মনোময় ভট্টাচার্য ও ইন্দ্রানী সেন
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হল দু’দিনব্যাপী ‘দুই শিখর’ শীর্ষক স্মরণ অনুষ্ঠান। বরণীয় সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় এবং প্রবাদোপম সঙ্গীত পরিচালক ও সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষের স্মরণে অনুষ্ঠান। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানের শুরুতে স্মৃতিচারণ করলেন সঙ্গীতশিল্পী শিবাজি চট্টোপাধ্যায়, সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ এবং দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের পুত্র দেবকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীতজীবন ছয় দশক ধরে ব্যাপৃত ছিল। তিনি যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীতে দক্ষ ছিলেন, সেই সঙ্গে তাঁর বাংলা আধুনিক গানও আমাদের বাংলার সঙ্গীত জগৎকে ভীষণ ভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর রেকর্ডের সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি, যার মধ্যে আটশো শুধুই রবীন্দ্রসঙ্গীত। বেশ কিছু ছায়াছবিতেও তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। পেশাদার শিল্পী হিসেবে তিনি প্রথম রেকর্ড করেন ১৯৪৫ সালে। আইপিটিএ-তে যোগদান করার পর ওঁর সঙ্গে প্রখ্যাত সুরকার সলিল চৌধুরীর যোগাযোগ হয়। সলিল চৌধুরী সেই পর্বে দ্বিজেনবাবুকে দিয়ে গাওয়ান ‘শ্যামলবরণী ওগো কন্যা’, ‘ক্লান্তি নামে গো’, ‘একদিন ফিরে যাব চলে’, ‘পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী’। সব ক’টিই সুপার হিট গান। বিশেষত ওঁর হিট গানগুলি সাজিয়েই এই স্মরণ অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সমবেত রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর / তুমি দেহো মোরে কথা, তুমি দেহো মোরে সুর’ পরিবেশন করল উত্তরায়ণী গোষ্ঠী। গানটি পরিবেশনের সময়ে কেউ খাতা দেখে গাইলেন না। ব্যাপারটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। পরিচালনায় ছিলেন সোনালি মুখোপাধ্যায়। শান্তনু রায়চৌধুরী গাইলেন ‘একদিন ফিরে যাব চলে’। শিল্পী গানটি প্রথমে মুক্তচ্ছন্দে গাইলেও, শিবাজি চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে পুনরায় ছন্দে গাইলেন। এই ধরনের অনুষ্ঠানে গানের মৌলিকত্ব বজায় রেখে গাওয়া উচিত। মধুঋতু চক্রবর্তী শোনালেন সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে ‘সজল সজল মেঘ করেছে আকাশে’। স্বচ্ছন্দ উপস্থাপনা। ব্রহ্মতোষ চট্টোপাধ্যায় শোনালেন ‘পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী’। কণ্ঠ বশে না থাকায় গানটি সুখশ্রাব্য হয়ে উঠল না। ভাল লাগল তৃষা পাড়ুইয়ের কণ্ঠে গীতিকার ভাস্কর বসু রচিত ও নচিকেতা ঘোষ সুরারোপিত ‘ভাঙা তরীর এ গান’। সুন্দর উপস্থাপনা।
পরের শিল্পী বিশ্বজিৎ দাশগুপ্ত শোনালেন রঞ্জিত দে’র কথায় ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছ’। গানটির অভিব্যক্তি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠল শিল্পীর সুরেলা কণ্ঠে। অগ্নিভ বন্দোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘শ্যামলবরণী ওগো কন্যা’ গানটির মুড সে ভাবে ধরা পড়ল না। বর্তমান প্রজন্মের শিল্পী অরিত্র দাশগুপ্তের কণ্ঠে ‘সাতনরি হার দেব’ চমৎকার লাগল। গীতিকার শ্যামল গুপ্তের কথায় ও নচিকেতা ঘোষের সুরে শীর্ষ রায় শোনালেন ‘ঘুম ঘুম ঘুম, মেঘলা মনটা’। গানটির শেষে ষড়জের যে পরিবর্তন ছিল, সেটি না গাওয়ায় গানটি সম্পূর্ণ হল না।
এ দিনের অনুষ্ঠান শেষ হল শিবাজি চট্টোপাধ্যায়ের গান দিয়ে। তিনি গাইলেন, ‘ওরে আমার মন, কিসের তরে দেয় না ধরা ভালবাসার ধন’। গানের অভিব্যক্তি চমৎকার হলেও, কণ্ঠমাধুর্যে গানটি শুনতে ভাল লাগলেও, গান শুনে মনে হল— গানটি তিনি তৈরি করে আসেননি।
দ্বিতীয় দিন ছিল অসামান্য সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষের গান নিয়ে অনুষ্ঠান। তাঁরই উত্তরসূরি সুপর্ণকান্তি ঘোষ শোনালেন কিছু জানা ও কিছু অজানা তথ্য তাঁর পিতৃদেব সম্পর্কে। গানের ফাঁকে ফাঁকে সুপর্ণকান্তির সরস এবং সাবলীল উপস্থাপনা সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে ঘরোয়া করে তুলেছিল। এর ফলে অনুষ্ঠানটি আরও উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল।
এ দিনের অনুষ্ঠানের প্রথম শিল্পী ছিলেন নবীন কণ্ঠ তৃষা পাড়ুই। তিনি গাইলেন, ‘মেঘলা ভাঙা রোদ উঠেছে’। সুন্দর উপস্থাপনা। ‘এক বৈশাখে দেখা হল দুজনায়’ গেয়ে শোনালেন ইন্দ্রাণী সেন। তাঁর কণ্ঠে গানের অভিব্যক্তি মনকে আবিষ্ট করে। পরের শিল্পী ছিলেন সন্দীপ চক্রবর্তী। তিনি শোনালেন, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’। গানটি সুখশ্রাব্য। এর পর মঞ্চে এলেন শম্পা কুণ্ডু। তিনি শোনালেন ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’ ও ‘মনের নাম মধুমতী’। দ্বিতীয় গানটি চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করলেন শিল্পী। এর পর ‘নিশিপদ্ম’ ছায়াছবির গান ‘রাজার পঙ্খী উইড়া গেলে’ শোনালেন সৈকত মিত্র। গানের অভিব্যক্তি গানটিকে একটি অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল।
নচিকেতা ঘোষের কন্যা শ্রাবণী ঘোষ শোনালেন দু’টি গান—‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’ ও ‘নদীর যেমন ঝরনা আছে’। গান দু’টিতে অনুশীলনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। মনোময় ভট্টাচার্য শোনালেন ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক’। গানের অভিব্যক্তি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠল শিল্পীর কণ্ঠে। অরুণিমা ভট্টাচার্য ও সিকুতা চক্রবর্তী শোনালেন ‘ছোট্ট পাখি চন্দনা’। এ বার মঞ্চে উঠলেন ইন্দ্রনীল সেন। দু’টি গান ‘চলো রিনা ক্যাসুরিনা, ছায়া গায়ে মেখে’ ও ‘এক তাজমহল’। আসর মাতিয়ে দিয়ে গেলেন তাঁর কন্ঠমাধুর্যে। স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত শোনালেন দু’টি গান। ‘তোমায় আমায় প্রথম দেখা’ ও ‘জলে নেমো না, আর থই পাবে না’। আধুনিক গানেও শিল্পীর দক্ষতা কতখানি, দ্বিতীয় গানটি তা বুঝিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানের শেষভাগে তরুণ শিল্পী অরিত্র দাশগুপ্ত শোনালেন ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছায়াছবির গান ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’ ও ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’। শিল্পীর কণ্ঠে দু’টি গানই শুনতে খুব ভাল লাগল।
অনুষ্ঠানের শেষ গান নচিকেতা ঘোষের অনবদ্য সৃষ্টি ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’। অনুষ্ঠানে যন্ত্রানুষঙ্গ পরিচালনায় ছিলেন সুরজিৎ চক্রবর্তী। তাঁর ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে যাঁরা যন্ত্রসঙ্গীতে সহযোগিতা করেছেন, তাঁরা হলেন— লিড গিটার পার্থ চক্রবর্তী, তবলা সমুদ্রনীল চক্রবর্তী, কিবোর্ড সুরজিৎ চক্রবর্তী, বেস গিটার প্রবীর মল্লিক, অক্টোপ্যাড রাজু গঙ্গোপাধ্যায়, ঢোল ও হ্যান্ডসনিক শুভেন্দু পাল। এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy