Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Artwork

ঝলসানো কিন্তু পোড়া নয়

প্রদর্শনীতে ঢুকেই দু’টি ছবি বিশেষ করে নজর কাড়ে। সে দু’টি হচ্ছে, বাংলাদেশের একজন মজুর শ্রেণির মানুষ যিনি প্যারিসে কাজ করতে গিয়েছেন এবং শুয়ে আছেন ফুটপাতে।

রূপকধর্মী: ইমামি আর্টস্পেসে প্রদর্শিত হল শাহিদুল আলমের কাজ।

রূপকধর্মী: ইমামি আর্টস্পেসে প্রদর্শিত হল শাহিদুল আলমের কাজ।

শমিতা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২২ ০৯:০০
Share: Save:

শাহিদুল আলম তাঁর চার দশকের কাজ নিয়ে সামনে এলেন ইমামি আর্টস্পেসে। ‘সাইনড বাট নট বার্নড’ প্রদর্শনীটি বেশ সুন্দর ভাবে কিউরেট করেছেন ইনা পুরী।

শাহিদুল বাংলাদেশের একজন নামী ফোটোগ্রাফার বা আলোকচিত্রী। ফোটোগ্রাফার হিসেবে শাহিদুলের কাজে প্রধানত দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, ঝড়-ঝাপটা পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি তুলে ধরা। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের অজস্র প্রতিকৃতিও পাওয়া যায় তাঁর কাজে।

প্রদর্শনীতে ঢুকেই দু’টি ছবি বিশেষ করে নজর কাড়ে। সে দু’টি হচ্ছে, বাংলাদেশের একজন মজুর শ্রেণির মানুষ যিনি প্যারিসে কাজ করতে গিয়েছেন এবং শুয়ে আছেন ফুটপাতে। চরম অভাবের শিকার তিনি। তাঁর পায়ের গোড়ালি পুরো ফাটা আর সেই ফাটায় চাঁদের আলো পড়ে অদ্ভুত একটা সোনালি আলোর সৃষ্টি হয়েছে, মনে হচ্ছে গোল্ড ফয়েলে পা’টি মোড়া। সেই ফাটা পায়ে আলো পড়া ছবিটি অদ্ভুত এক মেজাজ সৃষ্টি করে। মনে হয় খুব সাধারণ জিনিসের মধ্যে সৌন্দর্য দেখাই তো শিল্পীর কাজ— ‘বিউটি ইজ় ইন দি আই অব দ্য বিহোল্ডার’। কিন্তু তার সঙ্গে ঠিক তার পাশেই শাহিদুলের তোলা আর একটি ছবি, যেখানে বাংলাদেশের খুব বিত্তশালী এক মানুষ, যাঁর জুতোয় হিরের কাজ করা। ওই কোটি টাকার হিরে বসানো জুতো পরে তিনি বসে আছেন। শিল্পী পাশাপাশি রাখা এই দু’টি ছবিতে একটি রূপক সৃষ্টি করতে চেয়েছেন।

শাহিদুল আলমের পরিচয় শুধু ফোটোগ্রাফার হিসেবেই নয়। তিনি একাধারে লেখক এবং রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। কখনও তিনি রাস্তায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার ছবি মোবাইলে তুলেছেন। যখন ১০১ দিন জেলে ছিলেন ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে, তখনকার কিছু ছবিও দেখা গেল প্রদর্শনীতে। তবে সেগুলি বেশ সাধারণ। খুব একটা নতুনত্ব দেখা গেল না।

শাহিদুলের আরও একটি কাজের কথা না বললে তাঁর কথা বলা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বাংলাদেশের ‘দৃক’ বলে একটি সংস্থার তিনি পরিচালন অধিকর্তা। সংস্কৃত শব্দ ‘দৃক’ থেকে এসেছে ‘দৃষ্টি’ শব্দটি। ১৯৮৯ সালে দৃক ছবির লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা হয়। দৃকের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের নিজস্ব ছবি নিজেদের ফোটোগ্রাফার দিয়ে তুলিয়ে, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। দৃক-বাংলাদেশ এখন এক পুরস্কারপ্রাপ্ত সংস্থা, যেখানে সামাজিক লক্ষ্যকে খুব উঁচু জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে গত ৩০ বছরে, পেশাদার উচ্চমানের সেবা দিয়ে।

এ বারে আসা যাক শাহিদুল আলমের শেষ গল্পটিতে। এর নাম ‘কল্পনার ওয়ারিয়র’ বা সহযোদ্ধা। পাহাড়ি মেয়ে কল্পনা চাকমা ১৯৯৬ সালে ২৩ বছর বয়সে বাংলাদেশি সেনার হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তারপর কল্পনা চিরকালের জন্য লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেলেন। তাঁর কী হল, কেউ তা জানে না। কল্পনা চাকমা চট্টগ্ৰাম পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে প্রায়শই মুখর হতেন। শাহিদুল এই প্রদর্শনীতে একটি ছোট্ট ঘর রচনা করেছেন, যেখানে মাদুরের উপরে অনেক মানুষের মুখ প্রিন্ট করে রেখেছেন। এতে আলো-আঁধারিতে একটা রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। এই মানুষগুলি সব সময়েই কল্পনার বিষয়ে সরকারের কাছে প্রশ্ন করেছেন যে, ‘কল্পনার কী হল?’ কিন্তু কোনও উত্তর তাঁরা পাননি। সেই জন্য এই মুখগুলিতে সমাজব্যবস্থার প্রতি একটা বিরূপতা লক্ষ্য করা যায়। মুখগুলি মাদুরের উপরে ছাপা, কারণ পাহাড়ি মানুষেরা মাদুরের উপরেই সাধারণত ঘুমোন। এই ঘরটিতে একটা রহস্যময় ভাব আছে।

শাহিদুল আলমের ব্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র ও শিল্পচেতনার এক ঝলক আভাস মেলে এই প্রদর্শনীটিতে। সাধারণের মধ্যে অসাধারণকে তুলে ধরার এই অন্তর্দৃষ্টিই তাঁর শিল্পীসত্তার পরিচায়ক।

অন্য বিষয়গুলি:

Artwork Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy