Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
World Dance day

বিশ্ব নৃত্যদিবস উদ্‌যাপন

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মহলার দ্বারা নির্বাচিত ১৮টি নৃত্যগোষ্ঠী তাঁদের সংক্ষিপ্ত নৃত্য নির্মিতি পরিবেশন করেন।

শতাব্দী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৪ ০৯:৫১
Share: Save:

আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস উপলক্ষে গত ২৯ এপ্রিল ওয়েস্টবেঙ্গল ডান্স গ্রুপ ফেডারেশন কলকাতার মহাজাতি সদনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও জাতিগত বিভেদের ঊর্ধ্বে নৃত্যের বিশ্বজনীনতা উদ্‌যাপনের উদ্দেশ্যে ১৯৮২ সালে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট এই দিনটিকে বিশ্ব নৃত্য দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

গত ২৫ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত কেরলের এমএমসি কলারি সংস্থার গুরু অজিত কুমারের তত্ত্বাবধানে বিশেষ নৃত্য কর্মশালা আয়োজিত হয় মৃত্তিকা, ডান্সার্স গিল্ডের ভবনে। কালারিপায়াতু কেরলের একটি যুদ্ধ নৃত্যশৈলী। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে এই কর্মশালার শিক্ষানবিশরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণের কিছু অংশ তুলে ধরেন। গুরু অজিত কুমার ও তাঁর দলের শিল্পীদের, বিশেষত কিশোরীদের লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, অসিচালনা দর্শককে সম্মোহিত করে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী পূর্ণিমা ঘোষ, পলি গুহ, অমিতা দত্ত, পার্বতী গুপ্ত, প্রদীপ্ত নিয়োগী, মমতাশঙ্কর।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মহলার দ্বারা নির্বাচিত ১৮টি নৃত্যগোষ্ঠী তাঁদের সংক্ষিপ্ত নৃত্য নির্মিতি পরিবেশন করেন। পার্বতী বাউলের রচনায় ও গানে, ড. সোনালি বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ও সঞ্জীব সমাদ্দারের পরিপাটি নৃত্যবিন্যাসে পরিবেশিত হয় বেলুড় শিঞ্জিনীর নিবেদন কৃষ্ণ-উপাসনা ‘ওহে জীবনবল্লভ’। এর পর সৃজন ওড়িশি ডান্স সেন্টার কবিগুরুর গানে, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর পরিচালনায় ও শৌনক চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে পরিবেশন করে সহজ-সুন্দর ‘আনন্দ তরঙ্গ’। এ দিন ধীমান রায়ের পরিচালনায় প্রাঙ্গণ নৃত্যগোষ্ঠীর পরিবেশনায় ছিল ঋতুরাজ ‘বসন্ত’। টুম্পা দে-র পরিচালনায় পায়েল নৃত্য অ্যাকাডেমি উপস্থাপন করে কবিতা-গানের কোলাজে নৃত্যনির্মিতি ‘হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা’। আবার ‘সাইকেল কাব্য’, এক অন্য রকম অতীত-আর্তি, পরিবেশন করে সুস্মিতা নন্দী শেঠিয়ার পরিচালনায় কলাপী নৃত্য সম্প্রদায়। পৃথক উল্লেখের দাবি রাখে অমৃতা ভট্টাচার্যের পরিচালনায় মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানি পরিবেশিত ‘আবর্ত: দ্য প্যাসেজ অব টাইম’, যা বহমান সময়ের কোলে সযত্ন লালিত জীবনের এক চলচ্চিত্র।

সামগ্রিক ভাবে এই দিনের উপস্থাপনাগুলি বৈচিত্র এবং বর্ণময়তায় ছিল অনবদ্য। এক দিকে যেমন ছিল সত্যজিৎ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ‘নব নব সৃষ্টিতে সত্যজিৎ’, পরিচালনায় শম্পা ভট্টাচার্য ও পরিবেশনায় বেলুড় নৃত্যাঙ্গন। অন্য দিকে তেমনই শ্যামল মল্লিকের পরিচালনায় অবন্তিপুর ওম ফাউন্ডেশনের উপস্থাপনা ছিল ‘ধ্রুবতারা’, যার উপজীব্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন ও সংগ্রামের কাহিনি। আবার সলিল চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে শর্মিলা মণ্ডল ও রাজকুমার মণ্ডলের পরিচালনায় সৃজন শোভা নৃত্যগোষ্ঠীর বিশেষ প্রতিভাসম্পন্ন কিশোর-কিশোরীরা পরিবেশন করে ‘গাঁয়ের বধূ’। এটি ১৯৪৩ সালে সংঘটিত বাংলার দুর্ভিক্ষের উপরে আধারিত এই কিংবদন্তি সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গীতায়োজনের নৃত্যরূপ।

প্রতাপ রায়ের পরিচালনায় প্রস্ফুটন নৃত্যগোষ্ঠী তাদের উপস্থাপনার বিষয়বস্তু নির্বাচন করে বাংলার এক চৈতি উৎসব চড়ক-কে। একাধিক গাজন সঙ্গীত অবলম্বন করে তারা নিবেদন করে ‘মহাদেবের চরণে’। আবার শাক্তপদাবলির শ্যামা ও বৃন্দাবনের শ্যামের সম্মিলিত রূপ ও অভিন্নতাকে অবলম্বন করে পুরুষোত্তম নন্দীর পরিচালনায় নাদ-ব্রহ্ম নৃত্যগোষ্ঠী নিবেদন করে ‘কৃষ্ণ-কালী’। এ ছাড়া নৃত্য উপাসনা গোষ্ঠী উপস্থাপন করে ‘রামায়ণ’, পরিচালনায় কাশ্মীরা সামন্ত।

রাতুলশঙ্কর ঘোষের আবহ নির্মাণে জয়দীপ পালিতের পরিচালনায় হৃতাল ডান্স সেন্টার নিবেদন করে ‘ইন্দ্রসভা- দি সেলেস্টিয়াল’। ব্রহ্মকমল নৃত্য এবং চিত্র সংস্থা সাবর্নিক দে-র পরিচালনায় মঞ্চায়িত করে ‘বিহাইন্ড দ্য গোল্ডেন মাস্ক’। প্রাচীন মিশর যেন ইতিহাস বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে উঠে এসে মঞ্চে চিত্রকল্প রচনা করে। আর এক রহস্যাবৃত রূপকল্প নির্মিত হয় শুভজিৎ খুশ দাস পরিচালিত শুভাঙ্গিকের ‘দ্য প্রাইমর্ডিয়াল হুইস্পার’ প্রযোজনায়, বিষয়— রাতের গভীরে ভারতের প্রাচীন দেবস্থানগুলিতে মহাদেবের অতিপ্রাকৃত আরাধনার কল্পনা।

বিষয় নির্বাচন ও মঞ্চসজ্জার নিরিখে বেশ কিছু প্রযোজনায় নৃত্যের মধ্যে উপস্থিত নাট্যগুণ বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। উল্লেখযোগ্য সাহানা নৃত্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি ‘মেঘমল্লার’-এর নৃত্যরূপ। সুরদাস তথা কাপালিক গুণাঢ্যের ভূমিকায় পরিচালক রুদ্রাভ নিয়োগীর অভিনয় চমৎকার।

নৃত্য কেবলই দক্ষতাবর্ধক, আনন্দদায়ক এক ক্রিয়া বা ক্রীড়া নয়, এর সামাজিক মূল্যও অনেকখানি। এ দিনের অনুষ্ঠানের যাত্রা প্রাগৈতিহাসিক থেকে আরম্ভ হয়ে ইতিহাস ছুঁয়ে আধ্যাত্মিকতা ও কল্পনাকে আশ্রয় করে সামাজিক অবক্ষয় ও পীড়ার গল্প পৌঁছে দিতে চেয়েছে দর্শকের কাছে। সৌরভ মণ্ডলের তত্ত্বাবধানে ইউনিকর্নস ডান্স কোম্পানি এ দিন পরিবেশন করে ‘অস্তিত্ব’। মৌসুমী ভৌমিকের গানে এই প্রযোজনার উপজীব্য বিষয় বাংলায় সাম্প্রতিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, বিতর্ক, অবিচার ও ক্ষয়। এ ছাড়াও রুদ্র মিশ্র ও স্বর্ণাভ মিশ্রের পরিচালনায় আলোর পাখি সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস নিবেদন করে ‘ভুবন জোড়া নকশি কাঁথা’। জসীমউদ্দিনের লেখা ‘নকশী কাঁথার মাঠ’-এর ধর্মীয় দাঙ্গা প্রসঙ্গ থেকে তারা পৌঁছে যায় ইউক্রেন, গাজ়া, সিরিয়া ও কারাবাখে সংঘটিত সংগঠিত যুদ্ধ-প্রসঙ্গে। প্রেম থেকে প্রেমহীনতার এই যাত্রা ফিরে আসবে সেই প্রেমে— এই আশায় তারা বুক বাঁধে।

সমগ্র অনুষ্ঠানটি সুদক্ষ ভাবে সঞ্চালনা করেন ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী অর্কদেব ভট্টাচার্য। আলোকসম্পাতে ছিলেন নীতা নস্কর।

অন্য বিষয়গুলি:

Dance Programme
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy