মাথাটা একটু ঝিমঝিম। চোখ অন্ধকার। ব্যস, তার পর জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। আধমিনিটের মধ্যেই আবার স্বাভাবিক। একবার নয়, পর পর তিন বার এমন হল অনির্বাণের। প্রথমবার বসের কেবিনে। একবার পাড়ার বাজারে। শেষে রাস্তায়। ভয় ধরে গেছে। এমন ভাবে ভয়ের সঙ্গে কত দিন আর চলা যায়। অনেকেই পরামর্শ দিলেন, অবিলম্বে কোনও চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়ার।
প্র: জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে অথচ কিছু ধরা পড়ছে না, এটা কেন?
উ: কিছু ক্ষেত্রে হয় এ রকম। ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, রক্ত পরীক্ষা, সব নর্মাল আসে। প্রকৃত কারণ ধরা পড়ে না। তখন আরও কিছু পরীক্ষা করে রোগ ধরতে হয়।
প্র: যেমন?
উ: হলটার মনিটরিং করা যেতে পারে। অর্থাৎ শরীরে একটা মেশিন লাগিয়ে দেওয়া, যাতে ২৪-৪৮ ঘণ্টা ধরে ইসিজি রেকর্ড হতে থাকে। তা দেখে রোগ ধরেন কার্ডিওলজিস্ট। তবে তাতে যে রোগ ধরা পড়বেই এমন গ্যারান্টি নেই।
প্র: কেন?
উ: ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উপসর্গ না হলে ধরা না-ই পড়তে পারে।
প্র: তা হলে?
উ: এক্সটারনাল লুপ রেকর্ডার নামে মেশিন ৭ দিন পর্যন্ত লাগিয়ে রাখা যায়। ৭ দিনের মধ্যে উপসর্গ হলে রোগ ধরা পড়ে।
প্র: আর না হলে?
উ: যা ভাবছেন তা নয়। ধরা নাও পড়তে পারে।
প্র: অর্থাৎ যখন জ্ঞান হারিয়ে যাবে তখন ইসিজি করলে রোগ ধরা পড়বে? কিন্তু তা কি সম্ভব? আধমিনিটের মধ্যে?
উ: একেবারেই সম্ভব নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার দরকারও হয় না। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে, যখন কিছু ধরা পড়ে না, তখন আরও পরীক্ষা করতে হয়।
প্র: না করলেই বা কী?
উ: ক্ষতির সম্ভাবনা তো আছেই। বেকায়দায় পড়ে গেলে হাড়গোড় ভেঙে যেতে পারে। এমন যে অনেকের ক্ষেত্রে হয় না, তা নয়। যে রোগের কারণে এমন হচ্ছে তা তলে তলে বেড়ে বেড়ে বিপদের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। আরও বড় বিপদের আশঙ্কা কিন্তু আছে।
লিডলেস পেসমেকার
•বুকের উপর চামড়ার নীচে যন্ত্র বসিয়ে হার্টে লিড ঢোকানোর বালাই নেই। ছোট্ট মেশিন, ঢুকে যাচ্ছে সরাসরি হার্টের মধ্যেই।
•কোনও কাটাকাটি নেই। কুঁচকির শিরার মধ্যে দিয়ে সে চলে যাচ্ছে হার্টে। কাজেই রক্তপাত বা সংক্রমণের আশঙ্কা নেই।
•৩০-৪৫ মিনিটের মধ্যে কাজ সারা হয়ে যায়। একদিন হাসপাতালে থাকা, তার পর বাড়ি।
•রক্তপাত বা সংক্রমণের সম্ভাবনা নেই।
• লিড নেই, তাই বুকে বল লেগে বা হাতাহাতি করতে গিয়ে লিড ভেঙে বিপদ বাড়ে না।
প্র: মানে মৃত্যু?
উ: হতে পারে। আচমকা হার্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্র: তা হলে?
উ: আরও কিছু পরীক্ষা করে দেখতে হয় রোগটা কী। রক্তচাপ কমে এ রকম হচ্ছে কি না দেখতে টিল্ট টেবল টেস্ট নামের পরীক্ষা করতে হয়।
প্র: রক্তচাপ কমেও এ রকম হয়। তাই না?
উ: মনে রাখবেন রক্তচাপ অনেকটা কমে যাওয়া মানেই মাথায় অক্সিজেন কম যাচ্ছে। এটা তো ঠিক নয়। বা এ জন্য ঘন ঘন কারও এ রকম হচ্ছে সেটাও কম দুশ্চিন্তার নয়।
প্র: আচ্ছা বলুন তো কী করলে এই ব্যাপারটা আটকানো যায়?
উ: কয়েকটি নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন ধরুন বসে আছেন, সেই বসে থাকা থেকে হঠাৎ করে উঠে না দাঁড়ানো। যেখানেই থাকুন, দেখলেন মাথা ঘুরছে। মাথা ঘুরতে শুরু করলে সুযোগ থাকলে সেখানেই শুয়ে পড়ুন। নয়তো উবু হয়ে বসে থাকুন। ডাক্তারের পরামর্শ মতো কয়েকটি ব্যায়াম করা, এ আর অসুবিধে কী।
প্র: হার্টের জন্য সমস্যা হচ্ছে অথচ ধরা পড়ছে না, তেমন হলে?
উ: বুকের চামড়ার তলায় লুপ রেকর্ডার বসিয়ে রোগ ধরতে হতে পারে। কিন্তু সেই ব্যাটারি তিন বছর কার্যকর থাকে। তার মধ্যে যদি সেই রোগী জ্ঞান হারান, তবেই কিন্তু রোগ ধরা পড়বে।
প্র: চামড়ার তলায় বসাতে হয় মানে তো অপারেশন?
উ: আরে না। সে রকম অপারেশন নয়। আগে মেশিন বড় ছিল, একটু কাটতে-টাটতে হত। এখন তো একটা শুধু মাইক্রোচিপ। তা আবার ইনজেকশন দিয়েও বসিয়ে দেওয়া যায়।
প্র: ইনফেকশন হবে না?
উ: ইনফেকশনের কোনও প্রশ্নই নেই। তবে খরচ একটু বেশি হয়ে যায়। প্রায় দু’আড়াই লাখের মতো খরচ হয়ে যায়। কিন্তু তা থেকে যা তথ্য পাওয়া যায় তা অমূল্য।
প্র: একটু কম খরচের পরীক্ষা কিছু নেই?
উ: সে ক্ষেত্রে ইপি স্টাডি করা যেতে পারে। ২০-২৫ হাজার টাকার মতো খরচ হবে। তবে এর সমস্যাও কিছু আছে। প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে রিপোর্ট নর্মাল থাকলেও যদি হার্টের অসুখ থাকে, তখন আবার লুপ রেকর্ডার বসাতে হয়। তবে বলব এ সব নিয়ে রোগীদের বেশি মাথা না ঘামানোই ভাল। কারণ কার যে কখন কোন পরীক্ষা করতে হবে, সেটা ডাক্তার ছাড়া আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তিনি প্রয়োজন মতোই তা বলে থাকেন।
প্র: এত কাণ্ডের পরে রোগ ধরা পড়লে, তার পর আবার পেসমেকার বসানোর প্রশ্ন।
উ: রোগ ধরা পড়লে তো বসে থাকা যায় না। কিছু একটা করতেই হবে। সে পেসমেকার হোক, কি অন্য কিছু। হার্টরেট বেড়ে গিয়ে ঝামেলা হলে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলিউশন নামের পদ্ধতি করে হার্টের মধ্যে গজিয়ে ওঠা কিছু ইলেক্ট্রিক সার্কিট পুড়িয়ে দিতে হয়। তাতে কাজ না হলে বসাতে হয় ইমপ্ল্যান্টেবল কার্ডিওভার্টার ডিফিব্রিলেটর বা আইসিডি নামের পেসমেকারের মতো একটি যন্ত্র।
প্র: হার্টরেট বেড়ে গেলেও পেসমেকার লাগে?
উ: আইসিডি দু’ভাবে কাজ করে। হার্টরেট বেড়ে গেলে শক দিয়ে তাকে স্বাভাবিক করে। আর কমে গেলে এর ব্যাকআপ পেসমেকার সার্ভিস কারেন্ট দিয়ে হার্টরেট বাড়ায়। যাঁদের হৃদস্পন্দন কখনও আকাশে ওঠে তো কখনও নামে পাতালে, তাঁদের জন্য এটা দরকার।
প্র: অর্থাৎ একটা মেশিনের মধ্যেই দুটো বসানো আছে।
উ: ঠিক তাই। এটা দু’ রকম ভাবে কাজ করে।
প্র: পেসমেকার যেমন কথায় কথায় বসাতে হয়, এ সব নিশ্চয়ই অত লাগে না?
উ: তা লাগে না। আবার পেসমেকার যত সহজে করে দেওয়া যায়, এ সব ততটা সহজেও করা যায় না।
প্র: পেসমেকার বসানোই কি আর খুব সহজ! সেটা তো কাটাকাটি, হাসপাতালে থাকা, তার পর ‘এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না’!
উ: আজকাল এসে গেছে লিডলেস পেসমেকার। কুঁচকির শিরার মধ্য দিয়ে ক্যাথেটারের সাহায্যে একেবারে হার্টের মধ্যে বসিয়ে দেওয়া যাচ্ছে।
প্র: একেবারে হার্টে?
উ: হ্যাঁ, একেবারে হার্টে। কিন্তু তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
প্র: শিরার মধ্য দিয়ে যন্ত্র ঢোকানো হচ্ছে! অত বড় যন্ত্র!
উ: যন্ত্র ছোট হয়ে গেছে। খুবই ছোট। এক কিউবিক সেন্টিমিটারের চেয়েও ছোট।
প্র: তা হলে আগে যেমন বুকটা উঁচু হয়ে থাকত, এখন আর থাকবে না?
উ: রোগাদের একটু উঁচু হয়ে থাকত, সামান্য বোঝা যেত। কিন্তু না, এখন আর সেটাও থাকবে না।
প্র: আর খরচ?
উ: দেখুন খরচের ব্যাপার তো থাকবেই। তবে সাত থেকে সাড়ে সাত লাখের মতো খরচ হয়ে যায়।
সাক্ষাৎকার: সুজাতা মুখোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy