একটি কাটআউট চিত্র, তার মাধ্যম ও বর্ণসমূহ, অন্য ভাবে দেখলে একটি পরিপূর্ণ পেন্টিং নিজস্ব চিত্র।
একটি কাটআউট চিত্র, তার মাধ্যম ও বর্ণসমূহ, অন্য ভাবে দেখলে একটি পরিপূর্ণ পেন্টিং— দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। মাতিসের পেপার কাটিং জগদ্বিখ্যাত। কাটআউট চিত্র দ্বিমাত্রিক। কাগজ, বোর্ড বা ওই জাতীয় দ্বিমাত্রিক যে কোনও মাধ্যম হতে পারে। ওই রকমই প্লাইউড মাধ্যমে তাঁর কাটআউট ‘এসেনশিয়াল ফর্ম’ নামে ইমামি আর্ট আয়োজিত প্রদর্শনীতে এম এফ হুসেনের কয়েকটি বড় কাজ দেখা গেল। হুসেনের এই কাজগুলি যদি ‘পিয়োর ইমেজেস’ হিসেবেও ভাবা যায়, তা হলেও তাঁর ভাবনার সঙ্গে মিলে যায় তাঁরই কথা।
ইনা পুরী উপস্থাপিত প্রদর্শনীটির কাটআউটগুলির প্রাথমিক বর্ণ বিশেষত টকটকে লাল ও কালোতেই সীমাবদ্ধ প্রায়, তবে নেপলস ইয়েলো ধরনের বর্ণও ব্যবহৃত। মূলত অবয়বপ্রধান ও চতুষ্পদ জন্তুর ইমেজও আছে। হুসেন পিয়োর ইমেজেসের ক্ষেত্রে কোনও ন্যারেটিভ, স্টোরি, মিনিং থাকবে, তা একেবারেই চাননি। যদিও নেভিল তুলি ‘দ্য ফ্লেমড মোজ়েইক: ইন্ডিয়ান কনটেম্পোরারি পেন্টিং’ গ্রন্থে তাঁর ছোট্ট আলোচনায় জানিয়েছিলেন সে কথা।
কাজগুলিকে ২০০৮-এর একটি ‘আমদাবাদ সিরিজ়’ বলা যায়। বড় প্লাইউডে ড্রয়িং করে, সেই অনুযায়ী কেটে, ব্লক করে এক-একটি কম্পোজ় করেছেন। সমতল একটি বর্ণই গোটা ফর্মটির আস্তরণ। দু’টি ধাতুপাতের কাটআউটও আছে। কখনও বিচ্ছিন্ন ভাবে আউটলাইন ধরে কাটিংয়ের ক্ষেত্রে কোথাও বিবর্তিত করেছেন। বাঁকিয়ে, ফর্মটিকে সামান্য হলেও বিকৃত করে, সামান্য বিমূর্ততা রেখেও অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় ও কাব্যিক সুষমায় সমগ্র ফর্মটিকে রূপ দিয়েছেন। ওই কিছু জায়গায় যৎসামান্য ত্রুটি বা বিভ্রম বা হঠাৎ স্পিডকে ইচ্ছাকৃত ভাবেই ভেঙে কি তিনি কম্পোজ়িশনটিকে আরও প্রাণবন্ত করতে চেয়েছেন? এখানে তখনই চলচ্চিত্র পরিচালক আন্তোনিয়োনিকে মনে পড়ে খুব। তিনি বলেছিলেন, তাঁর ছবিগুলোয় প্রকরণগত কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ও বিকৃতি তিনি ইচ্ছে করেই ঢুকিয়ে দেন, তাতে ইমোশনবা অভিঘাত অনেকবেড়ে যায়।
হুসেনের ড্রাফটসম্যানশিপ তুলনাহীন। তাঁর চিন্তাভাবনার কৌশলগত রূপগুলি যখন অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে রূপ পায়, রূপান্তরণের মধ্যেও যখন একটি মেসেজকে প্রতিপন্ন করেন, সেখানেও মৌলিকত্ব ও সমগ্র সত্তার অনুসন্ধানেই আত্মগোপন করে থাকে অনেক ধরনের রূপক। সে সবের অন্তর্নিহিত সারাৎসার, জাগতিক অনুভবের রূপ, প্রতীক, বিমূর্ততা, অতি সরলীকরণ, শিল্পীর একান্ত দর্শন, এমনকি কম্পোজ়িশনের মধ্যে মিশে থাকা টেনশন ও নান্দনিক সৌন্দর্য... সব একাকার হয়ে, একটি অমল সৌন্দর্যের বার্তাকেই জাগ্রত করে। বিপরীত দিক থেকে কোনও নঞর্থক ভাষ্যকেও প্রয়োজনে গুরুত্ব দেন ওই কম্পোজ়িশন বা সঙ্কেতের স্বার্থে। এখানেই তাঁর সার্থকতাগুলিকে বুঝতে হবে।
হুসেনের এই কাটআউটগুলি যথেষ্টই নাটকীয়। রূপের এক-একটি আঙ্গিককে বুঝতে সাহায্য করে। নিছক ফ্ল্যাট একটা ফর্ম ভাবলে ভুল হবে। দর্শনগত-মনোগত বিশ্লেষণের আড়ালে রয়ে যায় অবশ্যই কিছু ক্ষেত্রে বিন্যাসের সার্থকতা। যেখানে স্টাইল ও প্রকরণগত গভীরতা ছুঁয়ে যায় অমন দক্ষতার অন্তর্লীন টানাপড়েনকেও। হয়তো কোথাও বড্ড ধীর, নিমীলিত, ক্ষণিক বিচ্ছিন্ন বিস্ফারিত, সর্বোপরি অভিঘাতের অভিন্ন বর্ণনার একক। নির্দ্বিধায় বলা যায়, অবয়বী কাটআউটগুলিতে তিনি যৌনতাকেও কিছুটা হলেও প্রশ্রয় দিয়েছেন, সে অর্থে ততটা ইরোটিক না হলেও।
তিনি সমতল বর্ণ ও একটি রূপের অন্তঃসারকে আউটলাইনে কেটে বা কাটিয়ে ফর্মেশন গড়েছেন। বিষয় যা-ই হোক। নাটকীয় এই অর্থে যে, তিনি আমদাবাদে উপলব্ধি করেছিলেন থিয়েটারকেও। ফলে কাজগুলোয় পরিলক্ষিত হয় একটি অসাধারণ ভিসুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ।
কাজগুলিতে আলাদা ভাবে যে সব বিষয় উল্লেখ করতেই হবে তা হল, হুসেন তাঁর আউটলাইন অনুযায়ী কাটিং ও ড্রয়িংয়ে সামগ্রিক ভাবে রূপটির বিন্যাসে প্রাধান্য দিয়েছেন রিদ্ম, জিয়োমেট্রি, ভিসুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ। হাত-পা, শারীরিক গঠনের রূপে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা প্রিমিটিভিটি, ডান্সিং, কিউবিজ়ম, একই সঙ্গে স্কাল্পচারাল কোয়ালিটিকে উপেক্ষা করা যায় না। মানুষ বা জন্তুর শরীরেও যে পোয়েটিক লাইনস বা স্পিড, একই সঙ্গে পাওয়ার ও ফোর্সের রূপায়ণ চমৎকার ভাবে বিন্যস্ত। যেখানে পিকটোরিয়াল ফর্মে, স্পেসে ও কিছু মাত্র অ্যাবস্ট্রাকশন ও হঠাৎ একটা ব্রেক— সেখানেও কিন্তু ব্যালান্স অটুট! এই মোটিভেশন ও মুভমেন্টকে তিনি ওই ভাবেই রূপায়িত করেছেন। এই এসেনশিয়াল ফর্মের মধ্য দিয়ে হুসেন একটু অন্য ভাবে রূপায়িত করলেন তাঁর দর্শন-বৈচিত্রের সমতলীয় তত্ত্বকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy