কাব্যিক: গণেশ হালুইয়ের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
দিল্লির কিরণ নাদার মিউজ়িয়াম অব আর্ট এবং আকার-প্রকার গ্যালারির যৌথ নিবেদনে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি উদ্যাপিত হল শিল্পী গণেশ হালুইয়ের এক অনন্য রেট্রোস্পেক্টিভ। নির্বাচিত শিল্পকর্ম নিয়ে তাঁর গত ষাট দশকের কাজ।
এই ধরনের প্রদর্শনীর হাত ধরে কোনও শিল্পীর শৈল্পিক যাত্রাপথটি আমরা দেখতে পাই। আর সেটাই বিশেষ ভাবে সাহায্য করে সেই শিল্পীকে চিনতে। শিল্পী, গায়ক বা লেখককে জানতে গেলে তাঁকে ধারাবাহিক ভাবে জানতে হয়। এই মুহূর্তে বঙ্গীয় চিত্রকলার অন্যতম প্রবীণ শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতি পর্বের কাজে দেখা যায় নতুনের অনুসন্ধান।
ছোটবেলায় দেখা খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে শিল্পীর ছেলেবেলার জামালপুরের বাড়ির স্মৃতি বড় বিচিত্র। সময়ে সময়ে ব্রহ্মপুত্রের খেয়ালি মেজাজ, সেখানকার জলাজমি, জলের আশ্চর্য দাপট, বন্যা... এই সবই রয়ে গিয়েছে তাঁর স্মৃতিতে। শৈশবের দেখা বন্যায় আঙিনায় ঢুকে আসা নদীর জল, চারদিকে প্রকৃতির সবুজের ব্যাপ্তি, নিসর্গকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখে সেই কিশোর প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শিখেছিল। তাঁর কাজের ব্যাপারে ওয়র্ডসওয়র্থের কথায় বলা যায়–‘রিকালেকশন ইন ট্রাঙ্কুইলিটি!’ সারা জীবন জুড়েই তাঁর স্মৃতি-কাতরতা বহমান। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা মানুষ, পশুপাখির স্মৃতি এবং প্রকৃতির বদলে যাওয়ার স্মৃতিটুকুও ধরা আছে তাঁর মানসপটে। পরবর্তী কালে প্রকৃতির সেই অন্তর্গত নির্যাসটি তাঁর ছবিতে ধরা পড়েছে বারংবার।
তিনি বর্ণনা করেছেন, নদী উপচে পড়লে তাঁদের উঠোনে কেমন জল ঢুকে আসত। তাঁর শিশুমনে এই উঠোন বা আঙিনার যে ছাপ পড়েছে, তা ভারী অদ্ভুত। একই সঙ্গে যেন তা খোলা, আবার বন্ধও। সেটি আশ্রয় দেয়, কিন্তু তেমন শক্তপোক্ত নয়। বার বার তাঁর কাজের মৌলিক সুর হয়ে এই অনুভূতিই ফিরে এসেছে। তাঁর ছবিকে যে রেখাগুলি একটি চৌকো বাঁধনের মধ্যে বেঁধে রাখত, তা যেন স্থিতির গভীরতার এক প্রতীক ছিল। পরবর্তী শিল্পকর্মে আবার হালুইয়ের কল্পনা সেই ব্যক্তিগত আঙিনাকে সুদূর প্রান্তরে বিস্তীর্ণ করেছে। সীমারেখা ভেঙে দিয়েছে। কোথাও সেই সীমারেখাকে অসম্পূর্ণ রেখে যেন কল্পনাকে অবাধে তিনি বয়ে যেতে দিয়েছেন।
১৯৫৬ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত যে সময়টা তিনি অজন্তায় কাটিয়েছিলেন, সেই সময়ের নেপালি কাগজে করা অজন্তার গুহাচিত্রের অমূল্য সব ড্রয়িং, জলরং এবং টেম্পেরার ছবি এই প্রদর্শনীতে দেখা গেল। অজন্তায় থাকাকালীন প্রাচীন ভারতের শিল্পকলা যেমন দেখেছেন শিল্পী, তারই পাশাপাশি গ্রামের মানুষের অসংখ্য স্কেচও করেছেন। তার সঙ্গে বিভিন্ন পাথরের আকারবিন্যাস, গাছপালা, গ্ৰাম্যজীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সব বিষয়ের ছবি এঁকেছেন। সেই সময়েই তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যকে যে ভাবে অন্তর থেকে অনুভব করেছিলেন এবং গ্রহণ করেছিলেন, সে সবের পরিচয় তাঁর অজন্তার স্কেচ খাতা থেকে পাওয়া যায়। তাঁর সেই ‘মিউরালগুলি’ আঁকার পাশাপাশি এমন অসংখ্য স্কেচও দেখা যায়, যেগুলি করতে গিয়ে শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে তাঁর অন্তরের সংযোগটি অনুভব করা যায়। তাঁর চিত্রশিল্পের দক্ষতা অজন্তায় চিত্রিত মানবমূর্তির ছবিতে প্রভূত ভাবে ধরা পড়েছে। ভারতীয় শিল্প-পরম্পরাকে তিনি যে ভাবে আত্তীকরণ করেছেন, অজন্তাকে যে নবতর নিরীক্ষায় দেখেছেন, সেখান থেকেই পরবর্তী কালে নিজস্ব এক ছন্দ তিনি প্রবর্তন করেন।
এর পরবর্তী পর্বে যে সব জিনিস তাঁর কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে, সেই সব উপাদান শিল্পী বাতিল করতে শুরু করেন। যেটুকু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আবশ্যিক সেটুকুই তিনি ধরতে চেয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রকৃতির অন্তরাত্মার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পেরও নাভিবিন্দুতে পৌঁছতে চেয়েছেন। নিজের ছবিকে আলাদা করে ‘মূর্ত’ বা ‘বিমূর্ত’ আখ্যা দিতে তিনি চাননি, কারণ সে দু’টি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে তাঁর অনেক কাজেই।
পরবর্তী কালে তাই তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যা দেখি তা আঁকি না, যা আঁকি তাই দেখি।’ তাঁর ছবিতে তখন অজস্র মুহূর্ত, অতীত, বর্তমান পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে এক অদ্ভুত রূপ নিয়েছে। তখন তাঁর শিল্পমাধ্যম কখনও টেম্পেরা কিন্তু প্রধানত গোয়াশ।
এক সময়ে অজস্র মানুষের দুর্দশা আর যন্ত্রণা দেখা সত্ত্বেও তারা কখনও তাঁর শিল্পের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠেনি। শিল্পী গণেশ হালুইয়ের দেখার জগৎ থেকে প্রথমে মানুষের অস্তিত্ব হারিয়ে গিয়েছে, তার পরে ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে তার আশপাশের সব চেনা জিনিস। তাঁর আঁকার পদ্ধতি পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিয়ে, বার বার শিল্পের এক অন্তর্নিহিত ছন্দকে ধরতে চেয়েছে।
তাঁর গত কয়েক বছরের ছবি উজ্জ্বল এক বর্ণময়তা নিয়ে দর্শকের সামনে এসেছে। এই ছবিগুলো যে গোয়াশে তিনি এঁকেছেন, সেই বিশেষ গোয়াশ কিন্তু শিল্পজগতে তাঁরই নিজস্ব এক অবদান।
শিল্পীর ভাষায়, অবয়বের অন্তরের ছন্দটি না খুঁজে পেলে সে ছবি শিল্পকলা হয়ে ওঠে না। চাক্ষুষ দেখা দুনিয়াকে জাগতিক কারণে জোর করে বিমূর্তকরণ করায় তিনি বিশ্বাস করেন না। নিজের মননের সমুদ্রমন্থন করে শিল্পীর অজান্তেই শিল্পকর্ম অমৃত-সমান হয়ে ওঠে।
শিল্পী গণেশ হালুইয়ের কাজের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা এই প্রদর্শনীতে চোখে পড়ে, তা হল— একটি পর্যায় পর্যন্ত শিল্পী নিজের ছবির শিরোনাম দিতেন। পরবর্তী কালে শিল্পী সেই শিরোনামকেও বাতিল করেছেন। অর্থাৎ শিরোনাম দিয়ে শিল্পকে নির্দিষ্টায়িত করতে চাননি। একেবারেই প্রথম দিকের কাজে, যেমন ‘আমার দিদির বিয়ের দিনে’ বা ‘মানুষখেকো’, এই রকম অজস্র সব কাব্যিক শিরোনাম দিতেন ছবির। কিন্তু পরবর্তী কালে তিনি সব ছবিকে শিরোনামহীন করেছেন। অর্থাৎ যেন বলতে চেয়েছেন, চিত্রকল্প নিজস্ব এক অস্তিত্ব নিয়ে বাঁচে। পরবর্তী জীবনের সমস্ত কাজে এই নামহীনতার মধ্য দিয়েই তিনি নিজের ছবির এক অন্য রকম জায়গা সৃষ্টি করলেন।
এই প্রদর্শনীর অসংখ্য ছবিতে দর্শকের সঙ্গে শিল্পীর চিত্রকর্মের এক অন্তর্লীন, প্রতীকী যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। শিল্পী গণেশ হালুইয়ের প্রতিটি ছবি তাঁর পক্ষে একই সঙ্গে সংগ্রাম ও আবিষ্কার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy