নারীরূপ: শিল্পী অরুণিমা চৌধুরীর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী
শিল্পী অরুণিমা চৌধুরীর প্রদর্শনীতে গিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে নানা ধরনের কাজ দেখে শিল্পীর মনের অন্দরের একটা পরিচয় পাওয়া যায়। কিছুটা হয়তো বোঝা যায়, নতুন মাধ্যমের প্রতি তাঁর আকর্ষণের কারণটাও। ইমামি আর্টে তাঁর সদ্য আয়োজিত প্রদর্শনী ‘দ্য ডার্ক এজ অব গ্রিন’ দেখে মনে হল এ কথাই।
শিল্পী বিভিন্ন সময়ে অনেক মাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তার মধ্যে একটি হল, প্রাকৃতিক বা ভেষজ রং। লোহার কড়াইয়ে হরিতকী দিয়ে ফোটাতে ফোটাতে মিশকালো রং পেয়েছেন। হরিতকী সাধারণ বাসনে ফোটালে কিন্তু হলুদ রং পাওয়া যায়, কালো নয়। তারপর মঞ্জিষ্ঠা, যেটি নাকি এক ধরনের লতানে গাছ, সেটা থেকে তিনি লাল রং পেয়েছেন। এর পর চুন বা খড়িমাটির সঙ্গে আঠা মিশিয়ে ধবধবে সাদা রং বেরিয়ে এল। অদ্ভুত ব্যাপার যে, লাল গোলাপ ফোটালে লালের বদলে মভ বা লালচে বেগুনি রং বেরিয়ে আসে। ডালিমের খোসা থেকে এক ধরনের হলুদ রং পাওয়া যায়। তা ছাড়াও কাঁচা বা পাকা হলুদ থেকে নানা শেডের হলুদ রং। জবা ফুল থেকে পেয়ে যান নীল রং। আবার যে কোনও রঙের সঙ্গে ফটকিরি মিশিয়ে নিলে রংটা ধরে ভাল, আর উজ্জ্বলও হয়। মোটামুটি ২০০৫-’০৬ সাল থেকেই এই ধরনের রং শিল্পী নিজেই তৈরি করছেন নিজের স্টুডিয়োয়। বহুবিধ পাত্রে এইসব জিনিসের নির্যাস তৈরি করেন, আবার তাতে ফটকিরি মিশিয়ে নেন।
অরুণিমা চৌধুরী বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন। ভেষজ রং দিয়ে হ্যান্ডমেড পেপার বা হাতে তৈরি কাগজের উপরে করা কাজগুলি একটু অন্য রকম। এ ছাড়াও এনামেল প্লেটের উপরে করা পেন্টিংগুলিতেও রং ব্যবহারের একটা অভিনবত্ব আছে। সেগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি ভাল কাজ রয়েছে। প্রথম দিকে অ্যাসিড-ফ্রি হ্যান্ডমেড কাগজে কাজ করতেন শিল্পী, তারপর কাপড়ে ওই ভাবে কাজ করতে শুরু করেন।
কিছুটা কলমকারি পরম্পরার মতো পাতার ছাপ ফেলে অরুণিমা ডিজ়াইন সৃষ্টি করেছেন। তার আগে নেপালি হ্যান্ডমেড কাগজের উপরে এই ধরনের পাতার ছাপ ফেলে শিল্প সৃষ্টি। কাপড়ে পাতার ছাপ-ফেলা একটি ছবিতে শিল্পী বলতে চেয়েছেন— তালি বা তাপ্পি দেওয়া কাপড়ে যেন নিজের লজ্জা নিবারণ করছেন মাতৃসমা প্রকৃতি। কারণ প্রকৃতি আমাদের হাতে নির্যাতিত। মানুষ প্রতি মুহূর্তে প্রকৃতির বস্ত্র হরণ করে চলেছে।
শিল্পীর ‘বিস্টলি গেমস অ্যান্ড আদার স্টোরিজ়’ সিরিজ় দেখে ধারণা হয় যে, অরুণিমা পিতৃতন্ত্রের বিরোধী। আবার এই সিরিজ়েরই অন্য ছবিতে অরুণিমা বলতে চেয়েছেন যে, মেয়েদের মধ্যে একটা নিয়ন্ত্রণী ক্ষমতাও আছে। সেখানে পুরুষকে অধীনে রাখতে চায় নারী। সে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন। নারী-স্বাধীনতা নিয়ে অরুণিমা প্রধানত ক্যানভাসের উপরে অনেকগুলি কাজ করেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে, রমণী ভালবাসার এবং মমতার প্রতীক। জননী-নারী বাঘের শিশুকে স্তন্যদান করছেন। বন্দি-নারীর ছবিও আছে, যেখানে সে আবহমান কাল ধরে পুরুষের হাতে বন্দি। এ ছাড়া আছে সেই নারী, যে নিজের শরীরের আকর্ষণ সম্পর্কে সচেতন এবং সেই আকর্ষণ ভাঙিয়ে উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। কোথাও বা দমন করতে চায় পারিপার্শ্বিককে। আবার কোথাও সে পুরুষের আধিপত্য পছন্দ করে। এই সিরিজ়ে শিল্পী বহু রূপে দেখালেন নারীকে। প্রদর্শনীতে তাঁর ১৯৯৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত করা কাজ রয়েছে।
অরুণিমা কলকাতার আর্ট কলেজে বিকাশ ভট্টাচার্যের কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন টানা পাঁচ বছর। কিন্তু শেষে বুঝেছিলেন যে, ক্যানভাসের উপরে তেলরং তাঁর জন্য নয়। সেই কারণেই চিরাচরিত প্রথায় ছবি আঁকার থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন।
‘দ্য ডার্ক এজ অব গ্রিন’ প্রদর্শনীটি কিউরেটর ন্যান্সি আদাজানিয়া খুব যত্ন নিয়ে সাজিয়েছেন। প্রায় সব কাজই বেশ চিত্তাকর্ষক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy