শিল্পীরা শুরু থেকেই কঠিনের ঘুম ভাঙাতে শুরু করলেন। চমৎকার আনন্দ-বিষাদ আবহ। তিনতালের আধো-ভাঙা ঠেকায় বাজছিল দু’টি তবলা। ছোট মুখের রজনীশ ধীমানের। তুলনাহীন। আর বড় মুখ আবির্ভাব বর্মার। ছ’দিনের এই আয়োজনে বহু বার শোনা গিয়েছে আবির্ভাবকে। এবং সব-সব ক্ষেত্রেই আবির্ভাব স্বোপার্জিত মহিমায় আবির্ভূত। মোহনকোষের ঠেকায় তাঁর আঙুল বেড়াভাঙার কাব্য তৈরি করল। খানিক পরে যখন ১৬ মাত্রার সঙ্গে দেখা হল ১২ মাত্রার সমপদী যুগলবন্দির, স্বপ্নসম্পদ তৈরি করলেন চার শিল্পী। তালমালা। তালে-তালে অনায়াস চর্যাবিহার। তারযন্ত্রের দুই শিল্পীই অসামান্য স্থিতধী। শান্ত মেজাজ। মিড়ঝঙ্কারে ভরিয়ে তুললেন বাদন। দু’জনেরই বিশিষ্টতা ভর মেপে ধ্বনি ফেলার দক্ষতা। বাড়া-কমা মেধাঙ্কিত। সুযোগ করে দিচ্ছেন সহশিল্পীদের আপনাপন পরাগ অক্ষত রেখেই। প্রায় এক ঘণ্টার মোহনকোষের পর তাঁরা এলেন রবীন্দ্রনাথে। এলেন উস্তাদ আমজাদ আলি খানের প্রশিক্ষণ-বিভূতি ছড়িয়েই। বাজালেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’। এর পর গাঁধী মূর্ত হলেন পনেরোশো শতকের কবি নরসিংহ মেহতার ‘বৈষ্ণব জন তো’ ধুনে। একেবারে শেষে আবারও শিল্পীযুগল দেখা করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে— ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’। শেষের সন্ধ্যার শুরু হয়েছিল মোহনকোষে। শেষ হল ত্রিবর্ণরঞ্জিত ইমনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy