ভাস্কর্যে ভাস্বর: শিল্পী মীরা মুখোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
শহরের পরিচিত প্রদর্শশালা গ্যালারি ৮৮-র ৩৬তম জন্মদিন উদ্যাপনের শেষ পর্বে শিল্পী মীরা মুখোপাধ্যায়ের এক অসামান্য প্রদর্শনী উপহার পেলেন দর্শক ও শিল্পীরা। এর আগে শিল্পীর জন্মশতবর্ষে আরও দু’টি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল এই গ্যালারি। এ বারের প্রদর্শনীর শেষ পর্বে দেখা গেল মীরার বহু ভাস্কর্য। সঙ্গে তপতী গুহঠাকুরতা সম্পাদিত বইও প্রকাশিত হল।
প্রদর্শনীর নাম শিল্পীর নিজের লেখা থেকেই নেওয়া হয়েছে— ‘ফ্রম দ্য ডেপথ অফ দ্য মোল্ড’। ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায় এক অসম্ভব পরিশ্রমী শিল্পী ছিলেন। শুধু তাঁর ভাস্কর্যের পদ্ধতিটিই তাঁকে সমসাময়িক ভাস্করদের চেয়ে অন্য পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিল। জীবনে এক সময়ে তিনি ভারতের নানা প্রদেশে ভ্রমণ করে ঐতিহ্যগত ধাতুর ক্রাফটিং শিখেছিলেন বিভিন্ন টেকনিকে। এর পরই ধাতু-ভাস্কর্যের বিশেষত্বে এবং শিল্পী হিসেবেও মীরা মুখোপাধ্যায়ের উত্তরণ ঘটেছিল।
ছোটবেলায় রাজশাহীতে কুমোরপাড়ায় শিশুদের ছোট ছোট মাটির তাল দিয়ে মূর্তি বানাতে দেওয়া হত। বাল্যকালেই মীরা দেখেছিলেন, এক ব্যক্তি বাড়ির দরজায় উপস্থিত হতেন, ব্যাগভর্তি পাথরের টুকরো নিয়ে। তার পর বড়দের নির্দেশ অনুযায়ী মূর্তি খোদাই করতেন সেখানে বসেই। ছোট্ট মীরার মনে এই দু’টি ঘটনাই খুব দাগ কেটেছিল। তার পরেই তিনি ড্রয়িং এবং বিশেষ করে মূর্তি গড়ার কাজে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁকে ভর্তি করানো হয় ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টে। এর পর ১৯৫২ সালে স্কলারশিপ নিয়ে জার্মানির মিউনিখ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে চার বছরের কোর্স শেষ করেন।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, মীরা মুখোপাধ্যায় প্রফেসর নির্মল কুমার বসুর পরিচালনায় কাজ করেছিলেন। বিদেশে থাকাকালীন সময়ে যে ‘লস্ট ওয়্যাক্স’ টেকনিক তিনি আয়ত্ত করেছিলেন ধাতু ঢালাইয়ের কাজে, পরবর্তী কালে সেখান থেকে সরে গিয়ে সম্পূর্ণ দেশজ একটি পদ্ধতি তিনি আয়ত্ত করেন। শিল্পী বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওই বিদেশি ‘লস্ট ওয়্যাক্স’ টেকনিকে কাজ করলে নিজের দেশের মানুষের অন্তরের ভাব বা চরিত্র ধরতে পারবেন না। ১৯৬০ সালে দেশে ফেরার পরে তিনি আরও বেশি করে দেশজ বিষয়ে জড়িয়ে পড়েন। খুঁজতে থাকেন নিজস্ব মোটিফ বা ডিজ়াইন। তার পাশাপাশি যাঁরা ধাতু ঢালাইয়ের কাজ করেন গ্রামেগঞ্জে, তাঁদের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। তাঁদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও সচেতন হয়ে পড়েন। মাটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন হয় শিল্পীর।
পরবর্তী কালে অনেকেই ভেবেছিলেন যে, তাঁর কাজের সঙ্গে ডোকরার কাজের খুব সাদৃশ্য। তখন তিনি ইচ্ছে করেই নিজের কাজের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে সমকালীন শহর ও গ্রামের জীবন নিয়ে নিজস্ব এক স্বাক্ষর তৈরি করলেন। এর ফলে বাস্তার বা ডোকরার সঙ্গে তাঁর কাজের শুধু টেক্সচারেই একটা সাদৃশ্য থেকে গেল। বিষয়বস্তু বা ভাস্কর্যের গঠন সম্পূর্ণ ভাবে অন্য রকমের হয়ে উঠল, যা একান্ত ভাবেই তাঁর নিজের। স্বাধীনতার পরে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মেলামেশা করতেন মীরা। তাঁর কাজে এঁদের নিয়ে এক বলিষ্ঠ কর্মপন্থা লক্ষ করা গিয়েছিল। এঁদের দু’পাশে রেখে দেশসেবার কাজও করেছেন তিনি।
মীরা মুখোপাধ্যায় ভাস্কর্যের আগে সব সময়ে ড্রয়িং করে নিতেন। যেখানেই চোখ যেত, চটজলদি স্কেচ করে রেখে দিতেন। সব ড্রয়িংই যে ভাস্কর্যে রূপান্তরিত হত, তা নয়। বিশেষ কোনও ড্রয়িং যখন ভাস্কর্যে পরিণত করতেন, তখন দু’টির ভাষা হয়ে উঠত সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে একটি ধাতু-ভাস্কর্য দেখা গেল, যেটির নাম ‘আ মিউজ়িক্যাল কনভারসেশন।’ তবলিয়া এবং গায়কের মধ্যে কথোপকথন। তাদের দু’জনের নাটকীয় ভঙ্গিমায় নিবিড় কথোপকথন দর্শকের কাছে খুবই উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। আর একটি ভাস্কর্য দেখা গেল, যেটির নাম ‘রামধনু’। বিশালাকার রাম তাঁর ধনুকে টঙ্কার দিচ্ছেন। যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি! সামনের জমিতে ছোট আকারের বহু অসহায় মানুষের উপস্থিতি, আর পিছনে সাম্রাজ্যের দরজা, সেটি যেন রামধনুর আকার নিয়েছে।
মীরার আরও একটি ধাতু ভাস্কর্যে তিনি ধরেছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে। কবি যেন পুঁথি ধরনের কিছু হস্তলিপি পড়ছেন। পড়ার ভঙ্গিমাটি যেন এক বিজয়গাথা।
এর পরের ভাস্কর্যের নাম ‘ড্রামার’। এখানেও বিষয়বস্তুতে বেশ অদ্ভুত একটি বিষয় দেখাতে চেয়েছেন শিল্পী। যে ড্রাম বাজাচ্ছে, সে তার বাজনায় সম্পূর্ণ নিমগ্ন। কিন্তু তার অন্তরে যে সঙ্গীত চলছে, সেগুলি ছোট ছোট মূর্তি দিয়ে দেখিয়েছেন মীরা। সেখানে আছে নৃত্যকলা, আছে সঙ্গীত, চলছে নাটক। বহু শিল্পকর্মই সেই বাদ্যকরের ভিতরে চলছে, কিন্তু সেগুলি বুকে ধারণ করেও সে বাজনায় বিভোর।
আরও একটি ভাস্কর্য চোখে পড়ে, যার নাম ‘মিনিবাস’। মিনিবাসের বহু যাত্রী যে ভাবে যাতায়াত করে, তাদের নানা রূপে দেখানো হয়েছে। উপরে রড ধরে থাকার চাপ, ভিড়ের চাপ, যাত্রীদের বিভিন্ন চরিত্র... ইত্যাদি। এই ভাস্কর্যটির চিত্রকল্প অনবদ্য।
‘পালতোলা নৌকা’ নামে একটি ভাস্কর্যে উঠে এল বৈতরণী পার হওয়ার কথা। এখানে কি শেষযাত্রার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে? কারণ যাত্রীদের শরীর-মন-অনুভূতিতে হতাশার ছোঁয়া। একই সঙ্গে আবার একে-অপরের প্রতি প্রেমভাবও লক্ষণীয়।
অতুলনীয় এই শিল্পীর সর্বশেষ অসম্পূর্ণ ভাস্কর্যটি তাঁর প্রয়াণের তিন মাসের মধ্যেই আশ্চর্য ভাবে শেষ হয়ে যায়। যে মানুষদের তিনি রেখে গিয়েছিলেন পাশে, তাঁরাই শেষ করেছেন মীরার শেষ কাজ— এক বিশাল বুদ্ধমূর্তি। এ যেন কিছুটা শিল্পীর অদৃশ্য পথ-প্রদর্শন। মীরা মুখোপাধ্যায়ের ভাস্কর্যের মধ্যে মানুষের অন্তরের বিশৃঙ্খলা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, লড়াই ইত্যাদি প্রকাশ পেয়েছে নিরন্তর। তা প্রকাশে কখনও দ্বিধা বোধ করেননি এই ভাস্কর। আলোচ্য প্রদর্শনীটি যেন সে কথাই আবার মনে করিয়ে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy