সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। ‘পরিচয়’-এর আড্ডায় সবচেয়ে ‘উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত’ হতেন তিনি, লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু
তোমাদের সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পাঠ্য ছিল?
হ্যাঁ, ছিল তো।
কোন কবিতা? ক’টা কবিতা?
‘শাশ্বতী’টা ছিল মনে আছে। ‘‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে/ ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী...’’ পরীক্ষায় লিখিনি যদিও। আরও ছিল কী কী যেন, ‘উটপাখী’...
বাংলা নিয়ে পড়া এ যুগের এক তরুণীর সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গিয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা— ‘‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ...’’ সুধীন্দ্রনাথ থাকলে নিশ্চয়ই তাঁর অননুকরণীয় শব্দপ্রক্ষেপে অন্য ভাবে বলতেন। বা আদৌ বলতেন কি কিছু? নিজের লেখা সম্পর্কে দুর্বোধ্যতার অনুযোগ যাঁকে সইতে হয়েছে অহরহ, শুনতে হয়েছে ‘‘উনি তো ইংরিজিতে বাংলা লেখেন,’’ তিনি কেমন ভাবে দেখতেন এ কালের পাঠ্যসূচিতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব? কী হত তাঁর পড়ুয়াদের কাঁধ-ঝাঁকানো ‘পরীক্ষায় লিখিনি’ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া? শুনে কি হাসতেন তাঁর অভিজাত, গমগমে হাসিটি? ৬ নম্বর রাসেল স্ট্রিটে তাঁর সাহেবি বাড়ির লেখার ঘরটিতে বসে কি লিখতেন কোনও প্রত্যুত্তর-প্রবন্ধ?
মনে হয় না লিখতেন। কারণ ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই কবি সুধীন্দ্রনাথ ‘চর্চিত’— খুব কম লেখেন বা প্রায় লেখেনই না বলে। শঙ্খ ঘোষের লেখায় আছে তাঁর না-লেখা নিয়ে কথা। ১৯৩৪-৩৭ এই চার বছর কোনও কবিতা লেখেননি সুধীন্দ্রনাথ, ’৪২-৪৪-এ না, ১৯৪৬-৫২ না, আবার ১৯৫৭-৬০’এও না! ১৯৬০-এর ২৫ জুন হঠাৎ-মৃত্যুর আগের ৩৬ বছরে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের প্রধান এক কবির না-লেখার বয়সই ১৮ বছর! সে কালের কলকাতায় কেউ খুব কম লিখলে শঙ্খবাবুর এক কবি-বন্ধু বলতেন, ‘‘আপনি কি তবে সুধীন্দ্রনাথ হতে চান?’’
ছ’টি কবিতার বই, দুটিমাত্র গদ্যের বই। ইংরেজিতে একটি আত্মজীবনী, সেও অসমাপ্ত। আজকের এই তাৎক্ষণিক ও প্রসারসর্বস্ব সৃজনের যুগে, যেখানে একটি মনুষ্যসন্তান বা একটি কবিতার জন্মের পরেই তার চেহারাসুরত ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে হাট করে খুলে দেওয়াটা দস্তুর, সেখানে এইটুকু সাহিত্যপুঁজি নিয়ে কি তল পেতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত? যিনি একটা গোটা সন্ধে (সাত দিন, এমন মতও প্রচলিত) ব্যয় করেছিলেন তাঁর কবিতায় ‘উড়ে চলে গেছে’ শব্দবন্ধকে ‘উড্ডীন’-এ পাল্টে নিতে? আর এক বিখ্যাত কবিতা ‘উটপাখী’ নাকি দু’বছর ধরে ত্রিশ বার পাল্টেছিলেন! তাঁর কবিতার বই ‘সংবর্ত’র প্রকাশক, সিগনেট প্রেস-এর দিলীপকুমার গুপ্তকে লেখা চিঠিপত্র সাক্ষী, নিজের কবিতার ব্যাপারে কী রকম আপসহীন, নিখুঁত ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ। বইয়ের প্রুফ দেখতে গিয়েও তিনি কবিতা সংশোধন করেন নতুন করে, চিঠিতে লেখেন ‘‘পাণ্ডুলিপি আর এই প্রুফ দুটোই প্রামাণ্য... যদি সব শেষের পেজ প্রুফটা একবার পাঠান, এক দিনেই দেখে ফেরত দেব।’’ এও লিখছেন, ‘‘দুর্বোধ্য বলে আমার দুর্নাম থাকাতে সাধারণ প্রুফপাঠক আমার লেখার ভুল শোধরাতে অনেক সময় ইতস্তত করেন। অতএব যদি দরকার মনে করেন, তাহলে আমিই সারা বইয়ের সর্বশেষ প্রুফ প্রেসে গিয়েও দেখে দিতে পারি, যাতে কোথাও অর্থহানি না ঘটে।’’ নিজের লেখা কেটে, ছেঁটে, জুড়ে পাল্টেছেন সারা জীবন; এমনকি যে দীর্ঘ বছরগুলিতে নতুন কিছু লেখেননি, তখনও ক্রমাগত কলম চালিয়েছেন নিজেরই পুরনো লেখায়। ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ’ ও ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’, এই দুটিমাত্র বইয়েই তাঁকে বেঁধে ফেলা গেল ভেবে নিলে এই শব্দশিল্পীর ক্রমাগত ভাঙা-গড়া আর ‘হয়ে ওঠা’র ইতিহাসখানা মিস করে যাওয়ার মতো সর্বনাশটি হবে!
হাতিবাগানের দত্তবাড়ির বড় ছেলেটি হতে পারত মস্ত অ্যাটর্নি বা রাশভারী ‘বাবু অফিসার’। বিশেষত তাঁর বাবার নাম যখন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত— আইনজ্ঞ, বৈদান্তিক দার্শনিক, থিয়োসফিস্ট, জাতীয়তাবাদী। সম্প্রতি রাখিবন্ধন-উৎসবের আবহে ফেসবুকে ভাইরাল হল ১৯০৫-এর কলকাতায় ছড়িয়ে-পড়া সেই বিখ্যাত প্রচারপত্র ‘বঙ্গচ্ছেদে রাখী বন্ধন’, সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিপিনচন্দ্র পালের সঙ্গে জ্বলজ্বল করছে হীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামও। বিত্ত ও আভিজাত্য সুধীন্দ্রনাথের রক্তে— তাঁর পূর্বপুরুষের বাস ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের জমিতে। ইংরেজরা দুর্গ গড়বে বলে দত্তদের জন্য আলাদা জায়গার বন্দোবস্ত করে দেয় চোরবাগানে। সেখানকার যৌথ পরিবার থেকে হাতিবাগানের ঠিকানায় উঠে আসার কাহিনিটিও বেশ। সুধীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা ছেলের বিয়ে দেবেন বলে নতুন দু’-একটি ঘর তুলতে চেয়েছিলেন, অন্য আত্মীয়েরা আপত্তি করায় চটে গিয়ে বাড়িই ছেড়ে দেন। হাতিবাগান-অধ্যায়ের সেই শুরু। বিরাট বাড়ির সদর দরজার সামনে লোহার ‘পুতুল সান্ত্রি’ ছিল বেশ কয়েকটি। তাদের চেহারা আর সাজের বাহার দেখার মতো, লোকে বলত ‘পুতুলবাড়ি’ (এখন শুধু দুটি ‘নিরস্ত্র’ পুতুল লোকচক্ষুর আড়ালে টিকে আছে কোনও মতে, সস্ত্রীক সুধীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত স্মৃতিফলকটিও ম্লান)। সুধীন্দ্রনাথের মামাবাড়িও বিখ্যাত, মা ইন্দুমতী পটলডাঙার বিখ্যাত বসুমল্লিক পরিবারের মেয়ে, রাজা সুবোধ মল্লিকের সহোদরা। সুধীন্দ্র ছোটবেলা থেকে জেনেছেন তাঁর কাকাও দুর্দান্ত অভিনেতা, গিরিশ ঘোষের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়— নট-নাট্যকার অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। যুবকটি প্রতিভাবান হয়েও বাড়িছাড়া, কেননা শুধু থিয়েটার করলে অসুবিধে ছিল না। এ মদ খায়, বহু নারীসঙ্গ করে এবং কোনও লুকোছাপা ছাড়াই। ইন্দুমতী কিন্তু প্রতিভার কদর বুঝতেন, ছেলেকে যে শুধু কাকার অভিনয় দেখতে পাঠিয়েছিলেন তা-ই নয়, দেওরটিকে বাড়িতে ফেরানোর উদ্যোগেও সফল হয়েছিলেন। বাবার প্রজ্ঞা, মায়ের ঔদার্য্য, কাকার প্রতিভা, মামার আভিজাত্য— সব মিশেছিল সুধীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বে।
হীরেন্দ্রনাথ ছেলেকে কাশীতে অ্যানি বেসান্তের থিয়সফিক্যাল স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। সেখানেই ইংরেজি আর সংস্কৃতে সুপাঠ সুধীন্দ্রনাথের। দর্শনপ্রিয়তা, নিয়মনিষ্ঠার শিকড়ও বুঝি সেখানেই। বাকি পড়াশোনা কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে, হীরেন্দ্রনাথ নিজে ছেলেকে কালিদাস পড়াতেন। সংস্কৃত কাব্য-অলঙ্কার পড়ানোর জন্য নিয়োগ করেছিলেন পণ্ডিত হরিচরণ কাব্যতীর্থকে। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ কোর্স শেষ করেননি সুধীন্দ্রনাথ। সেই নিয়েও একটা গল্প প্রচলিত। জিওফ্রে চসারের কবিতার ক্লাস, মাস্টারমশাই সুধীন্দ্রনাথকে চসার পাঠ করতে বলেন। সুধীন্দ্রনাথ এক দিন করলেন, দু’দিন করলেন, তিন কি চার বারের বার জোর আপত্তি করলেন, ও রকম উচ্চৈঃস্বরে পাঠ তাঁর ভাল লাগে না। মাস্টারমশাই রেগে নালিশ ঠুকেছিলেন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি সুধীন্দ্রনাথকে ডেকে স্যরের কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন। ছাত্রটি তা করলেন বটে, তবে ক্লাস করায় মন উঠল না আর। এম এ পড়ারও সেখানেই ইতি! বুদ্ধদেব বসু অবশ্য তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকার সুধীন্দ্রনাথ স্মরণ-সংখ্যায় লিখেছিলেন, মতান্তরের কারণ ছিল অন্য— শেক্সপিয়র-ব্যাখ্যা। সুধীন্দ্র এম এ পরীক্ষা দিলেন না, ল’ নিয়ে পড়েছিলেন, সে পরীক্ষাও দেননি। অনেক পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসুর ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ বিভাগে সুধীন্দ্রনাথকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়ে আসায় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর প্রথাগত ডিগ্রিহীনতা। অবস্থা সামাল দেওয়া হয় ‘আংশিক সময়ের অধ্যাপক’ হিসেবে নিযুক্তি দিয়ে। অথচ শুধু যাদবপুর কেন, সারা কলকাতা জানত, তুলনামূলক সাহিত্যে, মালার্মে-ভালেরি-রিলকে-এলিয়টের কবিতা পড়ানোয় সুধীন্দ্রনাথের চেয়ে যোগ্য শিক্ষক এ শহরে আর কে-ই বা ছিলেন? সুধীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর নরেশ গুহকে লেখা বুদ্ধদেবের চিঠিতে আছে ‘আমাদের উজ্জ্বলতম রত্ন’কে হারিয়ে তাঁর আক্ষেপের কথা।
বুদ্ধদেব বসুই লিখেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে, ‘‘তাঁর মতো বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে আর কেউ বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে অগ্রসর হননি।’’ এই বিরাট প্রস্তুতির মধ্যে যেমন ছিল বিপুল পড়াশোনা, সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্রের অগাধ জ্ঞান, ইংরেজি-ফরাসি-জার্মান ভাষার সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপ, তেমনই ছিল কবিতা নিয়ে তাঁর নিরন্তর ভাবনাচিন্তা। এই ভাবনার সন্ধান পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। হিরণকুমার সান্যালের লেখায় আছে, জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তরুণ লিখিয়েদের, ‘শেষের কবিতা’ পড়ে শোনাবেন। পাঠে উপন্যাসের কবি নিবারণ চক্রবর্তীর কবিতার পাশাপাশি উঠে এল ইংরেজি কিছু কবিতাংশও। রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ থেমে অপূর্বকুমার চন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ইংরেজি কবিতা কার লেখা জানো? প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক অপূর্ব বললেন, ঠাহর করতে পারছি না। অদূরেই চুপচাপ বসে ছিলেন এক তরুণ, তাঁর মুখচোখ উজ্জ্বল এক কৌতুকে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি এই ইংরেজি কবিতা ও তার রচয়িতা সম্পর্কে দস্তুরমতো ওয়াকিবহাল। সেই তরুণটি— সুধীন্দ্রনাথ।
বন্ধুপুত্র সুধীন্দ্রনাথকে আগে থেকেই চিনতেন রবীন্দ্রনাথ। সুধীন্দ্র আকৈশোর রুগ্ণ। তার স্বাস্থ্যের বিষয়ে হীরেন্দ্রনাথের মতোই উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথও। চিঠিতে লিখছেন, ‘‘অন্তত দুই এক মাসের মত ভিয়েনার মত কোনো এক জায়গায় গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আস্লে ভালো হত। অন্তত কলকাতার বাইরে কোথাও কিছুকাল যদি কাটিয়ে আসতে পার তাহলে হয়ত কিছু আরাম পেতে।’’ ১৯২৯-এ কানাডা-আমেরিকা সফরে সে জন্যেই কি সঙ্গে নিলেন সুধীন্দ্রনাথকে? বোম্বে থেকে জাহাজ ছাড়ল। জীবনের প্রথম বিদেশ সফর, তাও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে! সুধীন্দ্রনাথ তবু কোনও যাত্রাবিবরণী বা স্মৃতিকথা লেখেননি। দু’-একটি অনুচ্ছেদ পাওয়া যায়, তার প্রসঙ্গ অন্য। কানাডা হয়ে আমেরিকার সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছনোর পর ঘটনাচক্রে প্ল্যান পাল্টে তড়িঘড়ি দেশে ফেরেন রবীন্দ্রনাথ। সুধীন্দ্রনাথ ফেরেননি, আগে থেকেই ঠিক ছিল, তিনি ইউরোপ যাবেন। ছেলের যাবতীয় খরচপত্র দিয়েছিলেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ভিয়েনা আর বার্লিনে তাঁর চেনা ডাক্তারদের কাছে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখে দিয়েছিলেন, সুধীন্দ্রনাথ ডাক্তার দেখাবেন বলে। সেখানেই শেষ নয়। আন-দেশে ভিন-শহরে যাতে তরুণটির কোনও অসুবিধে না হয়, তাই আরও কয়েকটা চিঠি দিয়েছিলেন। পত্রপ্রাপকদের নাম বার্ট্রান্ড রাসেল, লেনার্ড এল্মহার্স্ট, উইলিয়ম রোটেনস্টাইন, রম্যাঁ রল্যাঁ, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো!
এই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই কিন্তু কবিতা নিয়ে চিঠিপত্রে বা সামনাসামনি তর্ক জুড়তে পিছপা নন সুধীন্দ্রনাথ। সেই তর্ক থেকেই পরিষ্কার, কেমন ধরনের কবি হতে চলেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন, ‘‘আমার মনে হয় কাব্যের প্রধান অঙ্গ lyricism নয়, intellectualism এবং এতেই বিভিন্ন মনের আত্মকীয়তার প্রকাশ। কাব্যে intellectualism আনতে হলে প্রাধান্য দিতে হবে চিন্তাকে...’’ প্রথম কবিতার বই ‘তন্বী’র পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। পড়ে তিনি জানালেন, ‘‘কাব্যে তোমার একান্ত স্বকীয়তা আর সমস্ত কিছুকে অতিক্রম করে প্রকাশ পেয়েছে। তোমার কবিতা যেখান থেকেই তার গয়না নিক না রূপ তো তারই— নিজের চেহারা বন্ধক রেখে সে কিছুই ধার নেয়নি।’’ ‘তন্বী’-র পাণ্ডুলিপি সংশোধনও করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার কিছু নিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথ, কিছু মনে ধরেনি তাঁর। কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বীকারে ছিলেন অকুণ্ঠ। ‘তন্বী’র ভূমিকায় লিখেছেন, ‘‘সমস্ত বইখানা খুঁজে যদি কোনওখানে কিছুমাত্র উৎকর্ষ মেলে, তবে তা রবীন্দ্রনাথের রচনারই অপহৃত ভগ্নাংশ বলে ধরে নেওয়া প্রায় নিরাপদ।’’ ‘তন্বী’র প্রকাশ ১৯৩০-এ, তার ন’বছর পর সুধীন্দ্রনাথকে তাঁর ‘আকাশপ্রদীপ’ উৎসর্গ করে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, ‘‘আমার রচনা তোমাদের কালকে স্পর্শ করবে আশা করে এই বই তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের সাধনক্ষেত্র থেকে একে গ্রহণ করো।’’ এক দিন জোড়াসাঁকোয় দু’জনের তর্ক হয়েছিল কবিতার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর গুরুত্ব কতটা, সেই নিয়ে। সুধীন্দ্রনাথের মত, যে কোনও কিছুই হয়ে উঠতে পারে কবিতার বিষয়। রবীন্দ্রনাথ সকৌতুক বললেন, তা হলে মোরগের উপরে কবিতা লেখো! তরুণ কবিটি কিন্তু আত্মবিশ্বাসী, মোরগের উপরে কবিতা তো লিখবেন বটেই, তিনি নিশ্চিত যে তা রবীন্দ্রনাথের বিচারেও সপ্রশংস উতরোবে। পরদিন জোড়াসাঁকোয় এনে দেখালেন ‘কুক্কুট’। কবিতা পড়ে রবীন্দ্র-মন্তব্য, ‘‘না, তুমি জিতেছ।’’ ‘প্রবাসী’-তে ছাপা হয়েছিল ‘কুক্কুট’।
দ্বিতীয় কবিতার বই ‘অর্কেষ্ট্রা’ (পরে ‘অর্কেস্ট্রা’) থেকেই সুধীন্দ্রনাথ নিজের কাব্যভাষায় এবং দর্শনে— সুস্থিত। তাঁর কবিতা পড়ে স্তব্ধ হয় পাঠক। টি এস এলিয়ট-এর মতোই এই কবি বিশ্বাস করেন, কবিতা পড়তে হলে পাঠকেরও কিছু জ্ঞানগম্যি থাকা আবশ্যিক। তিনি লেখেন, ‘‘আজকের এই ‘বিশেষ জ্ঞানে’র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে সেই নিবিষ্ট অনুশীলন ভিক্ষা করি, যেটা সাধারণত অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি।’’ বিশ্বাস করতেন পরিশ্রমে, চর্চায় এবং সংশয়ে। তাঁকে কাছ থেকে দেখা জ্যোতির্ময় দত্ত স্মৃতিকথায় লিখেছেন, সুধীন্দ্রনাথের প্রবণতা ছিল হঠাৎ কলমের মুখে যা এসে গিয়েছে তা নিয়ে সংশয় পোষণ করা। তাঁরই সময়ের কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য ঘরানার কবি জীবনানন্দের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের তেমন মোলাকাত হয়নি কখনও। বরিশালে ব্রজমোহন কলেজের পত্রিকায় আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে লিখতে বসে জীবনানন্দ সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে বেশী নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা।’’ দর্শন যদি বা তর্কাধীন, সুধীন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্য ছিল তর্কাতীত। এক কবির পড়াশোনা কতখানি সুউচ্চ তুঙ্গ স্পর্শ করতে পারে, সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর দৃষ্টান্ত। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘‘আমার সমবয়সী বাঙালী লেখকদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি উত্তরজীবনে বাংলা ও বাংলায় ব্যবহারযোগ্য প্রতিটি সংস্কৃত শব্দের নির্ভুল বানান জানতেন...’’ প্রকাশক দিলীপ গুপ্তকে লেখা সুধীন্দ্রনাথের চিঠিগুলিই প্রমাণ, যেখানে তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত তৎসম/সংস্কৃত শব্দ ও তার অর্থ: ‘অন্যোন্য’=পরস্পর (‘অন্যান্য বা অনন্য-এর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই’), ‘প্রতিবাতে’=প্রতিকূল বায়ুতে, ‘গ্লান’=গ্লানিযুক্ত, ‘অস্থ’=অপ্রতিষ্ঠ, ‘ঝাবুক’=ঝাউগাছ, ‘প্রগল্ভতা’র মতোই ‘প্রাগল্ভ্য’ও অভিধানসম্মত। দেখেশুনে প্রশ্ন জাগে, বাংলা কবিতার ভাব-ভাষা না হয় পাল্টেছে, তবু আজকের কবির লেখার টেবিলে বা কম্পিউটারের পাশে কি বাংলা অভিধান থাকে আদৌ? মাঝেমধ্যে পাতা ওল্টানো হয় তার?
তাঁর বিপুল বৈদগ্ধ্য ও কবিপ্রতিভার পাশেই আসবে তাঁর নিপুণ সম্পাদনার কথা। শুরু করেছিলেন ‘পরিচয়’ পত্রিকা, যার কেন্দ্র তাঁর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি, কেন্দ্রবিন্দুটি সুধীন্দ্রনাথ স্বয়ং। পরিচয়-এর আড্ডার স্মৃতি ধরা আছে অনেকের কলমে। আড্ডায় আসতেন হাসান শাহিদ সুরাবর্দি, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সুশোভন সরকার, হিরণকুমার সান্যাল, শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ, অপূর্বকুমার চন্দ, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বসন্তকুমার মল্লিক, বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আইসিএস অশোক মিত্র, বিষ্ণু দে, যামিনী রায়, বুদ্ধদেব বসু। শেষোক্ত জন লিখেছেন সুধীন্দ্রনাথের বৈঠকখানার ‘নির্মল মেঝে’, ‘গভীর গদির আসন’, ‘আলো-ঠিকরোনো’ চায়ের বাসন আর ‘উচ্চাঙ্গের’ ভোজ্যতালিকার কথা— কোনও দিন ‘উত্তর কলকাতার বৃহদাকার শিঙাড়া সন্দেশ’, কোনও দিন ‘ফার্পো’ রেস্তরাঁর খাবার। লিখেছেন, তারায় তারায় খচিত এই ‘অসঁব্ল’-এর মধ্যে ‘‘সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হন— তাঁর কান্তি নিয়ে, চোখে পড়ার মত সাজসজ্জা নিয়ে— কোনোদিন আধ-হাত-পরিমাণ ধাক্কা-বসানো সূক্ষ্মকুঞ্চিত তাঁতের ধুতি আর কোনোদিন বা কালোর উপরে সোনালী কাজ করা জাপানি কিমোনোর বিলাস নিয়ে— তাঁর সুস্বন কণ্ঠ ও সুস্পষ্ট বাচনভঙ্গি নিয়ে— গোষ্ঠীপতি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।’’ ‘তিন কুড়ি দশ’-এ অশোক মিত্র লিখেছেন, পরিচয়-এর আড্ডা তাঁর কাছে ছিল লিবার্যাল ও হিউম্যানিস্ট আদর্শের প্রতীক। হবেই তো, সুস্থ তর্ক, যুক্তির স্থান যে সেখানে আগাগোড়া। হিরণকুমার সান্যাল লিখেছেন, ‘‘সুধীনের যখন তর্কের নেশা পেত, তখন তার সামনে দাঁড়ায় কে?’’ তর্কে কেউ রেগেমেগে ব্যক্তিগত গালাগাল বা অভদ্র ব্যবহার না করে, আড্ডাকর্তা দেখতেন সেটাও— লিখেছেন অশোক মিত্র। সুধীন্দ্রনাথ আশা করতেন, কথা হবে শাণিত কৌতুকভরা, ভাষায় থাকবে ‘সাহিত্যিক প্রসাদ’। ‘পরিচয়’-এর সম্পাদনাতেও ছিল গভীর মনীষা ও যুক্তির ছাপ। ‘পুস্তক সমালোচনা’র ধারা তখন নতুন, পত্রিকায় সমালোচনার জন্য সুধীন্দ্রনাথ বই আর সমালোচক দুই-ই বাছতেন খুব যত্নে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার বই ‘প্রথমা’র সমালোচনা লিখতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ বললেন, তা হবে না। কবি ও সমালোচক দু’জনেই তো ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর! সুধীন্দ্রনাথ সমালোচনা লেখালেন পরিচয়-ঘরানার লিখিয়ে গিরিজাপতি ভট্টাচার্যকে দিয়ে।
বন্ধুরা কখনও তাঁর মধ্যে ঈর্ষা, অসূয়া দেখেননি। এক বার বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে এসে চোখ পড়ল একটি কবিতার উপরে, কৃষ্ণনগর থেকে পাঠিয়েছে তরুণ এক কবি। পড়ে সুধীন্দ্রনাথের মন্তব্য, ‘‘মাই গড, দিস বয় ইজ় গোয়িং টু বিট আস!’’ কিন্তু বুদ্ধদেব, আবু সয়ীদ আইয়ুবের বক্তব্য, কবিতায় ছন্দের গোলমাল আছে। সুধীন্দ্রনাথ তখন একটা কাগজে কবিতাটা পয়ারের চালে সাজিয়ে দেখালেন, এই কবির ছন্দ নির্ভুল। শেষে বললেন, ‘‘পয়ার ছন্দ যে এ রকম করে লেখা যায়, এটা আমরা কেউ জানতাম না।’’ সুধীন্দ্রনাথের সার্টিফিকেট-পাওয়া সেই কবির নাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
তবু বন্ধুবিচ্ছেদ এসেছে জীবনে। স্ত্রী ছবি দত্ত জীবিতা, অথচ কবি আবার বিয়ে করতে চান লাহৌরের মেয়ে, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা, প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী রাজেশ্বরী বাসুদেবকে, বয়সে যিনি সুধীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক ছোট। এই দ্বিতীয় বিয়ে নিয়েই বন্ধুরা বিমুখ ছিলেন। অনেকে চেষ্টাও করেছিলেন ছবি দত্তের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর। মধুপুর বা অন্য কোথাও বেড়িয়ে আসার পরামর্শ এসেছে, গিয়েওছিলেন সুধীন্দ্রনাথ। যামিনী রায় তো এক বার এক স্টিমার-যাত্রারও আয়োজন করেছিলেন। লাভ কিছু হয়নি। তবে আইনি বিবাহবিচ্ছেদও হয়নি ছবি দত্তের সঙ্গে। তিনি আলাদা বাড়িতে থাকতেন, সে বাড়ি তাঁর নামেই লিখে দেওয়া ছিল, সুধীন্দ্রনাথ পরে তাঁর উইলেও তাঁর জন্য অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। রাজেশ্বরী দত্তকে বিয়ে করার পর সুধীন্দ্রনাথের অনেক বন্ধু সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেদের। সুশোভন সরকার সোজাসুজি আপত্তি জানিয়েছিলেন। তখনকার হিন্দু কোড বিলে হিন্দু নারীর দ্বিতীয় বিয়ের অধিকার নেই, এ তো অবিচার হচ্ছে! সত্যেন্দ্রনাথ বসু— যাঁকে ‘অর্কেষ্ট্রা’ উৎসর্গ করেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ— যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন পুরো।
সরে এসেছিলেন তিনি নিজেও। চেনা বন্ধুবৃত্ত থেকে, লেখালেখি থেকে। ‘পরিচয়’ও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। রাসেল স্ট্রিটের সাহেবপাড়ায় থাকতেন, ইংরেজি ছাড়া বাংলায় কথা বলতেন না, কলকাতার এলিট সমাজের মধ্যমণি তখন তিনি। যোগাযোগ ও বন্ধুতা হল মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে, সুধীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রকাশিত হল ইংরেজি পত্রিকা ‘দ্য মার্ক্সিয়ান ওয়ে’। মানবেন্দ্রনাথকে লেখা সুধীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো সম্পাদকের আদর্শ। লিখছেন, পত্রিকা হবে ‘‘বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী বক্তব্য প্রকাশের অনিয়ন্ত্রিত মাধ্যম। ঝগড়া বা নিন্দার কোনো স্থান থাকবে না। আমরা এমন এক দুঃসময়ে বেঁচে আছি, যখন সমাজে মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করছে, সৎচিন্তার মানুষ নিঃশব্দে নিজস্ব চিন্তার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ্যে আলোচনার সুযোগ দেওয়া দরকার। ... সম্পাদক তাঁর আদর্শগত সংগ্রামকে অবদমিত রেখে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন।’’
প্রখর, সুস্পষ্ট রাজনীতিক বোধ ছিল, কিন্তু কোনও দল ছিল না তাঁর। ১৯৩৮-এর কলকাতায় ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘের সর্বভারতীয় সম্মেলনে তিনি সক্রিয়। যোগ দিতে চেয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও, যুদ্ধে যোগদানের বয়স পেরিয়ে গিয়েছে বলে পারেননি। ‘এয়ার রেড প্রিকশান’-এর সংযোগ বিভাগে কাজ করেছেন, দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনেও। ১৯৪৫-এ ‘দ্য স্টেটসম্যান’ কাগজের সহ-সম্পাদক করে নিয়ে গেলেন বন্ধু-সম্পাদক। সে কাজও ছেড়েছেন ক’বছরের মধ্যেই। কেন ছাড়লেন, প্রশ্নের সুধীন্দ্রোপম উত্তর ছিল, ‘‘বিকজ় দেয়ার প্রেফার্ড স্টাইল অব প্রোজ় ওয়াজ় সো বোরিং’’! ঔদ্ধত্য বলে মনে হতে পারে, যদি না মনে রাখি, এই মানুষটাকেই এডওয়ার্ড শিলস আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজিতে আত্মজীবনী লিখবেন, সেটাই তাঁর ‘অ্যাসাইনমেন্ট’! ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব টোয়াইলাইট’ নামের অসমাপ্ত সেই বই লেখার সময়কার সুধীন্দ্রনাথকে দেখেছেন শিবনারায়ণ রায়— ‘‘প্রতি শব্দ, উপবাক্য, উপমা, বিন্যাস যতক্ষণ না তাঁর বিচারে উত্তীর্ণ হতো, পরের বাক্যের দিকে এগোতেন না।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও তুলনামূলক সাহিত্য পড়াতে গিয়ে সময়ের হিসেব থাকত না তাঁর। ঘণ্টা পড়ে গিয়েছে, বুদ্ধদেব বসু দরজায় অপেক্ষা করছেন পরের ক্লাস নেবেন বলে, সুধীন্দ্রনাথ এতই মগ্ন যে, চেয়েও দেখছেন না। পরে রুটিন পাল্টে দিনের শেষ ক্লাস দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
১৯৬০-এর ২৫ জুন আচমকাই এল মৃত্যু। বন্ধুর বাড়িতে ডিনার সেরে এসেছেন, শেষ রাতে কী একটা অস্বস্তি, সিগারেট ধরাতে গিয়ে ঢলে পড়লেন। ডাক্তার এসে বললেন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু হয়েছে। জ্যোতির্ময় দত্তের লেখায় আছে সুধীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বুদ্ধদেব বসু নামের শোকমূর্তিটির কথা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। দিব্যেন্দু পালিত লিখেছেন, হারিয়ে-যাওয়া বন্ধু সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছুটতে ছুটতে এসেছিলেন, সুধীন্দ্রনাথকে এক বার দেখবেন বলে।
সুধীন্দ্রনাথ তাঁর উইলের ‘অ্যাডভাইজ়র’ করে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। উইলে বলা ছিল, ছবি দত্ত ও রাজেশ্বরী দত্তের মৃত্যুর পর তাঁর মজুত ও অবশিষ্ট স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, সাহিত্যকর্মের কপিরাইটের অধিকারী হবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তবে তা এই শর্তে যে, অর্জিত অর্থ দিয়ে তাঁর বাবা হীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিরক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা হবে এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রকাশনা অব্যাহত থাকবে। নিজের বইয়ের প্রকাশনা নিশ্চিত করা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু হঠাৎ বাবার স্মৃতিরক্ষা? কারণ বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পর্ষদের— যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকড় যেখানে— অন্যতম স্থপতির নাম হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আর যে ইন্দুমতী সভাগৃহে বছরভর কতশত অনুষ্ঠান, সেই হল-ও তো সুধীন্দ্রের মায়ের নামেই, কত জন জানি? যেমন জানি না সুধীন্দ্রনাথকেও!
কৃতজ্ঞতা: সন্দীপ দত্ত, শুভাশিস চক্রবর্তী, বিক্রম দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy