Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি একটি অধ্যায়। দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে তাঁর কর্মপদ্ধতি এক দৃষ্টান্ত। শুধু বিদ্রোহ নয়, তাঁর ব্যক্তিজীবনও রোমাঞ্চকর। স্ত্রী’র সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়নটিও হতে পারে চর্চার বিষয়। তিনি রাসবিহারী বসু।
Rash Behari Bose

দ্রোহ ও প্রেমের নিশান রাসবিহারী

দেশে নানা কাণ্ড ঘটিয়ে ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে, রাসবিহারী পা দিয়েছেন, জাপানের কোবেতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সচিব’ (মতান্তরে আত্মীয়) প্রিয়নাথ ঠাকুর পরিচয় দিয়ে!

রাসবিহারী বসু।

রাসবিহারী বসু।

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:০০
Share: Save:

শরীরে যক্ষ্মা, নিউমোনিয়ার ছোবল। বিছানায় লগ্ন, বছর ২৮-এর যুবতীটি। শীর্ণ হাতটি বোমা-পিস্তলে অভ্যস্ত, সুঠাম চেহারার এক বাঙালির হাতে ধরা। শ্রান্ত ভাবে সংস্কৃত মন্ত্র আওড়ে যান বাঙালিটি। যুবতীটি ওই অবস্থাতেও চেষ্টা করেন সঙ্গত দিতে। এ ভাবেই ঘুমের সাগর পাড়ি দিলেন যুবতীটি। ইংরেজের বুক কাঁপানো বাঙালির চোখেও কি তখন জল?

জামাইকে বললেন শাশুড়ি, এই তো বয়স। আবার বিয়ে করো। মানুষটির জবাব, ‘ওই আট বছরের নির্জন জীবনের মতো তোশিকো চিরকাল আমার কাছেই থাকবে। আমার আর কিছু চাই না।’— কিছুই চাননি তোশিকো সোমা পরে বসু নামে পরিচিত ওই যুবতীটিও। আর চাননি বলেই, তাঁর পরিচিতি, ‘দ্য লিভিং ফ্লেশ শিল্ড টু দি ইন্ডিয়ান ইন এগজ়াইল’। ‘ইন্ডিয়ান’টি রাসবিহারী বসু।

দেশে নানা কাণ্ড ঘটিয়ে ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে, রাসবিহারী পা দিয়েছেন, জাপানের কোবেতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সচিব’ (মতান্তরে আত্মীয়) প্রিয়নাথ ঠাকুর পরিচয় দিয়ে! প্রথমে কোবে, সেখান থেকে টোকিয়ো। টোকিয়োয় আলাপ আর এক মহাবিপ্লবী সান ইয়াৎ সেনের সঙ্গে। পরিচয় হল সামুরাই নেতা তোয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গেও। কিন্তু আচমকা জাপানে লালা লাজপত রায়ের একটি সভার সৌজন্যে, ইংরেজ সরকারের চাপে জাপানে রাসবিহারী নির্বাসিত হলেন। মূলত তোয়ামার ব্যবস্থাপনায় আইজো সোমার বাড়িতে উঠলেন রাসবিহারী।

কেক-বিস্কিটের অভিজাত দোকান-বাড়ি শিন্জুকু শহরের ‘নাকামুরায়া’। সেটিরই মালিক আইজো আর তাঁর স্ত্রী কোক্কো। সারাক্ষণ ভয়ে-ভয়ে থাকে পরিবারটি। ৪৫ দিন হয়ে গেল, বাড়ির পিছনে রুটি কারখানার পরিত্যক্ত গুদামে লুকিয়ে নির্বাসিত রাসবিহারী ও হেরম্বলাল গুপ্ত। হেরম্বলাল কিছু দিন পরে অন্যত্র আত্মগোপন করেন। রাসবিহারী এখানেই থেকে যান। কুড়ি ছোঁয়া যুবতী তোশিকোও ভয় পান, ছেলেটি যদি ধরা পড়ে!

নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে নির্বাসন উঠল। প্রকাশ্যে বেরোলেন রাসবিহারী। কিন্তু বিদায় যে বড় কষ্টের। মুহূর্তের আখর বোনেন কোক্কো। জানাচ্ছেন, প্রবল মানসিক যন্ত্রণায় তাঁর বুকের দুধ শুকিয়ে যায়। দুধ না পেয়ে মারা যায় সদ্যোজাত কন্যা। কিন্তু তবু ওই বাঙালি ছেলেটি মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে। কোক্কো ভাবেন, ‘...ওঁর চলে যাওয়া দেখে কান্না সামলাতে পারিনি। সে দিনই ভারত-আত্মার সঙ্গে যুক্ত হলাম। পণ করলাম, ভারতের এই বিপ্লবীটিকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করব।’

কিন্তু বাস্তব যে বড্ড কঠিন। নাকামুরায়া থেকে আজ়াবু— পর পর বাসা-বদল রাসবিহারীর। গোয়েন্দাদের নজরে সোমা পরিবার। হাল বার করলেন তোয়ামা। সোমা দম্পতির কাছে তাঁদের বড় মেয়ে তোশিকোর সঙ্গে রাসবিহারীর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। এতে সুবিধা হবে। জাপানি নাগরিকত্বও পাবেন রাসবিহারী।

তবে, সম্ভ্রান্ত পরিবারের তোশিকোর তখন জাপানি শিক্ষিত যুবক-মহলে ঊর্ধ্বমুখী কদর। পুলিশের তাড়া খাওয়া, কপর্দকশূন্য এক বিদেশি নাকি হবে ওঁর বর! তোশিকো ভাবার জন্য তিন সপ্তাহ সময় নিলেন। পরে বললেন, ‘মিস্টার বোসকে বিয়ে করব। ওঁকে রক্ষা করব।’ আর রাসবিহারীর উক্তি, ‘বিপ্লবই আমার ধ্যানজ্ঞান। বিয়ের কথা ভাবিনি। তবে মিস্টার তোয়ামা যদি এটাই চান এবং মিস তোশিকো যদি রাজি থাকেন, তা হলে বিয়ে করব।’ ১৯১৮-র ৯ জুলাই গোপনে, তোয়ামার বাড়িতে চার হাত এক হল।

কোক্কো জানান, তাঁর মেয়ে-জামাইয়ের আট বছরের দাম্পত্যে ১৭ বার বাড়ি বদল করতে হয়। বাড়িতে খাবার বাড়ন্ত। সর্বদা পুলিশ-গোয়েন্দার নজর। রাসবিহারী অন্তর্দ্বন্দ্বে দগ্ধ। তোশিকোকে এমন জীবনে টেনে আনার অধিকার যে তাঁর নেই। এক দিন চিবায় সাগরপাড়ের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করে বসলেন স্ত্রীকে, ‘বিয়ে করেছ। ভালবাসতে পেরেছ কি?’ স্বল্পভাষী তোশিকোর চোখ তখন সিক্ত। রাসবিহারীর এ বার জিজ্ঞাসা, ‘আমার জন্য জীবন দিতে পারো?’ কথা না বলে, মুহূর্তে তোশিকো সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে গেলেন। জড়িয়ে ধরলেন রাসবিহারী। এ সবের মধ্যেই স্ত্রীকে কখন যেন শেখালেন বাংলা, বাঙালির শাড়ি পরা, বাঙালির রান্না। তোশিকো একটি যাযাবর জীবনকে দিলেন, শান্তির নিবিড় পরবাস। সাহায্য করলেন জাপানের নাগরিকত্ব পেতে।

এই একাত্মবোধ এখনও প্রবহমান। টোকিয়োর তামা শ্মশানে তোশিকোর সমাধির উপরেই রয়েছে রাসবিহারীর সমাধি। দু’জনের স্বল্প-দাম্পত্যে আলো করে আসে ছেলে মাশাহিদে, যাঁর ভারতীয় নাম ভারতচন্দ্র ও মেয়ে তেৎসুকো।

(২)

কিন্তু এই জাপান-পর্বের আগে ভারতের মাটিতে ঘটনাবহুল অধ্যায় রয়েছে রাসবিহারীর। তাঁর জন্মস্থান, বর্তমান পূর্ব বর্ধমানের রায়নার সুবলদহ গ্রামে। ২৫ মে, ১৮৮৬-তে। বাবা, বিনোদবিহারী। মা ভুবনেশ্বরী দেবী। জন্মের তিন বছরের মধ্যেই মায়ের মৃত্যু। গ্রামের পাঠশালায় রাসবিহারীর পড়াশোনা শুরু। সেই সঙ্গে ঠাকুরদা কালীচরণের তত্ত্বাবধানে চলে সাঁতার, নৌকা চালনা আর লাঠি খেলা। বিনোদবিহারী তখন শিমলায় কাজ করেন। বিনোদবিহারী দ্বিতীয় বার বিয়ে করে চন্দননগরে উঠলেন। এলেন রাসবিহারী ও তাঁর বোন সুশীলা। বিনোদবিহারীর এই দ্বিতীয়া স্ত্রী-ই রাসবিহারীর জীবনে ‘মা’। এখানেই বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি স্কুলে রাসবিহারীর পড়াশোনা। ‘ডবল প্রোমোশন’ প্রাপ্তি। স্কুলেও বন্ধুদের মধ্যে নেতৃত্ব স্থানীয়।

কিন্তু সে স্কুলে একদিন বিপর্যয়। জনশ্রুতি, ‘সতেরো জন ঘোড়সওয়ার নাকি বাংলায় ইসলামি শাসনের পত্তন করেন!’ এটা রাসবিহারী বিশ্বাস করেননি। আর তা বিশ্বাস করেননি বলে স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক নাকি তাঁকে খুব বকাবকি করেছেন। রাসবিহারী আর ওই স্কুলে গেলেন না। পরে, কলকাতার মর্টন বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।

তবে কৈশোর থেকেই রাসবিহারী দুর্দান্ত। বঙ্গভঙ্গের কালে দেখা গেল, রাসবিহারী বাড়িতে তিনটি চরকা, তুলো, বিড়ির পাতা ও মশলা নিয়ে হাজির। বাড়িতে হুলস্থুল। রাসবিহারী জানালেন, সুতো পাকানো হবে। কাপড় বোনা হবে! বিড়ি বাঁধা হবে।

আচমকা একদিন বেপাত্তা। পরের দিন সকালে বাড়ির বাইরে ছিঁড়ে যাওয়া জামাকাপড় গায়ে অসুস্থ রাসবিহারীর দেখা মিলল। কী ঘটেছিল, উত্তর নেই। রাসবিহারী মায়ের কাছে বললেন, ‘আর পড়ব না।’ মা বললেন, ‘কেন রাসি? তুমি তো ভাল ছেলে।’ কথায়-কথায় সে দিন বেপাত্তা হওয়ার কথাটা জানালেন মায়ের কাছে, ‘মা, জানো বাঙালিকে ইংরেজ সেনা হিসেবে নিয়োগ করে না। আমি ওই দিন নাম ভাঁড়িয়ে সেনা হতে গিয়েছিলাম। ধরা পড়ে গেলাম। সেপাইরা মেরে তাড়িয়ে দিল।’

এ ছেলেকে শাসন করা দরকার। ঠাকুরদা কালীচরণ ছাদে বন্ধ করে রাখলেন। মোটা শিকল হারের মতো করে পরিয়ে তাতে তালা ঝুলিয়ে রাসবিহারীর গলায় পরিয়ে দিলেন। পরিত্রাতা, মা। শ্বশুরমশাইয়ের কাছে জোরাজুরি করে রাসবিহারীকে মুক্ত করলেন। বললেন, ‘কী যে কষ্ট দিস, বুঝিস না রাসি!’ রাসি হয়তো বুঝলেন। শুরু হল স্কুলে যাওয়াও। কিন্তু এক দিন বাড়ির সংসার খরচের কিছু টাকা নিয়ে উধাও। বিভিন্ন সেনাছাউনিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শেষে কপর্দকশূন্য হয়ে, বাবার কাছ থেকে টাকা চাইলেন। ফিরলেন রাসবিহারী। কিছু দিন পরে প্রথাগত পড়াশোনায় ইতি।

ঘটনাচক্রে, রাসবিহারীর সেনা হওয়ার ইচ্ছের নেপথ্যে ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত! চন্দ্রগুপ্ত নাকি গ্রিক সেনাদের মধ্যে মিশে গিয়ে তাঁদের যুদ্ধ কৌশল শেখেন। রাসবিহারীরও পরিকল্পনা, ইং‌রেজের যুদ্ধ কৌশল শিখে, তা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা!

এমন দামাল ছেলেকে কী করে সামলাবেন বাবা-মা। বাবা বিনোদবিহারী ছেলেকে শিমলায় নিয়ে গিয়ে কেরানির চাকরি জুটিয়ে দিলেন। এখানেই ইংরেজি, ধ্রুপদ সঙ্গীত, বেহালা বাদনে পারদর্শী হয়ে উঠলেন রাসবিহারী।

কিন্তু রাসবিহারীর মন গড়পড়তা সাধারণের মতো শুধু কলম পিষবে, এমনটা হওয়ার নয়। অ্যাসোসিয়েট প্রেসের সাংবাদিক কেসি রায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। ঠিক করলেন, সাংবাদিক হবেন! হঠাৎ দেখা গেল, সরকারের একটি গোপন নথি সংবাদপত্রে প্রকাশিত। বিনোদবিহারী বুঝলেন, এ কার কাণ্ড। বাবার নির্দেশে চাকরি থেকে পদত্যাগ করলেন রাসবিহারী।

কিছু দিন বাড়িতে থেকেই ফের উধাও। বহু দিন খোঁজখবর নেই। মাঝে নানা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। হঠাৎ বেশ কয়েক বছর পরে, বিনোদবিহারী শিমলা স্টেশনে। আচমকা এক পঞ্জাবি যুবকের উদয়। বিনোদবিহারীর দিকে তাকাচ্ছেন। বিনোদবিহারী বললেন, ‘মহাশয়, আমাকে আপনি চেনেন?’ প্রণাম করে যুবক বললেন, ‘বাবা! চিনতে পারলে না!’ অনেক কথা হল। কিন্তু রাসবিহারী কী করছে, কোথায় আছে, তা ভাঙলেন না। যাওয়ার বেলা বাবার অনুরোধ, ‘একটি বার মায়ের সঙ্গে দেখা করো’। বাবার সঙ্গে সম্পর্কটি নানা খাতে বয়েছে রাসবিহারীর। ছেলে তখন জাপানে। শুনেছেন তিনি এক জাপানি যুবতীকে বিয়ে করেছেন। বোধহয় প্রাথমিক ভাবে মানতে পারেননি। কিন্তু বাবার অর্থকষ্টের কথা জেনে জাপান থেকে রাসবিহারী একশো ইয়েনের চেক পাঠান। বাবাও ছেলেকে পাঠিয়েছেন আমসত্ত্ব, পাঁপড়, লবণাক্ত ইলিশের ডিম, বড়ি!

শিমলায় সে সাক্ষাতের ছ’মাস পরে, একদিন। গভীর রাত তখন। প্রবল শীত। চন্দননগরের বাড়ির দরজায় টোকা, ‘মা, ও মা! আমি! দরজা খোলো’। রাসবিহারী তখন কসৌলিতে পাস্তুর ইনস্টিটিউটে কাজ করেন। যদিও অল্প দিন পরেই দেহরাদূনে বন দফতরের কাজে যোগ দেন। শত বিপদ মাথায় নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন রাসবিহারী। বাবার অনুরোধ, মায়ের টান কোনও দিনই ফেলতে পারেননি যে তিনি। তাই, এক বার বাড়িতে গরু মারা গেলে, মায়ের মনোকষ্ট লাঘবের জন্য অষ্টপ্রহরের বায়না দিতে যান। মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর শ্রাদ্ধকাজ করেন হরিদ্বারে।

শুধু মা নয়, ভাই-বোনের সঙ্গে রাসবিহারীর সম্পর্কটিও বড়ই ছায়ায় জড়ানো। ভাই বিজনবিহারী নতুন ক্লাসে উঠেছেন। মা বললেন, ‘পুরনো বাক্স খুলে দেখ, বইপত্র কিছু আছে না।’ বিষয়টা দেখেই রাসবিহারী বললেন, ‘ওই ডাল-ভাতের পুঁটলি দেখলেই মন দমে যায়।’ কলকাতা থেকে নতুন বই এনে দিলেন ভাইকে। পরে ভাইয়ের সঙ্গে জাপান থেকে নিত্য চিঠিপত্র লেখালিখিও হয়েছে। ভাইয়ের চিঠি থেকেই জানতে পারেন বাবার মৃত্যু-সংবাদ। পারিবারিক ছবি দেওয়া-নেওয়া, ভাইয়ের জন্য তোশিকোর তৈরি মানিব্যাগ, ভ্রাতৃবধূর জন্য জাপানি শাড়ি পাঠানো— ভাইকে যেন বুকে আগলে রেখেছেন রাসবিহারী।

ছোট ভাই-বোনটিকে ঠিক যেমনটি আগলে রাখতেন, মায়ের মৃত্যুর পরে, দেহরাদূনেও। কিন্তু সেখানে ভাই-বোন দেখেন, দাদা বদলে যাচ্ছেন। নানা ধরনের মানুষ আসেন। কী কাজে, কী কথা হয়, বোঝা যায় না। ভাই বিজনবিহারী বিশেষ ভাবে দেখেন, দু’জন ব্রহ্মচারীকে। দাদার রাতে ঘুম নেই। কখনও রাতভর বেহালার ছড় টানছেন। প্রবল জ্বরে পড়লেন রাসবিহারী। জ্বরের ঘোরেও একধ্বনি ‘মা’।

দেশ মায়ের জন্য দেশত্যাগের কিছু দিন আগে, বোন সুশীলার শ্বশুরবাড়ি, ডোমজুড়ের কোলড়া গ্রামে যান রাসবিহারী। রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে বললেন, ‘আসি এ বার। দূর দেশে যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।’ কয়েক ঘণ্টা পরেই শোনা গেল ভারী বুটের শব্দ, পুলিশের আগমন।

(৩)

আদতে পুলিশ, গোয়েন্দা, আইনের মারপ্যাঁচ— ইংরেজের রাষ্ট্র-যন্ত্রগুলির সঙ্গে রাসবিহারীর লুকোচুরিটা অনেক দিনের। দেশে রাসবিহারীর ইংরেজ সরকারকে প্রতিস্পর্ধা জানানোর সব থেকে বড় দু’টি ঘটনা— লর্ড হার্ডিঞ্জ হত্যার ষড়যন্ত্র এবং সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের বীজ বোনা।

আলিপুরের বোমা মামলার পরে, তাঁর দিকে ইংরেজের নজর থাকতে পারে প্রবল ভাবে, এই ভেবেই কলকাতা ছেড়ে দেহরাদূনে বন দফতরে প্রধান কেরানির চাকরিটা নিতে হয়। সেখানে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘাযতীন), অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে লর্ড হার্ডিঞ্জকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হল। ১৯১২-র ২৫ ডিসেম্বর। ইংরেজের প্রতিনিধি হার্ডিঞ্জ মহাসমারোহে দিল্লির চাঁদনি চকে ঢুকছেন। আচমকা বোমা। হার্ডিঞ্জের নিজের কথায়, ‘গুরুতর জখম হই’। মৃত্যু হয় তাঁর এক অনুচরের। ইংরেজ পুলিশ জানতে পারল, এই ঘটনার নেপথ্য মস্তিষ্ক রাসবিহারীর। ধরা পড়ে বোমা ছোড়ার ‘অপরাধে’ ফাঁসি হল নদিয়ার সন্তান, বিপ্লবী বসন্ত বিশ্বাসের।

এই সময়ের একটি জনশ্রুতি রয়েছে। রাসবিহারীর ছবি ছড়িয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ শাসক। জীবিত বা মৃত, খবর দিলেই পুরস্কার। আত্মগোপন করে রয়েছেন। এক দিন ওই বোমা-মামলার শুনানির সময়ে, রাসবিহারী ছদ্মবেশে আদালত-কক্ষে উপস্থিত! কথিত, রাসবিহারী স্বহস্তে লেখা একটি বিবৃতি বিচারকের কাছে পাঠান। বিচারক চিনতে পারলেন, এ রাসবিহারীর হাতের লেখা! মুহূর্তে আদালত কক্ষের সব দরজা বন্ধের নির্দেশ দিলেন বিচারক। কিন্তু রাসবিহারী ততক্ষণে যেন স্রেফ উবে গিয়েছেন!

রাসবিহারী ১৯১২-র আশপাশে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। সে সময় ইংরেজ গুপ্তচরেরা শিক্ষিত যুবক দেখলেই হেনস্থা করছে। রাসবিহারীও শাসকের ঘরের খবর পেতে ডাকঘর, রেল, পুলিশ ও সরকারের অন্য দফতরে স্বদেশি ভাবধারায় অনুপ্রাণিত কর্মীদের নিয়ে কার্যত সমান্তরাল একটি বাহিনী তৈরির চেষ্টা করলেন।

প্রস্তুতি চলতে থাকল আরও বড় পরিকল্পনার। বাঘাযতীন, শচীন্দ্রনাথ সান্যালের সহযোগিতায় পরিকল্পনা, ইংরেজের সেনাবাহিনীর ভারতীয় সেনারা ‘জাতীয় অভ্যুত্থান’ ঘটাবেন। শোনা যায়, এ সময়ে অমৃতসরে বিপ্লবীদের সঙ্গে দেখা করে বিদ্রোহের নিশান কী হবে, তা-ও ঠিক করেন রাসবিহারী। জানান, পতাকার রঙে থাকবে, লাল, সবুজ ও নীল। এগুলি যথাক্রমে হিন্দু, মুসলমান ও শিখদের প্রতীক। বারাণসী, লাহোর, অম্বালা, পঞ্জাব-সহ দেশের নানা প্রান্তের সেনারা অভ্যুত্থানে যোগ দেবেন বলে ঠিক হয়। প্রথমে ২১ ফেব্রুয়ারি, পরে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫-য় অভ্যুত্থানের দিন ঠিক হল। প্রধান লক্ষ্যস্থল হিসেবে নির্বাচন করা হল, লাহোর। রাসবিহারীদের প্রধান দফতর লাহোরেরই চারটি জায়গায় নিয়ে আসা হল। কিন্তু অভ্যুত্থানের অনতিপূর্বে রাসবিহারীদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেল। মাইকেল ও-ডায়ার, লাহোর ষড়যন্ত্র নিয়ে লিখছেন, ‘বিপ্লবী নেতা রাসবিহারী বসু বিপ্লব চালানোর জন্য তাঁর কেন্দ্র পঞ্জাবে সরিয়ে আনলেন। সঙ্গে আনলেন পুণার দুঃসাহসী ব্রাহ্মণ যুবক ভিজি পিঙ্গলেকে।’ খবর পেয়ে ইংরেজ সেনারা বিদ্রোহের সম্ভাবনা দমন করলেন। তবে, বিপ্লবীদের একটি দল লাহোরে ইংরেজ সেনাছাউনিতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। চারটি দফতরের একটি থেকে ১৩ জন বিপ্লবীকে গ্রেফতার করা হল। কিন্তু রাসবিহারীর নাগাল পেল না ইংরেজ।

(৪)

রাসবিহারী ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ছদ্মবেশে। শোনা যায়, ট্রেনে একই কামরায় বসে রয়েছেন পঞ্জাবির ছদ্মবেশধারী রাসবিহারী। হাতে উর্দু পত্রিকা। উল্টো দিকেই বসে এক ইংরেজ সরকারের গোয়েন্দা। ছদ্মবেশ নিয়ে রাসবিহারীর একটি দার্শনিক উক্তি রয়েছে: ‘মানুষের বাইরের রূপটা ছদ্মবেশ। সে ছদ্মবেশেই মানুষ অবিরত ঘুরছেন। তাই সবাই অভিনেতা। সে-ই বড় অভিনেতা, যিনি ‘অতিটা’ বর্জন করতে পারেন।’

রাসবিহারীর নাগাল না পেয়ে, তাঁর মাথার দাম চড়ল ইংরেজের খাতায়, পাঁচ হাজার পাউন্ড! কিন্তু রাসবিহারী তত দিনে সানুকিমারু জাহাজের প্রথম শ্রেণির কামরায় চড়ে জাপানে পাড়ি দিয়েছেন। জাহাজ ছাড়ার মুহূর্তটি রোমাঞ্চকর। খিদিরপুরে জাহাজ ছাড়ার সময়ে, রাসবিহারীর এক সহকর্মী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অস্ত্র রাখবেন কি?’ রাসবিহারীর জবাব, ‘দুর্যোধনের সভায় প্রবেশ করার সময় শ্রীকৃষ্ণ কোন অস্ত্র সঙ্গে নিয়েছিলেন? বহু দিন পূর্বে আমি শ্রীকৃষ্ণে আত্মসমর্পণ করেছি।’

কিন্তু জাহাজ ছাড়ব-ছাড়ব। এমন সময় পুলিশের দল হাজির। জাহাজের সব কেবিন দেখতে শুরু করল তারা। কিন্তু কোনও কারণে রাসবিহারীর কামরা নজরের বাইরে থাকল। রাসবিহারীর জাহাজও ছাড়ল। প্রিয় স্বদেশের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘জানি মা, তোমার কোলে ফিরে তোমার স্নেহধারা পান করা আর হবে না হয়তো। কিন্তু তবুও তোমার মুক্তিই আমার জপ, তপ, ইহকাল, পরকাল। বন্দে মাতরম্।’ রাসবিহারীর এই জাপান-যাত্রা নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত। শোনা যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজের সম্পত্তি বন্ধক রেখে রাসবিহারীকে জাপান যাওয়ার পাথেয় দিয়েছিলেন।

কিন্তু জাপানে এসে, জাহাজে বসে যে সঙ্কল্পটি করেছিলেন, সেটি পূরণ করতে উঠেপড়ে লাগলেন। ‘ভিলা এশিয়ান’ ভোজনালয় তৈরি করা, ‘নিউ এশিয়া’ ও ‘এশিয়ান রিভিউ’-তে কড়া ভাষায় ইংরেজদের সমালোচনা ছিল যার প্রমাণ। জাপানে ভারত সম্পর্কে জনমত গঠনে জাপানি ভাষায় প্রায় ১৬টি বইও রচনা করেন। জাপানে থেকে ক্রিপ্স দৌত্যকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য ভারতীয় নেতাদের আহ্বান জানানো, ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’-এর সভাপতিত্ব করা, ব্যাঙ্ককে সঙ্ঘের কার্যালয়, আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি এবং জাপানের ইচ্ছায় ও তাঁর নিজস্ব আকাঙ্ক্ষায় সুভাষচন্দ্র বসুকে সর্বাধিনায়ক ঘোষণা— জাপানে রাসবিহারীর কর্মকাণ্ডের পরিসরের কথা বলতে গেলে আস্ত বইয়ের দরকার পড়ে। নাকামুরায়ায় রাসবিহারীর রান্না করা ‘কারি’-ও ইংরেজ ‘কারি’কে প্রতিস্পর্ধা জানিয়েছে। এটা ঠিক, রাসবিহারী পরবর্তী জীবনে তাঁর কর্মকাণ্ডে জাপানের সহযোগিতা পেয়েছেন। কিন্তু রাসবিহারী বলেছেন, ‘আমরা স্বাধীন ভাবে কাজ করব। আমরা জাপানের পুতুল নই। ভারত স্বাধীনতা সঙ্ঘের কাজে জাপান হস্তক্ষেপ করবে না।’

কাজের মধ্যে থাকতে-থাকতেই শরীরে বাসা বাঁধল মারণব্যাধি যক্ষ্মা। প্রয়াত হলেন ১৯৪৫-এর ২১ জানুয়ারি, টোকিয়োয় নিজের বাড়িতে।

(৫)

কিন্তু মহাবিপ্লবী, প্রেমিক এই রাসবিহারীকে আমরা কতটা চিনেছি, তাঁর সমকালই বা কতটা চিনতে পেরেছিল, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। দু’দফায় জাপানে প্রবল ভূমিকম্প হয় ১৯২৩-এ। গোটা জাপানে বিপর্যয় নেমে আসে। রাসবিহারীর আশ্রয়স্থলটি ধ্বংস হয়ে যায়। এই বিপর্যয়ে স্ত্রী, আড়াই বছরের পুত্র, আট মাসের কন্যাকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েন রাসবিহারী। দুর্দিনে তিনি বাংলার বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষকে এক হাজার টাকা পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখলেন। শ্রীশচন্দ্র চিঠিটি সংবাদপত্রে প্রকাশ করলেন এই ভেবে, যাতে বেশি টাকা ওঠে। কিন্তু দেখা গেল, টাকা জুটল মোট ১৬ টাকা! রাসবিহারী বিষয়টি জেনে বললেন: ‘আমার ভিতরটা কি কেউ দেখছো, দেশের জন্য সবটা পেতে বসে আছি, সেটা কি কেউ দেখছো? তারা বোধ হয় দেখে, আমি বোমা, রিভলভার, ষড়যন্ত্রের এক মস্ত খেলোয়াড়। তারা আমায় জানবে কেন? ঘুম না ভাঙলে তারা আমায় জানবে কেন? তাদের কাছে টাকা চাওয়া কেন?’

‘ঘুম’ এক জনের ভেঙেছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শান্তিনিকেতনের জাপান সাহায্য তহবিলের সংগৃহীত অর্থ মোট ৬২১ টাকা পাঠিয়ে দেন তিনি। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাসবিহারীর সম্পর্কটিও নানা খাতে বয়েছে। তাঁকে জাপানে সংবর্ধনা দিয়েছেন রাসবিহারী। সপরিবার রাসবিহারীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখাও হয়েছে। রাসবিহারী শান্তিনিকেতনের জন্য চাঁদা তুলে দেন কবিগুরুকে। শ্যালিকা মাকি হোশিকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছেন ফুলসজ্জার বিদ্যা ‘ইকেবানা’ আর চা-অনুষ্ঠান ‘চাদোও’-এর প্রশিক্ষক হিসেবে। কিন্তু তাল কাটে চিন-জাপান যুদ্ধের সময়। ভারতে জাপান-বিরোধী মনোভাব চাগাড় দিয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথও জাপানের আগ্রাসী মনোভাবের বিরোধী। রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত ঘটনা বুঝিয়ে বলার জন্য ফের জাপানে আহ্বান জানান রাসবিহারী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাতে সম্মত হননি।

কিন্তু রাসবিহারীর গুরুত্বটি বুঝতে রবীন্দ্রনাথের কোনও দিনই অসুবিধা হয়নি, জাপান রাষ্ট্রেরও না। জাপানের সর্বোচ্চ রাজকীয় সম্মান পদক দেওয়া হয় রাসবিহারীকে। যদিও রাসবিহারী তা নিতে চাননি। পাশাপাশি, তাঁর মৃত্যুর পরে জাপানের সম্রাট প্রথা ভেঙে রাজ পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যবহৃত শবযান পাঠিয়েছিলেন।

তাঁর সমাধির মাটি দীর্ঘদিন পরে ফেরে জন্মভিটে রায়নার সুবলদহে। আর তাঁর প্রিয় স্বদেশ, ভারতবর্ষে ১৯৬৭-তে একটি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। তবে তাঁর প্রিয় স্বদেশ সম্পর্কে বলে যাওয়া রাসবিহারীর বাণীটি আজও যেন বিশ্বজনীন: ‘সমস্ত জগতের শান্তির জন্য ভারতের স্বাধীনতা একান্ত প্রয়োজন।’ রাসবিহারী কথিত এই স্বাধীনতা হয়তো শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, সর্ব ক্ষেত্রের স্বাধীনতা। রাসবিহারী বসুর স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে ৭৫ পেরোনো স্বাধীনতার কালে এই স্বাধীনতার সঙ্কল্পই আমরা করতে পারি!

তথ্যসূত্র: ‘কর্ম্মবীর রাসবিহারী’: বিজনবিহারী বসু, ‘রাসবিহারী বসু’: জলধর মল্লিক, ‘বোস অব নাকামুরায়া’: তাকেশি নাকাজিমা, ‘রাসবিহারী বসু: হিজ় স্ট্রাগল ফর ইন্ডিয়াস ইন্ডিপেন্ডন্স’: প্রধান সম্পাদক: রাধানাথ রথ, সম্পাদক: সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, ‘ইন্ডিয়া অ্যাজ আই নিউ ইট’: মাইকেল ও-ডায়ার

অন্য বিষয়গুলি:

Rash Behari Bose Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE