বাস্তবমুখী: এ এম আর্ট মাল্টিডিসিপ্লিনস-এর আয়োজিত প্রদর্শনী
কিছু কাজ দেখতে দেখতে অচিরেই মনে পড়ছিল প্রায় সতেরো-আঠেরো বছর আগের এক আলোচনার কথা। রোম্যান্টিসিজ়ম সম্পর্কে সেই স্বলিখন মনে পড়িয়ে দিল পিকটোরিয়াল স্পেসের সামগ্রিক অনুভূতিময় এক অনিবার্য পরিণতির কথা। রং, রেখা, আলোছায়া, ভাবধারা, কম্পোজ়িশন, স্টাইল, বিষয়, আঙ্গিক— রূপারোপে চেতনার লিখিত সত্তা থেকে টেনে বার করে আনা এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতির ভুবন। কল্পনাশক্তিকে কত ভাবে, কত দিকে ধাবিত করা যায়। পল ক্লীর মধ্যে একটা রোম্যান্টিক প্রিন্সিপল ছিল। শাগাল একই প্রিন্সিপলে কিউবিজ়ম, সুররিয়্যালিজ়মকে মিশিয়েছিলেন আশ্চর্য ভাবে। অবনীন্দ্রনাথকেও কি বাদ দিয়ে ভাবা যায়? ব্যক্তিগত চেতনার একটি অন্য ধারার উপকথা। সাইকোলজিক্যাল এক্সপ্লোরেশন অব দ্য আর্টিস্ট।
এ এম আর্ট মাল্টিডিসিপ্লিনস-এর আয়োজনে এক অন্য ধরনের ছোট কাজের প্রদর্শনী ‘থার্টিন ওয়েজ় অব লুকিং অ্যাট আ ব্ল্যাক বার্ড’ নামের এই সদ্যসমাপ্ত প্রদর্শনীটিই সেই সব স্মৃতিকে ফিরিয়ে দিল। পাঁচজন তরুণ শিল্পীর ১৮টি কাজের মধ্যে বর্তমান সমাজ-বাস্তবতার কঠিন ও রূঢ় এক প্রেক্ষাপট ছিল। যা শিল্পীরা সম্পূর্ণ নিজেদের ভাবনা-চিন্তা-স্বাধীনতায় প্রত্যক্ষ করিয়েছেন। শিল্পেরও এক নিগূঢ় তত্ত্ব ও ভাষা থাকে, যে যেভাবে তাকে আত্মস্থ করে পৌঁছে দেন এক আশ্চর্য আঙ্গিকে।
নির্দিষ্ট কোনও বিষয়ভিত্তিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে নয়, আবার বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতকে বিস্মৃত হয়েও নয়, শিল্পীরা সময়ের কাছে কিছুটা হলেও দায়বদ্ধ। ওই ভাবনা ‘ল্যাঙ্গোয়েজ অব পেন্টিং’গুলির অন্তরালে কিন্তু নিহিত ছিল। প্রত্যক্ষ রোম্যান্টিসিজ়ম যদিও বা অনুল্লেখ থাকে, তবু তারই পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানের মেলোডি নিঃসন্দেহে বদলে দিয়েছিল পরবর্তী শিল্পকলার প্রতিটি ঈর্ষণীয় জলসার স্বভাব-চরিত্র, রাজনীতি, আঙ্গিক, শৈলী, ভাব-ভাবনার গতিপ্রকৃতিকে। শিল্পকলার ক্ষেত্রে ফরাসি বিপ্লবোত্তর অভিঘাত না হয় উহ্যই থাক। সে এক মস্ত তেপান্তর।
এ প্রদর্শনীতে বিশেষ করে প্রমিতি সোই হোসেনের ‘ইনট্রোস্পেকশন’ নামক চারটি ও রিমা কুণ্ডুর ‘ওয়েপন’ নামে তিনটি কাজ সে সব ইতিহাসের অনেক কিছুই ফিরিয়ে দিল।
অবয়বপ্রধান কাজে কাগজের ত্বকের অস্তিত্বের মধ্যবর্তী পটভূমিকে কেন্দ্র করে রাজর্ষি বিশ্বাস ও স্নেহাশিস মাইতি জলরঙের চমৎকারিত্বে সময়ের দুঃসহ বিষয়ের অবতারণায় ব্রতী ছিলেন। তিমির ব্রহ্মর একটি মাত্র সাড়ে তিন বাই ছ’ফুটের অ্যাক্রিলিক ছিল ক্যানভাসে, স্বল্পকথার বাস্তবতায় সমতলীয় বর্ণবিন্যাসে ধর্ম-সম্প্রীতির দ্বৈত চেতনার উন্মেষ যেন।
রিমার ‘ওয়েপন’ পপ আর্টের ধারণাকে উসকে দিলেও, প্রাণঘাতী অস্ত্রের রূপকে এখানে রূপক অর্থে সজ্জিত করেও, তার ভয়ঙ্করতার চরিত্রকে ভুলতে দেয়নি, যা খুবই অর্থবহ। ক্ষুদ্র সেফটিপিন, ছুরি বা চামচকে স্টাইলাইজ়ড করেছেন রিমা, আকারের বিবর্তনে ও নানা মাধ্যমের সহায়তায়। চামচের ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রিন্ট, ইঙ্ক, অন্য দু’টিতে ফার, পেপার পাল্প, বিডস, লেস, সেলাই, কাপড়কে ব্যবহার করেছেন অসাধারণ শৈল্পিক আঙ্গিকে। সুন্দরও রক্তাক্ত অধ্যায়কে মনে পড়ায়, ফিরিয়ে দেয় হত্যাদৃশ্যের স্মৃতি। কোথাও যেন একটা পলিটিক্যাল মেসেজ রেখে যায়।
প্রমিতির ছবির ভাষা কবিতার কাছে ফিরে যাওয়ার মতো। হয়তো তা বিষণ্ণ বিকেলের নিচুস্বরের সঙ্গীত অথবা ‘কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি, সে তো ভেসে ওঠা ম্লান আমার মায়ের মুখ, নিমডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি’র মতো এক অন্য নস্ট্যালজিয়ার কাছে ফিরিয়ে দেয়। যা কবিতায় দিয়েছিলেন আল মাহমুদ। প্রমিতির এই অন্তর্দর্শনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে থাকে কিছু মাধ্যম। অ্যাক্রিলিক শিটের স্বচ্ছ আস্তরণের উপরে গ্লাস এচিংয়ের ছায়া পড়ে একটি আশ্চর্য বিভ্রম তৈরি হচ্ছে, পেনসিলের হালকা ড্রয়িংয়ের মতো। মোটা কাগজের উপরে কফির হালকা বর্ণের প্রলেপ তৈরি করে জলরং, চারকোল প্রভৃতির মাধ্যমে কিছু স্মৃতিময় আখ্যানকে রূপায়িত করেছেন। টুকরো ব্যাখ্যার সংকলনের মধ্যে প্রতিটি রূপারোপ নিজস্বতাকে প্রতিভাত করছে। সাদা পাতাবাহার থেকে চেয়ার, টব, সেফটিপিন, শিকড়, পশু, মাছ, জাল, প্রজাপতি, পত্রপুষ্প, পাখির পা... আরও অনেক কিছুর স্বরূপদর্শন, আত্মকথাময় এক জীবনের গল্প। অসাধারণ কাজ।
রাজর্ষির সিরিজ ‘ন্যারেটিভস এক্সপ্যান্ডিং দ্য ট্রুথ’। করোনা আবহের সচেতনতা, ভ্রুক্ষেপহীনতা, দুই-ই মানুষের বর্তমান অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। বরাবরই রিয়্যালিজ়মকে সময়ের প্রেক্ষাপটে ভাবতে ভালবাসেন, তাঁর স্টাইল টেকনিকে ওই জলরঙের দ্রবীভূত লালচে-খয়েরি তরলায়নের পটভূমি, ব্রাশিং, মানুষের মুহূর্ত ও ভঙ্গি, সবই অত্যন্ত সময়োপযোগী ও জীবন্ত। স্নেহাশিসও অবয়বকে নিয়ে অনন্যসাধারণ কাজ করেছেন। জলরঙে তাঁরও ওই তরলায়নের মধ্যে মানুষের মুহূর্তগুলির অভিঘাত সাংঘাতিক। এ-ও সেই রক্তাক্ত স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়। তাঁরও ড্রয়িং, রিয়্যালিজ়ম, টেকনিক, স্টাইলাইজ়েশন, বর্ণ-মেদুরতায় বিবর্তিত তারল্যের অদ্ভুত এফেক্ট পটভূমির নৈঃশব্দ্যকে প্রকট করে নির্দিষ্ট মুহূর্তটিকে প্রকাশ করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy