ভায়োলা (হুমা) ভালবাসে অরসিনোকে।
অরসিনো (আলিশান) ভালবাসে অলিভিয়াকে।
এবং অলিভয়া (উষ্ণতা) ভালবাসে সিজারিওকে (বিল্লু)।
এই ছিল শেক্সপিয়রের রোম্যান্টিক কমেডি। এই ছিল ব্র্যাকেটে ব্রাত্য বসু। আড়াই ঘণ্টা ধরে হাউসফুল মিনার্ভা থিয়েটারে আমাদের চোখের সামনে শেক্সপিয়রকে খুন করলেন এবং তিলে তিলে বাঁচিয়ে তুললেন ব্রাত্য বসু।
ইলিরিয়াকে বম্বের বলিউড বানানো এমন কিছু কঠিন নয়, টুয়েলভথ নাইটে জাহাজডুবি ছিল কমেডির প্রস্তুতি হিসেবে, সেটাও সহজে আরবসাগরের তটভূমির সঙ্গে পাকিস্তানকে জড়িয়ে নেওয়া ছিল অনিবার্য। কিন্তু ব্রাত্য হিন্দি গান আর নাচ আর অবভাষা দিয়ে যে হুল্লোড় এবং গ্রোটেস্ক তৈরি করলেন, বাংলা নাটকে ইতিহাস হয়ে গেল।
মিডল টেম্পল হলের স্টেজকে (জন ম্যানিংহ্যামের ডায়েরি থেকে জানা যায়) নামিয়ে আনলেন উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে। এবং বিদীর্ণ করলেন এলিজাবেথান মঞ্চশৈলীকে।
‘বোমা’ বানানোর পর কেউ যে বোম্বাই বানায়, আমার জানা ছিল না। দ্বাদশ নিশীথের যে ‘ম্যাডনেস’, যে মোচ্ছব, যে মরীচিকা তার উদ্যাপন যদি শেক্সপিয়র করে থাকেন, ব্রাত্য উদ্যাপন করলেন বৈভবের ভাঁড়ামো অথবা ভাঁড়ামোর বৈভব। এমন এক শহরের কাহিনি যে শহর প্রতারণাকে স্বীকৃতি দেয়, ছদ্মবেশকে দেয় আভিজাত্য, মাফিয়াকে দেয় সম্ভ্রম।
দাপাদাপি, ক্যাওড়ামি এবং হিন্দিগান— এই অচ্ছুৎ সন্তান নাটকটাকে যোজনগন্ধা করে তুলেছে। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে মঞ্চে ছিল রোম্যান্টিক গান, সেটা ছিল ইলিরিয়ার আকাশ— আর এখানে মুম্বই বিস্ফোরণ হয়ে যাওয়ার পর জেগে ওঠা এমন এক মানবভূখণ্ডের অবচেতন যা কিনা বাঁচতে চায় হিন্দি গানের নাভি ও নৈঋতে।
গত এক দশকে বাংলা নাটক যে ভাবে উঠে এসেছে শুধু নাটক হিসেবে নয়, ডুডু ও তামাক হিসেবে নয়, বিনোদ ও বিশ্লেষণ হিসেবে নয়, উঠে এসেছে এক কীর্তিনাশার ব্লু প্রিন্ট হিসেবে, সেখানে ব্রাত্য বসুর ভূমিকা ঠিক সেরকম, যেরকম ভারতীয় নাটকে রতন থিয়ান, কিংবা কন্নড় নাটকে চন্দ্রশেখর কাম্বার। শুধু নাটকে নয়, যে কোনও শিল্পে দুটো জিনিস একসঙ্গে করে দেখানো বড্ড কঠিন— লাফানো ও বসে থাকা। কাড়া-না-কাড়ার মধ্যে লুকিয়ে রাখা দার্শনিক চোরাস্রোত।
নৈরাজ্যের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা সহিষ্ণুতা, মুম্বইয়ের মধ্যে লাগিয়ে রাখা ভারত-পাকিস্তান, মাফিয়া-ক্রিকেট, গ্ল্যামার ও ভিক্ষা— যার শেষে ঘোমটা খুলে বেরিয়ে আসে কয়েক জোড়া মধুচন্দ্রিমা।
ব্রাত্য এই নিজস্ব মঞ্চভাষা তৈরি করে নিয়েছেন, জনপ্রিয় হয়েছেন, কিন্তু জনপ্রিয়তাকে শুঁকে সরিয়ে রেখে আবার খুঁজে নিয়েছেন নতুন বিন্যাসকে। বাংলা থিয়েটার তাঁকে সামনে রেখে ফসল তুলছে ঘরে। আমি তাঁর বেপরোয়া প্রতিভাকে কুর্নিশ জানাই।
‘মুম্বাই নাইটস’ দেখার আগে যদি এক লাইনও শেক্সপিয়র না পড়ে দেখতে যান, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। যে রকম হয়েছিল ২০০৮ সালে, ‘শী ইজ দ্য ম্যান’ সিনেমা হওয়ার পর, হলিউড বুঝতেই দেয়নি ওটা শেক্সপিয়র, ১৬০২-এর শেক্সপিয়র। কিন্তু আমার মতো যারা দুর্ভাগা, যারা নাটকটা পড়িয়েছি, তাদের প্রতি মুহূর্তে ভিরমি খেতে হবে। ব্রাত্যর প্রতি আমার একটা স্পষ্ট অনুযোগ হল, শেক্সপিয়রের ‘কমেডি’-তে ফুল মানে ভাঁড় নয়— ফেস্ট, ফলসস্টাফ, টাচস্টোনদের বলা হয় ‘জেস্টর জিনিয়াস’, সেটা কি ব্রাত্য জানেন না? তাঁরা একই সঙ্গে ‘ফ্রিভলাস এবং ফিলসফিক’। ভাঁড়-ই হয়ে ওঠেন ত্রিকাল ছুঁয়ে থাকা বিনোদন। সেটা পেলাম না কেন, ব্রাত্য?
‘মুম্বাই নাইটস’ কিন্তু ব্রাত্যর লেখা নয়। নাট্যকারের নাম দেবাশিস। কে দেবাশিস? আমি তাঁর নাটক আগে দেখিনি। কিন্তু চমকে গিয়েছি তাঁর লেখার ক্ষমতা দেখে, নির্দেশক ব্রাত্য বসু হয়তো সম্পাদনা করে নিয়েছেন নাটকটাকে, কিন্তু বিনির্মাণের অসামান্য টেক্সটাকে দাঁড় করিয়েছেন দেবাশিস। নবীন নাট্যকার সম্পর্কে আমার একটাই চেতাবনি— সাবধান, ব্রাত্য কিন্তু সেই ড্রাগন, আপনাকে গিলে ফেলতে পারে।
গৌতম হালদার ফিরে এলেন। দেখলেন। জয় করলেন। নট হিসেবে তিনি যখন আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছিলেন তখন ব্রাত্য তাঁকে হাত ধরে তুলে আনলেন সেন্টার স্টেজে। আনলেই হয় না, কাজ করে দেখাতে হয়। তিনি নট, তিনি তাঁর বিখ্যাত ম্যানারিজম থেকে সরে না এসেও এমন এক অভিনয় উপহার দিলেন, যা ভাঙা তোবড়ানো, অকথিত এবং উন্মাদনায় ভাস্বর হয়ে রইল।
নতুন ছেলেমেয়েদের দিয়ে এত ভাল কাজ করানো যায়, সেটাও এই নাটক দেখিয়ে দিল। এক ঝাঁক ছেলে মেয়ে উঠে এল মিনার্ভা রেপার্টরি থেকে। অনন্যা পাল ভট্টচার্য, রায়তী বসুরা বাংলা নাটকে বেড়াতে আসেননি, থাকতে এসেছেন। কোরিওগ্রাফি ও সঙ্গীত এই নাটকের ত্বক ও ধমনি, অভিনন্দন দেবাশিস ও শুভদীপ গুহকে। সঙ্গীত আর নাচ ছিটকে মাঝে মাঝে গায়ে আরবসাগরের বালি এসে পড়ছিল।
কমেডিতে দু’একটা ‘বাইপাস’ থাকে, থাকবেই, না হলে কমেডি করা যায় না। এই নাটকে সেটা ভিখিরির দল।
ভিখিরিকে দিয়ে ব্যবসা করানোটা পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম ব্যবসা, ভিখিরিকে নিয়ে ঠাট্টা করাটা বাজে রসিকতা, সেটা ব্রাত্য জানতেন, দেবাশিস জানতেন, সে জন্যই সারা স্টেজ জুড়ে যখন অজস্র বাটি ধরা ভিখিরির হাত নড়তে থাকে, তখন নাটকটাও তির তির করে কাঁপতে থাকে, তখন মনে হয়, আদিগন্ত বৈভব ও হর্ম্যরাজি থেকে ধারাভি জুড়ে গোটা মুম্বই ভিক্ষে চাইছে, ব্রাত্য ‘বাইপাস’-এ গিয়ে লেবাননের কবি কাহ্লিল জিব্রানের মতো দর্শন বলিয়ে নিলেন, তা আজীবন মনে থাকবে।
জিব্রান লিখেছিলেন, ঝাড়ুদার আর দার্শনিকের সংলাপ। দার্শনিক ঝাড়ুদারকে: তুমি রাস্তা ঝাঁট দাও, বড় কষ্ট হয় দেখে, আই পিটি ইয়্যু। ঝাড়ুদার বলল, স্যার আপনি কী করেন? দার্শনিক বললেন, আমি মানুষের মন পাঠ করি। ঝাড়ুদার বলল, স্যার আই পিটি য়্যু, টু।
মুম্বই নগরীর রাস্তা থেকে ক্লেদ ও কমেডিকে যে ভাবে তুলে আনলেন তাকে আর এক বসুর ভাষায় (বুদ্ধদেব বসু) বলা যায় ‘ক্লেদজ কুসুম’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy