সময়টা ভয়ঙ্কর অস্থির। ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে।
রাইচাঁদ বড়ালের বাড়িতে এক সপ্তদশীকে নিয়ে এলেন ব্যায়ামবীর বিষ্ণুচরণ ঘোষ। কী? না, মেয়েটিকে ফিল্মে নামাতে হবে।
ভদ্রঘরের মেয়েরা তখন সিনেমা লাইনে বিশেষ নামত না। এই মেয়েটি যে শুধু ভদ্রঘরের তা-ই নয়, হ্যারিসন রোডে (এখনকার মহাত্মা গাঁধী রোড) মহেন্দ্রনাথ দত্তের দোকানের ঠিক উল্টো দিকে তাদের পারিবারিক গয়নার দোকান। কিন্তু মামলায় আর ব্যবসায়িক বিপর্যয়ে মেয়েটির বাবা প্রায় সর্বস্বান্ত। তাই তাঁদের বলেকয়ে রাজি করিয়ে পিতৃবন্ধু বিষ্ণুচরণ মেয়েটিকে নিয়ে এসেছেন।
বড়াল মশাই ডাকসাইটে সুরকার, নিউ থিয়েটার্সের অন্যতম স্তম্ভ। তিনি মেয়েটিকে বললেন, একটা গান গাও। মেয়ের ভয়ডর নেই। তাঁরই সুরে কে এল সায়গলের গাওয়া ‘প্রেম নহে মোর মৃদু ফুলহার’ গাইল সে। একটু-আধটু যে নাচতেও পারে, তা-ও জানাতে ভুলল না। রাইচাঁদ ফোন করলেন নিউ থিয়েটার্সের পরিচালক নীতিন বসুকে। খানিক কথাবার্তার পরে ফোন রেখে বললেন, ‘‘তুমি কাল ওখানে এসো। টেস্ট নেওয়া হবে।’’
সে ছিল মহামায়া
ছটফটে মেয়েটাকে দেখে এমনিতে বোঝা যায় না, এই কচি বয়সে কতটা ঝড় সে পেরিয়ে এসেছে। বিত্তবান রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে সে। নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের আমলে হালিশহর থেকে পরিবারটির কলকাতায় আসা। পটুয়াটোলা লেনে ভরা সংসার।
বাবা হরেন্দ্রকৃষ্ণ দাসের দুই বিয়ে। দুই তরফেই দু’টি করে ছেলে আর একটি করে মেয়ে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পদ্মাবতীর মেয়ে সে। নাম মহামায়া। জন্ম ১৯২২ সালের ২৩ অক্টোবর। বাড়িতে গান-বাজনার চল। মেজোকাকা ভোলানাথ সরোদ তো বাজানই, নানা যন্ত্রে তাঁর সিদ্ধি। তাঁর উৎসাহেই পাঁচ-ছ’বছর বয়সে বালিশে বসে তবলা বাজানো শুরু হল মহামায়ার। একটু বড় হয়ে এস্রাজ, সেতার, বাঁশি। হরেন্দ্রকৃষ্ণ চাইতেন, ছেলেমেয়েরা সাহেবি ইস্কুলে পড়ুক। মহামায়াকে ভর্তি করে দিলেন আমহার্স্ট স্ট্রিটে লং সাহেবের মিশনারি স্কুলে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন থাকা হল না। শিক্ষাবিদ ভবতারণ সরকার তখন ‘ভারতী বিদ্যালয়’ খুলে ছাত্রছাত্রী জোগাড় করে বেড়াচ্ছেন। তাঁর অনুরোধে হরেন্দ্রকৃষ্ণ মেয়েকে সেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
এই পর্যন্ত দিব্যি আনন্দে কাটছিল মেয়েটার। ভাই আর দাদাদের সঙ্গে বল পেটানো। বাড়ির পিছনে ক্লাবে গিয়ে লাঠি খেলা শেখা। কিন্তু গোলমাল হয়ে গেল ক্লাস সিক্সে ওঠার পরে। মহামায়া তখন ত্রয়োদশী, তার বিয়ে ঠিক হল। পাত্র বারাণসীর মণি রায়। সুদর্শন রোজগেরে যুবা। মহামায়া স্কুল ছেড়ে, কলকাতা ছেড়ে সংসার করতে বারাণসী চলে গেল।
এবং সেলিমা বিবি
মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। মহামায়া তো গেল। কলকাতা ছেড়ে বারাণসীতে তার মন বসে না। তার উপরে বর লোকটি বদরাগী। পান থেকে চুন খসলেই মারমুখী হয়ে ওঠে। বাপের বাড়ির কথা ভেবে উদাস হলে অন্য কারও প্রেমে পড়েছে বলে সন্দেহ করে। মাস আটেকে বিধ্বস্ত হয়ে গেল মেয়েটা। শেষে আর না পেরে জানাল বাবা-মাকে। ফল হল আরও খারাপ। হরেন্দ্রকৃষ্ণ জামাইকে বোঝাতে গেলে তিনি সটান বলে দিলেন, ‘সেপারেশন’ চান। মেয়েকে নিয়ে হরেন্দ্রকৃষ্ণ ফিরলেন কলকাতায় এবং জামাইকে জানিয়ে দিলেন, তিনি মেয়ের ‘ডিভোর্স’ করাবেন!
বিবাহ-বিচ্ছেদ ব্যাপারটা তখন বাঙালি তো বটেই, ভারতীয়দের বেশির ভাগের কাছেই অচেনা। হিন্দু বিবাহ আইনে সে ব্যবস্থা ছিলও না। অন্য ধর্মে অবশ্য ছিল। সে সময়কার নাম করা আইনজ্ঞ এস এন ব্যানার্জি বুদ্ধি দিলেন, মেয়েকে ধর্মান্তরিত করুন। লং সাহেবের গির্জার পাদ্রির দ্বারস্থ হলেন মহামায়ার বাবা। পাদ্রি সাহেব জানালেন, তাঁদের নিয়মে উনিশ বছর না হওয়া পর্যন্ত অপ্রাপ্তবয়স্ক, আইনে আটকে যাবে। শেষে মৌলবির কাছে কলমা পড়িয়ে তাকে মুসলমান করা হল। মহামায়ার নতুন নাম হল সেলিমা বিবি।
ডিভোর্স হয়ে গেল। কিছু দিন পরে আর্য সমাজে ধর্মান্তরিত করিয়ে সেলিমাকে ফের ‘মহামায়া’ করিয়ে আনলেন হরেন্দ্রকৃষ্ণ। স্কুলে ফিরে ক্লাস এইটে ভর্তি হল সে। কিন্তু সেই নিশ্চিন্তিও বেশি দিন সইল না। হরেন্দ্রকৃষ্ণের অবস্থা দ্রুত পড়তে শুরু করল। অবস্থা অমন দাঁড়াল, মহামায়া কিছু একটা না করলেই নয়!
ক্যামেরা আর চকলেট
নিউ থিয়েটার্সে নীতিন বসুর ঘরে সে দিন হাজির ফণী মজুমদার, সুবোধ মিত্র, অমর মল্লিক, কে এল সায়গল, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, পাহাড়ী সান্যালের মতো মহারথীরা। মহামায়া পৌঁছতেই নীতিন বসুর কথা মতো তাকে ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের কিরণময়ীর সংলাপ পড়তে দিলেন শৈলজানন্দ। স্ক্রিন টেস্ট নিলেন ফোটোগ্রাফার বিমল রায়। ঠিক হল, নতুন ছবিতে সে-ই হবে নায়িকা।
বীরেন্দ্রনাথ সরকারের গড়া নিউ থিয়েটার্স তখন অবিভক্ত ভারতে ছবি তৈরির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। যুগন্ধর পরিচালক দেবকী বসু থেকে ভারতীয় ছবিতে প্রথম প্লে-ব্যাক ব্যবহার করা নীতিন বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো লেখক, রাইচাঁদ বড়াল থেকে পঙ্কজ মল্লিকের মতো সুরকার জড়ো হয়েছেন। সায়গল তো আছেনই, ভাগ্যান্বেষণে এসেছেন পৃথ্বীরাজ কপূরও। যিনি যে কাজই করুন, মাসমাইনে বাঁধা। প্রায় প্রতিটি ছবিই ডাবল ভার্সান। অর্থাৎ একই নায়ক-নায়িকা নিয়ে করা হয় বাংলা-হিন্দি দুই ভাষায়। বোম্বাই থেকে করাচি দাপিয়ে বেড়ায় সেই সব ছবি। মাস্টার রেখে নায়ক-নায়িকাদের হিন্দি-উর্দু শেখানো হয়।
এমন জায়গায় নায়িকার চাকরি পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! মাইনে হল একশো টাকা। কিন্তু মহামায়া নাম যে চলবে না! সকলে যুক্তি করে নাম দিলেন ‘ভারতী’। নতুন ছবির নাম ‘ডাক্তার’। ভারতীর বিপরীতে সুদর্শন নায়ক জ্যোতিপ্রকাশ ভট্টাচার্য। প্রথম দিনের শুটিংয়ে পরিচালক ফণী মজুমদার বললেন, ‘‘যা বলব, সেটাই করবে। যদি ঠিক করে শট দাও, পুরস্কার পাবে।’’ প্রথম শটেই ‘ওকে’! পকেট থেকে চকলেট বার করে ফণীবাবু বললেন, ‘‘এই নাও পুরস্কার।’’ এ রকম যত বার এক শটে ‘ওকে’ হয়, ফণীবাবু একটা করে চকলেট বের করে দেন। ১৯৪০-এ ‘ডাক্তার’ রিলিজ হল। সুপারহিট! নতুন জুটির জন্ম হল।
নায়িকা সংবাদ
জুটি হল বটে, কিন্তু টিকল না। এক অভিনেত্রীর প্রেমে পাগলপারা ছিলেন বিবাহিত জ্যোতিপ্রকাশ। সেই নায়িকার আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি মানসিক স্থিতি খুইয়ে ফেললেন। সুবোধ মিত্র যে দিন ‘ডাক্তার’ ছবির হিন্দি ভার্সানের শুটিং শেষ করলেন, কাজ সেরে ফিরে আত্মহত্যা করলেন জ্যোতিপ্রকাশ। ও দিকে আর এক বিপত্তি। ফিল্মে নামায় বিদ্যাভারতী স্কুল থেকে নাম কাটা গেল ভারতীর। বেশ কিছু অভিভাবকের আশঙ্কা, তাঁর সঙ্গে মিশলে তাঁদের মেয়েরা বিগড়ে যাবে! পড়া অবশ্য বন্ধ হয়নি। বরং বাড়িতে মেমসাহেব রেখে ভারতী ইংরেজি শিখতে লাগলেন।
রেডিয়োর তবলাবাদক, সুগায়ক অসিতবরণকে নিউ থিয়েটার্সে নিয়ে এসেছিলেন পাহাড়ী সান্যাল। ভারতী প্রথমটায় চিনতে পারেননি, এ তাঁর বন্ধুর দাদা, ছোটবেলার খেলার সঙ্গী কালো! তাঁর সঙ্গেই নতুন জুটি হল (পরে সারা জীবন তাঁরা একে অন্যকে ‘পার্টনার’ বলে ডেকে এসেছেন)। হেমচন্দ্র চন্দ্র করলেন ‘প্রতিশ্রুতি’, হিন্দি ভার্সান ‘ওয়াপস’। হল ‘সৌগন্ধ’ আর শরৎচন্দ্রের গল্প নিয়ে নীতিন বসুর ‘কাশীনাথ’। এল ‘নার্স সিসি’। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ নিয়ে হিন্দি ছবি ‘ওয়াসিয়াতনামা’। পরপর সুপারহিট।
নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে ভারতীর চুক্তি ছিল পাঁচ বছরের। ছবি যত হিট হতে লাগল, মাইনেও একশো থেকে বেড়ে বেড়ে চার বছরের মাথায় হল পাঁচ হাজার! কাননবালা, চন্দ্রাবতী দেবী, মলিনা দেবী, সুনন্দা আর ভারতী— এই পাঁচ জনকে বলা হত ‘পঞ্চকন্যা’ (পরে তাঁরা ‘মহিলা শিল্পী সমিতি’ও গড়ে তুলেছিলেন দুঃস্থ অভিনেত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য)। ছিলেন বড় রাজলক্ষ্মী দেবীও। মাইনে তিনশো টাকা হতেই কানন-মলিনারা ভারতীকে বললেন, ‘‘এ বার একটা গাড়ি কেনো।’’ ঢাকুরিয়ার বাড়িতে বসে ভারতীর ভাইপো দেবব্রত দাস বলেন, ‘‘তখন পুপা (তাঁরা ওই নামেই ডাকতেন) অস্টিন গাড়ি কিনলেন। উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত ‘শুধু একটি বছর’-এ গাড়িটা ব্যবহার হয়েছিল। পরে ভক্সওয়াগন কেনেন।’’
এরই মধ্যে মন্বন্তর, টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। একটা থামে তো, আর একটা শুরু হয়। বাধল দাঙ্গাও। নিউ থিয়েটার্সের কাজ বন্ধ রইল কিছু দিন। স্বাধীনতা এল দেশভাগের দাম চুকিয়ে। আর সেই বছরই প্রথম বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে এলেন অশোককুমার। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘চন্দ্রশেখর’, পরিচালক দেবকী বসু। ভারতীও আছেন তাতে। তাঁর ঝরঝরে হিন্দি শুনে অশোক অবাক। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি কি প্রবাসী বাঙালি?’’ পঞ্চাশের গোড়ায় বিমানের টিকিট পাঠিয়ে ভারতীকে বোম্বাইয়ে ডেকে নিলেন তিনি। সোর্ড ফাইটিং শিখে ‘বাগদাদ’ নামে একটি ছবিতে নায়িকা হলেন ভারতী। একটা বাংলা ছবিও হল। নাম ‘দুষ্টু প্রজাপতি’। কিশোরকুমার নায়ক, নায়িকা তনুজা। ভারতীর ঝিয়ের পার্ট! তাতে তাঁর হাঁটা-চলা-খাওয়া দেখে কিশোর তো হেসেই খুন! কিন্তু বোম্বাইয়ে থাকা হল না ভারতীর। বাড়ির টানে ফিরে এলেন।
সত্যি বলতে কি, নায়িকার মাপা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে তখনই নিজের অভিনেত্রী সত্তাকে খুঁজে বার করতে শুরু করেছেন ভারতী। তাঁর ভাই নবকুমারের সঙ্গেই মেট্রো সিনেমায় প্রোজেক্টর অপারেটরের কাজ করতেন সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বড় ছেলে অরুণ তখন নায়ক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৫১ সালে বিভূতি লাহার (অগ্রদূত) ‘সহযাত্রী’ ছবিতে তিনিই হলেন ভারতীর নতুন হিরো— উত্তমকুমার। ওই বছরই অমর মল্লিক করলেন ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ভারতী তাতে আয়েষা। বছর তিনেক বাদে যখন ফের ‘মনের ময়ূর’ ছবিতে উত্তম তাঁর নায়ক হলেন, ছবিটা পাল্টে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে উত্তম-যুগ। চলে এসেছেন সাবিত্রী, সুচিত্রা, সুপ্রিয়ারা... নায়িকা ভারতীর দিন ফুরোল। তাঁর কথায়, ‘‘আমি উত্তমের প্রথম নায়িকা আর ও আমার শেষ নায়ক।’’
বিরাট মঞ্চে
আগেই নায়িকা ছাড়াও অন্য নানা ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন ভারতী। এ বার সেই বর্ণময় পাখা আরও মেলে ধরলেন। ১৯৫৮-এ সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ ছবিতে ছোট্ট একটা রোল মিলেছিল। পরের বছর ঘটল আসল কাণ্ডটা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের তিন পাতার একটা গল্প ভারী মনে ধরেছিল ভারতীর। শুনে গল্পটা লেখক তাঁকে উপহার দিলেন। দেবকী বসু করলেন ছবি— ‘সাগর সঙ্গমে’। শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে তা জাতীয় পুরস্কার পেল। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সামনে ভারতীর হাতে প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল তুলে দিলেন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। ছবিটি গেল বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবেও!
১৯৬৩ সালে কালকূটের গল্প নিয়ে তপন সিংহ করলেন ‘নির্জন সৈকতে’। পুরীর সমুদ্রতীরে চার বিধবা, এক প্রেম-ভাঙা তরুণী আর এক ঘরছাড়া যুবাকে নিয়ে সেই ছবি ফের পৌঁছে দিল বড় আঙিনায়। সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেলেন এক সঙ্গে ‘চার বিধবা’— ছায়া দেবী, রেণুকা দেবী, রুমা গুহঠাকুরতা আর ভারতী।
তিন বছর বাদে ফের নিজের শেষ নায়কের মুখোমুখি ভারতী। দিল্লিগামী এক্সপ্রেসের কামরায়। এ বার তিনি নায়কের মাঝবয়সি ফ্যান, যিনি উল্টো দিকের বাঙ্ক থেকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকেন, ঠোঁটে ঘষে নেন লিপস্টিক— সত্যজিতের ‘নায়ক’। ভারতীর কথায়, ‘‘ওঁকে বললাম, বুঝিয়ে দিন কী করতে হবে। উনি পার্ট পড়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি করুন, ভুল হলে বলব।’ নিজের মতো করেই করলাম। উত্তম কামরায় ঢুকল, আমি একটু লিপস্টিক লাগিয়ে নিলাম... এই রকম আর কী। ওঁর ভাল লেগেছিল। পরে বলেছিলেন, ‘আপনাকে ভেবে একটা চরিত্র লিখছি।’ কিন্তু পরে সে আর হয়নি।’’
ওই বছরেই তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’। সে ছবিতে চাকরের চরিত্রে রবি ঘোষ যেমন অমর, বাড়ির দুই বৌ ছায়া-ভারতী জুটিকেই বা কে ভুলবে? তপনের মতে, ‘‘কমেডি উনি দারুণ ভাল করতেন। কমেডি এক জন অভিনেতার পরীক্ষা। যে ভাল কমেডি পারে, সে যে কোনও চরিত্র করতে পারে।’’
বড় পরিচালকদের নামী ছবিতে কাজ কম করেননি। হয়তো বড় চরিত্র নয়, কিন্তু করেছেন নিজের মতো করেই। অগ্রদূতের ‘পথে হল দেরী’, বিমল রায়ের ‘বন্দিনী’, দীনেন গুপ্তের ‘আজকের নায়ক’, অপর্ণা সেনের ‘পরমা’, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’। টিভিতেও অভিনয় করেছেন কিছু টেলিফিল্ম আর সিরিয়ালে। তার মধ্যে প্রথম বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ‘যদি এমন হতো’। চুরাশি বছর বয়সে রেখা, নানা পাটেকর, দীপ্তি নাভালের সঙ্গে শেষ অভিনয় গৌতম ঘোষের ‘যাত্রা’ ছবিতে। ভাল হিন্দি বলতে পারেন বলেই ডাক পড়েছিল।
আর রইলেন তরুণ মজুমদার। ‘পলাতক’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘খেলার পুতুল’, ‘আলো’ ছবিতে ভারতীকে নিয়েছিলেন তরুণ। তাঁর মনে পড়ে, ‘পলাতক’-এর শেষ দৃশ্যে নায়কের নাম ধরে ‘বসন্ত... বসন্ত...’ বলে যে বুকফাটা চিৎকার করেছিলেন ভারতী, তা শুনে তাঁর কী রকম শিহরন জেগেছিল। কিন্তু তার পরেও তাঁর আক্ষেপ। ভারতীর যা প্রতিভা, সেই মাপের রোল তিনি দিতে পারেননি। দেবকী বসু বা তপন সিংহের ছবিতে যখন ভারতীকে তিনি দেখেন, তখন তাঁর হিংসে হয়!
গানে-গল্পে
নায়িকা হওয়ার পরেও গানের ঝোঁক ভারতী আঁকড়ে থেকেছেন। তালিম নিয়েছেন আমির খানের কাছে। হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শিখেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। শিখেছেন পিয়ানো বাজানোও। লেখালেখির শখও ছিল ছোট থেকেই। ‘সুশ্বেতা দেবী’ ছদ্মনামে ‘বাতায়ন’ পত্রিকায় গল্প লিখেছেন। পরে ‘টেলিকথা’ও ছেপেছে তাঁর গল্প। তাঁর গল্প নিয়েই ’৫২ সালে ‘ভুলের শেষে’ ছবি করেন অমর মল্লিক। নায়িকা ভারতী, আর তাঁর ছোট বয়সের রোলে দশ বছরের মাধবী মুখোপাধ্যায়।
একটা সময়ে অমর মল্লিকের সঙ্গে ভারতীর সম্পর্ক নিয়ে নানা খবর রটেছিল চারদিকে। দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল ঠিকই। তবে ভারতী নিজে বরাবর বলেছেন, অমর তাঁর অভিভাবকের মতো, পারিবারিক বন্ধু।
নায়িকা হিসেবে যখন তুঙ্গে, সেই ১৯৪৯ সালে অমরকে দিয়েই স্বামী বিবেকানন্দের জীবন নিয়ে ছবি করান ভারতী। বড় সাধের প্রযোজনা তাঁর। সেই আমলে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। ভারতী অভিনয়ও করেছিলেন নিবেদিতার চরিত্রে। কিন্তু একটি মহল থেকে বাধা আসায় স্বামী বিবেকানন্দের বদলে ‘স্বামীজি’ এবং শ্রীরামকৃষ্ণের বদলে শুধু ‘ঠাকুর’ নাম ব্যবহার করতে হয়! সে যুগের অনেক দর্শকই বুঝতে পারেননি কাদের কথা বলা হচ্ছে। আর সে কারণেই ছবিও তেমন চলেনি— এই আক্ষেপ শেষ দিন পর্যন্ত যায়নি ভারতীর।
ভারতী কিন্তু মঞ্চে অভিনয় বলতে গেলে করেনইনি। এক বারই প্রতাপ মেমোরিয়ালে ‘চারণ কবি মুকুন্দদাস’ করতে যান তিনি। কিন্তু এক মাসের বেশি খাপ খাওয়াতে পারেননি। যাত্রাও বাদ। এক বার নট্ট কোম্পানির সঙ্গে যাত্রা করার কথাবার্তা হয়েছিল তাঁর। কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় শুনেই বললেন— ‘তুমি কি গাঁজা খেতে পারো? যাত্রা করতে অনেক দম লাগে। ও সব ছাড়ো।’ ব্যস, ওখানেই ইতি।
অথচ বিজ্ঞাপনে পা রেখেছেন স্বচ্ছন্দে। যখন একটি কোম্পানির রঙিন সাবান প্রথম বাজারে এল, খবরের কাগজে তাদের বিজ্ঞাপনের মুখ হলেন তিনিই। সেই থেকে টানা বিশ বছর তাঁদের বাড়িতে সাবান পাঠিয়ে গিয়েছে ওই সাবান নির্মাণ সংস্থা।
শেষ নাহি যে...
১৯৭৫ সালে ঢাকুরিয়ায় বাড়ি কিনে সকলকে নিয়ে চলে এসেছিলেন ভারতী। মা, দুই ভাই নব আর অরুণ, তাঁদের পরিবার। চন্দননগরে বোর্ডিংয়ে রেখে দুই ভাইপো দেবব্রত আর সুব্রতকে তিনিই মানুষ করেছেন। দেবব্রতর স্ত্রী শিপ্রা বলছেন, ‘‘আমার ছেলে বিক্রমজিৎ তো ছ’মাস বয়স থেকেই সারাক্ষণ ঠাকুমার কাছে!’’ যখন হাতে বেশি কাজ থাকত না, কখনও ছাতুর পুর দিয়ে কচুরি করে সবাইকে খাওয়াচ্ছেন, তো কখনও জিবে গজা-সন্দেশ বানিয়ে শিপ্রাকে বলছেন, ‘বৌমা, শিখে নাও।’
আর ছিল তাঁর মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ার নেশা। কত যে গড়েছেন! বন্ধুদেরও বিলিয়েছেন। মলিনা দেবীকে দেন শিবমূর্তি, পদ্মা দেবীকে কালীমূর্তি, শোভা সেনকে কাশ্মীরি শালের কারিগর। বাড়ির ঠাকুরঘরে তাঁর গড়া শিবমূর্তি আর মাটি দিয়ে গড়ে কাস্টিং করিয়ে নেওয়া কালীমূর্তিতেই পুজো হয় এখনও।
২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর। কিছু দিন ধরেই শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। বয়সও নব্বই ছুঁয়েছে।
রাত দেড়টা। বাড়ির সকলে বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে। ক্ষীণ গলায় মহামায়া বললেন, ‘‘শরীরটা কেমন করছে।’’ জল চাইলেন। জল দিলেন সকলে। ভারতী চলে গেলেন।
এক বার একটি সাক্ষাৎকারে তরুণ মজুমদার জানতে চেয়েছিলেন, পরের প্রজন্মের জন্য তাঁর কী উপদেশ?
একটুও না ভেবে ভারতী বলেছিলেন একটিই শব্দ— নিষ্ঠা।
ঋণ: শুভাশিস মিত্র (তথ্যচিত্র: ভারতী দেবীর স্মৃতির মন্তাজ), শর্মিলা মাইতি (তথ্যচিত্র: Bharati Devi/ A Beautiful Mind), টেলিকথা, অভিজিৎ গোস্বামী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy