দ্য ডোভার লেন মিউজ়িক কনফারেন্স এবং ডোভার লেন মিউজ়িক অ্যাকাডেমি আয়োজিত তিন দিনের ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যোৎসব হয়ে গেল সম্প্রতি ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর কালচারাল রিলেশনসের সত্যজিৎ রায় প্রেক্ষাগৃহে।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকে রসিক দর্শকের সামনে তুলে ধরতে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে ১৯৫২ সালে কিছু সঙ্গীতপ্রেমিক মানুষ এই উৎসবের সূচনা করেন। তার পর থেকে গত ৬৭ বছর ধরে উদ্যোক্তারা তাঁদের এই প্রচেষ্টাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। এক কালে রাজারাজড়া-নবাব-বাদশারা ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু স্বাধীনতার পরে সাধারণ মানুষের আগ্রহে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে সারা ভারতে যে সব প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নেয়, দ্য ডোভার লেন মিউজ়িক কনফারেন্স তাদের মধ্যে অন্যতম।
ভারত তথা বাংলার রসিক শ্রোতা ও দর্শকেরা রাতের পর রাত কাটিয়েছেন এই সংস্থা পরিবেশিত অনুষ্ঠানে প্রবাদপ্রতিম নৃত্যশিল্পী এবং সঙ্গীতশিল্পীদের নৃত্য দেখে, গান ও যন্ত্রসঙ্গীত শুনে। আগে একই আসরে নৃত্য এবং সঙ্গীত উপস্থাপিত হত। পরে দর্শক-আগ্রহে নৃত্য ও সঙ্গীতকে আলাদা ভাবে পরিবেশন করা হয়।
৬ সেপ্টেম্বর কোনও আনুষ্ঠানিক সূচনা ছাড়াই সরাসরি উৎসব শুরু হয় শিল্পী অনিশা পরমেশ্বরমের ভরতনাট্যম নৃত্য দিয়ে। মোহনা আয়ারের শিষ্যা অনিশা এখন ভারতীয় বিদ্যাভবনে সিনিয়র ডিপ্লোমার ছাত্রী। অনিশা প্রথমে নিবেদন করেন গণেশবন্দনা ও আল্লারিপু। তার পরে একটি পদম—মুরুগন অর্থাৎ কার্তিকেয়র বর্ণনা। সবশেষে তিল্লানা। অনিশার প্রথানুগ নৃত্যের উপস্থাপনা যথাযথ। নৃত্যাঙ্গনার শিল্পীজীবনের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা এখনও বাকি। তাঁর জন্য রইল শুভকামনা।
ভরতনাট্যমের পর ওড়িশি নৃত্য। নিবেদনে রাজীব ভট্টাচার্য ও সহশিল্পীবৃন্দ। অল্প বয়সেই তিনি নৃত্যশিক্ষা শুরু করেন নৃত্যশিল্পী শর্মিলা বিশ্বাসের কাছে। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওড়িশি নিয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করে ওড়িশায় গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের নৃত্যবাসা সৃজনে প্রথমে গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র ও পরে তাঁর পুত্র গুরু রতিকান্ত মহাপাত্রের কাছে নৃত্যশিক্ষা লাভ করেন এবং বিভিন্ন নৃত্যশিবিরে রতিকান্তকে সহযোগিতা করবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও নৃত্যশিবির পরিচালনা করেন। রাজীব ভট্টাচার্য ও তাঁর সহশিল্পীরা অনুষ্ঠান শুরু করেন রীতি অনুযায়ী মঙ্গলাচরণ দিয়ে। তার পরে বন্দনা, তালপ্রধান পল্লবী ও শেষে শিবস্তুতি দিয়ে রাজীব ও তাঁর সহশিল্পীরা তাঁদের অনুষ্ঠান শেষ করেন। সহশিল্পীরা যথাযথ। রাজীবের নৃত্যানুষ্ঠান মনোজ্ঞ— কেলুচরণ ঘরানার যথার্থ উত্তরসূরি।
সে দিনের শেষ অনুষ্ঠান ছিল কত্থক নৃত্য। শিল্পী সৌরভ ও গৌরব মিশ্র। বেনারস ঘরানার সেতারবাদক ড. অমরনাথ মিশ্রের এই যমজ পুত্রদ্বয় নৃত্যশিক্ষা করেন কাকা পণ্ডিত রবিশঙ্কর মিশ্র ও পণ্ডিত মাতাপ্রসাদ মিশ্রের কাছে। মামা বিরজু মহারাজের কাছেও নৃত্যের তালিম নিয়েছেন তাঁরা। সেই সন্ধ্যায় তরুণ এই দুই নৃত্যশিল্পীর অনুষ্ঠান দর্শককে মুগ্ধ করে। ভ্রাতৃদ্বয় বেনারস ঘরানার রীতি মেনে বন্দনা, ঠাট, বোলপরন, চক্রদার তৎকার, গৎভাও পরিবেশন করে করতালি আদায় করে নেন। বেনারসের সঙ্গে লখনউ ঘরানার মিশ্রণের কিছু নমুনাও পেশ করেন তাঁরা। অনুষ্ঠান শেষ করেন শিবস্তুতি দিয়ে। পরিতাপের বিষয়, সে দিন প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তাই শিল্পীরা যখন কলকাতার সমঝদার দর্শকের কথা উল্লেখ করে বারবার প্রণাম জানাচ্ছিলেন, তখন লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। কামনা করি, সৌরভ-গৌরব কলকাতায় ভবিষ্যতে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে নৃত্য পরিবেশন করবেন, আর তখন নাচের সময়ে পান চিবোনোটা বন্ধ করবেন।
৭ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় গোপিকা ভার্মার মোহিনীআট্টমের উপস্থাপনা দিয়ে। গুরু কল্যাণী কুট্টি আম্মার সুযোগ্য শিষ্যা গিরিজা ও চন্দ্রিকা কুরুপের কাছে গোপিকার শিক্ষার সূচনা। পরে প্রবাদপ্রতিম গুরু কল্যাণী কুট্টি আম্মা ও তাঁর কন্যা শ্রীমতী রাজনের কাছে শিক্ষার পরবর্তী পাঠ গ্রহণ করেন। কথাকলি নৃত্যগুরু কৃষ্ণ নায়ারের কাছেও তিনি অভিনয়ের পাঠ নেন। চিত্রাঙ্গন— গণেশ বন্দনার পরে সে দিনের অনুষ্ঠানে গোপিকা নিবেদন করেন সত্যভামা-গর্বভঙ্গম। সত্যভামা ও রুক্মিণীর মাঝে পড়ে অসহায় শ্রীকৃষ্ণ কেমন করে চাতুর্যের সঙ্গে সমস্যার সমাধান করেন এবং সত্যভামার দর্প চূর্ণ করে রুক্মিণীর আত্মনিবেদনকেই প্রেমের জয় হিসেবে স্বীকৃতি দেন— সেই কাহিনি চমৎকার অভিনয়ের দ্বারা উপস্থাপন করেন তিনি। গোপিকার শেষ নিবেদন ছিল শঙ্করাচার্যের ‘ভজ গোবিন্দং’ রচনার নৃত্যরূপ। খুবই সুন্দর উপস্থাপনা।
গোপিকার পরে কত্থক নৃত্য পরিবেশন করেন শ্রীজিতা বৈদ্য। গুরু অসীমবন্ধু ভট্টাচার্যের শিষ্যা শ্রীজিতা গুরুর নৃত্যদলের সঙ্গে ন’বছর ধরে যুক্ত। শ্রীজিতার নৃত্যানুষ্ঠানের সূচনা শিবস্তুতি দিয়ে। এর পরে অসীমবন্ধুর পরিকল্পনায় ‘মায়ামৃগ’ নামে তিনতালে নিবদ্ধ তিস্রজাতির একটি নৃত্য পরিবেশন করেন। সবশেষে দাদরায় আধারিত একটি অভিনয়— মুগ্ধ নায়িকা। শ্রীজিতা বৈদ্য সম্ভাবনাময় নৃত্যশিল্পী। সে দিনের অনুষ্ঠানে তাঁর নৃত্যের উপস্থাপনা উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল দর্শকের কাছে।
পরবর্তী নৃত্যানুষ্ঠান কুচিপুড়ি—শিল্পী গুরু রাজু। বৈজয়ন্তী কাশীর শিষ্য রাজু তাঁর শিক্ষিকার সম্ভাবী ডান্স অনসম্বল দলের নৃত্যশিল্পী, শিক্ষক ও সহকারী নৃত্য পরিচালক। রাজু নৃত্যানুষ্ঠান শুরু করেন গণেশ বন্দনা দিয়ে। রাগ— হংসধ্বনি, তাল— আদিতাল। পরে আদিতালে নিবদ্ধ একটি শব্দম— শ্রীরামচন্দ্রের জন্ম থেকে অভিষেক পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা। দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনা। এর পরে শিবস্তুতি— নটরাজ রূপে শিবের তাণ্ডবনৃত্য প্রত্যক্ষ করছেন দেবগণ-সহ স্বয়ং পার্বতী। লক্ষ্মীদেবী গাইছেন, সরস্বতীদেবী বীণা বাজাচ্ছেন। মনোগ্রাহী নৃত্য পরিকল্পনা। শেষে মোহনা রাগে আদিতালে নিবদ্ধ তরঙ্গম। কুচিপুড়ি প্রথানুগ রীতি অনুযায়ী থালার উপরে নৃত্য।
সে দিনের শেষ অনুষ্ঠান ছিল সত্রীয়া নৃত্য। পদ্মশ্রী যতীন গোস্বামীর সুযোগ্য শিষ্যা অনিতা শর্মা ও সহশিল্পীরা স্বল্পপরিচিত এই শাস্ত্রীয় নৃত্যটি পরিবেশন করেন। অনিতা তাঁর নৃত্যানুষ্ঠান শুরু করেন একতালে নিবদ্ধ কৃষ্ণবন্দনা দিয়ে। পরে চালিনৃত্য ও শেষে আদিতালে নিবদ্ধ একটি গীতের নৃত্যরূপ ‘ওঠ রে বাপ গোপাল হে, নিশি হইল ভোর’। অনিতার সহশিল্পীরা ছিলেন শ্রুতিমালা মেধি, মালতী রাজপুত, বন্দনা কাকতি ও প্রিয়াঙ্কা বোরো। সুন্দর পরিকল্পনা এবং উপস্থাপনা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, দর্শক ছিল হাতে গোনা। শঙ্করদেব প্রবর্তিত পূর্ব ভারতের এই নৃত্যধারাটির আরও প্রচার এবং প্রসারের প্রয়োজন আছে।
৮ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানের সূচনা হয় অসহিমিতা বাগচীর ওড়িশি নৃত্য দিয়ে। শ্রীমতী কাকলি বসুর শিষ্যা অসহিমিতা অল্প বয়স থেকেই নৃত্যশিক্ষা শুরু করেন। সে দিনের অনুষ্ঠানে তাঁর প্রথম নিবেদন ছিল দেশি পল্লবী। রাগ— দেশ, তাল— একতালি। দ্বিতীয় নিবেদন কলাবতী রাগে আধারিত একতালিতে নিবদ্ধ অভিনয়। সঙ্গীত জয়দেব রচিত বাসে হরিবিহ। অসহিমিতা সম্ভাবনাময় শিল্পী। বিশেষত তাঁর অভিনয় দর্শককে আকৃষ্ট করেছে। নবীন এই শিল্পীর জন্য শুভকামনা রইল।
পরবর্তী অনুষ্ঠান নাদম-এর কত্থক নৃত্য। সন্দীপ মল্লিক এবং সহশিল্পীবৃন্দের নিবেদন। সন্দীপ মল্লিকের প্রাথমিক নৃত্যশিক্ষা নৃত্যগুরু শ্রীলেখা মুখোপাধ্যায়ের কাছে। পরে তিনি তালিম নেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, গুরু রামমোহন মিশ্র, চিত্রেশ দাস, বেলা অর্ণব, বন্দনা সেন, শাশ্বতী সেন এবং পণ্ডিত বিজয়শঙ্করের কাছে। তালের জন্য তালিম নেন পণ্ডিত কুমার বসুর কাছে। সন্দীপ অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করেছিলেন শিব ও কৃষ্ণের কথা— নটরাজ-নটবর। নৃত্য পরিকল্পনা ও পরিচালনা (সন্দীপ মল্লিক) দর্শককে আকৃষ্ট করে। পোশাকের ভাবনাও সুন্দর। নৃত্যে তাঁর সঙ্গে ছিলেন মন্দিরা পাল, সুশান্ত ঘোষ, সৌরভ পাল, দেবজ্যোতি নস্কর, শুভদীপ সাউ, শ্রেয়া কর, মেঘমালা দাস, প্রিয়দর্শিনী সান্যাল, সায়রী ভুনিয়া, ঐশিকা ঘোষ, জয়া দত্ত, ঈশিকা দাস।
সন্দীপের পরে কীর্তি রামগোপালের ভরতনাট্যম। কীর্তি ছোটবেলা থেকে নৃত্যশিক্ষা করেন পদ্মিনী রামচন্দ্রনের কাছে। পরবর্তী কালে প্রিয়দর্শিনী গোবিন্দ, এ. লক্ষ্মণ ও ব্রাঘা বোসলের কাছে নৃত্য এবং নৃত্যাভিনয় শিক্ষা করেন। তাঁর প্রথম নিবেদন মল্লারি (আদি তালে নিবদ্ধ) সহজেই দর্শককে আকৃষ্ট করে। দ্বিতীয় নিবেদন মধুরম মাধবম-এর (রাগ— হিন্দোলি, তাল— আদি) অভিনয় নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। নৃত্য এবং অভিনয়ের এমন যুগল মিলন সচরাচর চোখে পড়ে না। সর্বশেষ নিবেদন ছিল জয়দেবের অষ্টপদী— সখী হে কেশী মদন মুদারম। এটির উপস্থাপনাও সুন্দর, কিন্তু পরপর দু’টি অভিনয়প্রধান নৃত্য একটু একঘেয়ে লেগেছে।
শেষ অনুষ্ঠান ওড়িশি। শর্মিলা মুখোপাধ্যায় ও তাঁর প্রতিষ্ঠান অঞ্জলি অনসম্বলের শিল্পীদের উপস্থাপনা। শর্মিলা আশির দশকে গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে কলকাতা এবং কটক ও ভুবনেশ্বরে গুরুগৃহে নিরলস নৃত্যশিক্ষা করেন। সে দিন তাঁর প্রথম নিবেদন ছিল সরস্বতী বন্দনা। রাগ— হংসধ্বনি, তাল— একতালি। দ্বিতীয় নিবেদন দরবারি রাগে আধারিত তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা— বিশারিণী। তৃতীয় ও শেষ নিবেদন ছিল কবি কালিদাস রচিত ‘ঋতুসংহার’ অবলম্বনে তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা— শিশির। তাঁর সহশিল্পীরা ছিলেন সুরজিৎ সোম, সুরঞ্জনা অ্যান্ডু, কণিকা মিত্র, প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুরাধা ঘোষ এবং অনুশ্রী পদ্মনাভ। সুন্দর পোশাক ও নৃত্য পরিকল্পনা। সহযোগী শিল্পীদের নৃত্য ও দক্ষতাও যথাযথ। অভিজ্ঞ নৃত্যশিল্পী শর্মিলা ও অঞ্জলি অনসম্বলের শিল্পীদের নৃত্যানুষ্ঠান দিয়ে ডোভার লেন মিউজ়িক কনফারেন্স ও ডোভার লেন মিউজ়িক অ্যাকাডেমির ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যোৎসবের মধুর সমাপ্তি ঘটে।
শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy