জোড়াসাঁকো, ১৯০৬।
‘‘না হে, তোমার দ্বারা আঁকাজোকা হবে না! তুমি বরং...’’
ধমক খেয়ে কালোপানা ছেলেটির চারপাশে যেন আঁধার নেমে এল। মুখ নিচু। মাটির দিকে চোখ।
ছবির কিছুই হয়নি!
ছেলেটি আকাশপাতাল ভাবছে। ভেবেই চলেছে। সব ভুল?
রঙের মেদুরতা-রেখার বাঁক, উত্তর কলকাতার এ দোকান- সে দোকান ঘুরে ঘুরে সচিত্র দেশি-বিদেশি পত্রিকার পাতায় রাফায়েল, বিলাসী রেমব্রান্টের মতো ধ্রুপদী চিত্রকরদের ছবি দেখা... সব, সব বৃথা? হবে না! কলকাতা শিল্প বিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে হেভেল সাহেব, অবনঠাকুরের পায়ের কাছে বসে নেওয়া হবে না শিল্পের দীক্ষা?
‘‘কাল বরং একটি সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি এঁকে এনো।’’
শিল্পের পাঠ নিতে আসা লাজুক, স্বল্পবাক ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিলেন ঠাকুরবাড়ির অবনঠাকুর!
এই ছেলেটিরই নাম নন্দলাল!
•••
কী এমন এঁকেছিলেন নন্দলাল, যা দেখে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ?
পাতা উল্টে দেখে নেব স্মৃতির সে ছবি ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ থেকে। কথক স্বয়ং অবনঠাকুর।
‘‘সত্যেন বটব্যাল বলে এনগ্রেভিং ক্লাসের এক ছাত্র, একটি ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির, বললে, ‘একে আপনার নিতে হবে।’ তখন মাস্টার কিনা, গম্ভীর ভাবে মুখ তুলে তাকালুম।... আমি বললুম, ‘দেখি তোমার হাতের কাজ।’ একটি ছবি দেখালে— একটি মেয়ে, পাশে হরিণ, লতাপাতা গাছগাছড়া, শকুন্তলা এঁকেছিল। এই আজকালকার ছেলেদের মতোন একটু জ্যাঠামি ছিল তাতে।’’
অবনঠাকুরের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরতি পথে শিল্প-বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়েও নন্দলাল চুপটি করে ভেবেছে। কেবলই তাঁর মনে পড়ে গিয়েছে, ‘প্রবাসী’-র পাতায় রবি বর্মা, অন্নদা বাগচিদের ছবির সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের ছাপা ‘বুদ্ধ ও সুজাতা’, ‘নল-দময়ন্তী’, ‘শাহজাহাঁ’, ‘বজ্রমুকুট’ ছবির কথা। সেই সব দেখেই তো অবনঠাকুরের কাছে শিল্পের পাঠ নেওয়ার কথা ভেবে ছিল সে।
কিন্তু...!
পরদিন গণেশ এঁকে নিয়েই এসেছিলেন নন্দলাল। তাঁর ‘সিদ্ধিদাতা’ দেখে খুব কৌতুক হয়েছিল অভিজাত ঠাকুর পরিবারের মেজাজি শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের। চশমার ফাঁক দিয়ে ছবির দিকে অপলক চেয়েছিলেন বহুক্ষণ। স্মৃতির অতল থেকে তিনি লিখেওছিলেন পরে, ‘‘একটি কাঠিতে ন্যাকড়া জড়ানো, সেই ন্যাকড়ার উপরে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি। বেশ এঁকেছিল প্রভাতভানুর বর্ণনা দিয়ে। বললুম, ‘সাবাস’!’’
•••
শান্তিনিকেতন, ২০১৫।
এই রোদ, এই ছায়া।
আশ্বিনের অনন্ত দুপুরে ছায়া আঁকা মেঘেদের খেলা চলছে ভুবনডাঙার বাঁধের পাড়ে, খোয়াই- শালবনে।
একসময় নরম রোদ নেমে এলে, শ্রীনিকেতন যাওয়ার পথে ছায়াময় হল ‘মাধবী’ বাড়ির বনবনান্ত, বাগান।
দীর্ঘ শিরীষ, দেবদারু, একলা পাইনের নিবিড় ছায়ায় ছায়ায় যেন স্মৃতিতে ছাপানো ছবিরা ভিড় করে এল শিল্পগুরুর স্মৃতিধন্য বিজন-বাড়িতে।
ছায়াময় বাগানে হাঁটতে হাঁটতে ‘দাদু’ নন্দলাল বসুর কথা বলছিলেন তাঁর বড় মেয়ে গৌরীদেবীর ছেলে, প্রদ্যোত ভঞ্জ। স্মৃতি উপচে দীর্ঘ সেই কথন আর উপকথনে কখনও সখনও স্মৃতির রত্নকণা উপুড় করে দিলেন প্রদ্যোত-জায়া আরতিদেবী।
কেমন মানুষ ছিলেন ঘরোয়া, আটপৌরে নন্দলাল বসু?
রেকাব পাততেই মিলল জবাব।
‘‘লাজুক ও মিতবাক নন্দলাল কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। আর্টস্কুলে ভর্তির পর মেতে উঠলেন ছবির আশমানদারিতে। আলাপি অবনীন্দ্রনাথ নিজের স্টুডিয়োতে কাজের ফাঁকে পুরাণকথা শোনাতেন ছাত্রদের। দাদুর মনের গহনে যা দারুণ প্রভাব ফেলে। সারাক্ষণ ভাবেন। দাদু এঁকে ফেললেন, ‘সতী’ নামের একটা ছবি।’’
যে ছবির অনুপ্রেরণা ছিলেন ওঁর স্ত্রী সুধীরাদেবী? যে ছবি ছাপা হয়েছিল জাপানের সেই প্রখ্যাত শিল্প পত্রিকা ‘কোক্কা’-য়? আর প্রাচ্যকলা সমিতির প্রর্দশনীতে প্রর্দশিত হয়ে ৫০০ টাকা পুরস্কারও পেলেন? প্রদ্যোতবাবুর কথার পিঠেই জিজ্ঞাসা।
‘‘হ্যাঁ। সে সময় ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টের প্রদর্শনীতে ‘সতী’ ছবিটা খুব প্রশংসিতও হয় শুনেছি। দাদুর জীবনে ১৯০৭ বা, তার পরের বছরগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময়ই দিদা সুধীরাদেবী তাঁর প্রথম কন্যা সন্তান অর্থাৎ আমার মায়ের জন্ম দেন। দাদুর একটি ছবির নামে মায়ের নাম রাখা হয়েছিল, গৌরী। দিদার কাছে শুনেছি, পূর্ব-বিহারের হাভেলি-খড়্গপুরে মায়ের জন্মের পর পর দাদু দেশের প্রাচীন কলা-কেন্দ্রগুলি দেখার জন্য ভারত-ভ্রমণে গিয়েছিলেন।’’
বিবেকানন্দের সহপাঠী, চিত্রকর প্রিয়নাথ সিংহের সঙ্গে দেশজুড়ে শিল্পের এক সাকিন থেকে অন্য সাকিন ঘুরে কলকাতায় ফিরলেন নন্দলাল।
মেতে উঠলেন, কালীঘাটের পট আর লোকশিল্প নিয়ে। পটুয়া নিবারণ ঘোষদের কাছে গিয়ে অতিদ্রুত রেখা ও রঙের কাজে সেই হাত মকসো তাঁর।
পট আঁকার সেই অভিজ্ঞতার কথা অনেক পরে বলেওছিলেন। ‘‘ভাবলুম, গ্রামে বসে ফোক-আর্ট করে রোজগার করব। দেশে বসে আঁকব, দেশেই বিক্রি করব।... দাম কত? চার পয়সা করে। বাড়ির পাশেই মুদির দোকান। সুতোয় বেঁধে টাঙিয়ে দিতুম সেখানে আমার ছবির পসরা। ... আট আনা দশ আনা এক টাকাও বিক্রি হত সারাদিনে। কোনও দিন আবার হতও না। ... সহসা একটা ঘটনায় অ্যাটিচুড বদলে গেল। হাত গুটিয়ে গেল। অবনীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেছি।... বগলে আমার অ-বিক্রি ছবির তাড়া।... তিরিশ খানি ছবির জন্য তিরিশ টাকা দিয়ে অবনীবাবু কিনে নিলেন আমার সব ছবি। …ও-খেলা ছেড়ে দিলুম।’’
•••
হেভেল সাহেবের প্রণোদনায় ও ভগিনী নিবেদিতার আগ্রহে ১৯০৯-এ তিন বিদেশিনী শিল্পীর সঙ্গে তিনি বেরিয়ে পড়লেন অজন্তার পথে।
অজন্তার ভিত্তিচিত্রের অনুকৃতি করতে। তিন বিদেশিনী চিত্রকরের একজন হলেন হেভেল সাহেবের বন্ধু সি জি হেরিংহোমের স্ত্রী ক্রিশ্চিয়ানা। এ দেশে আসার সময় তিনিই সঙ্গে করে আরও দুই শিল্পী— কুমারী ডরোথি লারচার ও কুমারী লুককে এনেছিলেন।
অজন্তা তখনও এদেশে এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। নন্দলালরা থাকতেন অজন্তার বিজনে। শহর থেকে দূরে। নিভৃত গুহার অন্ধকারে থামের পর থাম, দেওয়ালের পর দেওয়ালে সুডৌল শিল্প ঐশ্বর্য দেখে নির্বাক নন্দলাল।
পাঁচ শিল্পীর অজন্তায় দিন গড়াত গুহা-গহ্বরে, রাত-তাঁবুতে!
দেশে ফিরে অজন্তার সেই অনুকৃতির দিনকালের সাতমহলা ঐশ্বর্যের কথা লিখেছিলেন লেডি সি জে হেরিংহোম। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘অজন্তা, ভল্যুম অফ টেক্সট’। লিখেছেন অসিত হালদারও।
গুরু অবনঠাকুরের সঙ্গে নন্দলাল (ডান দিকে)
কলকাতায় ফিরে অজন্তায় আঁকা স্কেচের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। একদিন ডেকে পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ।
দায়িত্ব দিলেন তাঁর নতুন কবিতার বই ‘চয়নিকা’-র ছবি আঁকার।
কিন্তু সঙ্কোচে-লজ্জায় পড়লেন চিত্রকর। কবিকে বললেন, ‘‘সত্যি কথা কি, আমি আপনার বই পড়িনি বললেই হয়!’’
সঙ্কোচ কাটিয়ে দিলেন কবি।— ‘‘তাতে কী, তুমি পারবে ঠিক।’’
নতজানু নন্দলাল বললেন, ‘‘আসলে, পড়লেও মানে কিছু বুঝিনি।’’ এবার কবি একটু অবাক হলেন। পাণ্ডুলিপি খুলে বললেন, ‘‘এই আমি পড়ছি, তুমি শোনো।’’
রবীন্দ্রনাথ পড়ে শোনালেন সাতটি কবিতা। চয়নিকা ছাপা হল, নন্দলালের ছবি নিয়েই। কিন্তু মুদ্রণ এতই খারাপ যে, দেখে মনখারাপ হয়ে গেল কবির!
‘‘যতদূর জানি, ‘চয়নিকা’-র ইলাসস্ট্রেশন করার সময় থেকেই রবিঠাকুরের সঙ্গে দাদুর আলাপ। শান্তিনিকেতনে আসার পর, গুরুপল্লিতে যেখানে দাদু থাকতেন, সেখানেই জন্ম আমার। পরে এ বাড়ির পাশে নতুন বাড়িতে উঠে এলেন উনি।’’
ডাউন মেমোরি লেনে হাঁটতে হাঁটতে যেন একটার পর একটা সাদাকালো ফোটোগ্রাফ সামনে মেলে ধরছিলেন প্রদ্যোতবাবু। সাতমহলা স্মৃতির সেই সব ফ্রেমে কোনওটায় এস্রাজ বাজাচ্ছেন অবনঠাকুর। পাশে নন্দলাল। কোনওটায় জোব্বা পরা অবনঠাকুরের সঙ্গে আলাপচারিতায় শিল্পাচার্য। কয়েকটিতে ‘দাদু’-র সঙ্গে প্রদ্যোতবাবুও।
•••
নন্দলালের অলঙ্করণে প্রথম বইটি সফল না হলেও, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতনে আহ্বান জানিয়ে সংবর্ধনা দিলেন। সেই প্রথম নন্দলালের শান্তিনিকেতন যাওয়া।
একটু একটু করে, কবির সঙ্গে চিত্রকরের সখ্য নিবিড় হল। এই আলাপেরই বিস্তার তারও দু’বছর পর। কবির সঙ্গী হয়ে যেবার শিলাইদহে গেলেন নন্দলাল।
শাজাদপুরে পদ্মার অপার্থিব সৌন্দর্যকে রেখায় রেখায় স্কেচখাতায় ধরলেন তিনি। নিপুণ রেখায় আঁকলেন ‘শীতের সন্ধ্যার পদ্মা’, ‘জলকে চল’, ‘পোকন মাঝি’।
কিন্তু শিল্প বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল নন্দলালের জীবন। মাসিক বৃত্তিতে অবনীন্দ্রনাথের বাড়িতেই শিল্পের কাজে যোগ দিয়েও স্বস্তি মিলছিল না!
শিল্প বিদ্যালয়ের অধ্যাপক না হয়ে অবনীন্দ্রনাথের স্টুডিয়োতে কেন যোগ দিলেন নন্দলাল?
‘‘কেন না, দাদু আটকে পড়তে চাননি চার দেওয়ালের ক্লাস ঘরে। একটা ঘটনার কথা বলি, খানিকটা আন্দাজ পাবেন। উনি যখন শান্তিনিকেতনে, আমি প্রেসিডেন্সিতে রিসার্চ করছি।
উনি বললেন, ‘কলকাতায় থেকে কী করো তুমি?’
বললাম, ‘রিসার্চ।’
দাদু বললেন, ‘করার দরকারটা কী? রিসার্চ করে কী হবে?’
বললাম, ‘একটা ডক্টরেট ডিগ্রির চেষ্টা করছি।’
উনি শুনে হেসে উঠে বললেন, ‘আমার ডক্টরেট ডিগ্রি তিনখানা আছে। তুমি নেবে? একটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নাও।’’’
শেষ পর্যন্ত অবনঠাকুরের স্টুডিয়োও ছাড়তে হল! এর কিছুদিন পর, রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো বাড়িতে বিচিত্রা স্টুডিয়ো খুললেন। সেখানেই বোধহয়...
‘‘হ্যাঁ ছাড়লেন, তবে এ বার দাদু যোগ দিলেন কবির সেই বিচিত্রা স্টুডিয়োতেই। তখন ষাট টাকা বেতন পেতেন। স্টুডিয়োতে তখন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা ছবি আঁকা শিখতেন। শান্তাদেবী, প্রতিমাদেবী, নীলরতন সরকারের মেয়েরা। সেও একদিন বন্ধ হল টাকার জন্যই। দাদুর অভাব যেন বেড়েই চলল।’’
বছর দেড়েকের মাথায় ‘বিচিত্রা’ উঠে যাওয়ার পর শিল্পী-বন্ধুরা শান্তিনিকেতনে এসে রবিঠাকুরের আশ্রমে যোগ দিলেও, নন্দলাল তখনও দ্বিধা-কাতর! কলকাতা থেকে নড়লেন না। অথচ একে একে এঁকে চললেন ঐশ্বর্যশালী সব ছবি। স্মৃতি তোড়ের মাঝে আরতিদেবী নন্দলালের মহার্ঘ্য সে সব ছবির ক্যাটালগ দেখাচ্ছিলেন। যার পাতায় পাতায় লেপ্টে রয়েছে প্রিন্টে ‘সরস্বতী’, হরিপুরা কংগ্রেসে ‘বীণাবাদিনী’, শেষ দিকের কাজ ‘সাঁওতাল ফসল-নৃত্য’...।
টাকার জন্য হাজার আপত্তি সত্ত্বেও যোগ দিয়েছিলেন গগনঠাকুরের শিল্প সমিতিতে। কিন্তু সে-ও বেশি দিন গেল না। ফের বেকার।
গগনেন্দ্রনাথ তাঁকে একটি চিঠি দিয়ে জানালেন, বাংলার লাটসাহেব যে দিন সমিতি পরিদর্শনে এসেছিলেন, সে দিন সবাই উঠে দাঁড়ালেও নন্দলাল নিজের কাজ নিয়ে বসে ছিলেন, সেই তাঁর অপরাধ! ভরা সংসারে হামলে পড়ল বেকারির জ্বালা।
আর নয়!
এ বার শান্তিনিকেতন।
১৯১৯-এর জুলাই মাসে আশ্রমে যোগ দিলেন নন্দ চিত্রকর।
সেই তখনই কি সপরিবারে শান্তিনিকেতনে চলে এলেন নন্দলাল?
‘‘না, না। দাদু আসার আগের বছরই ছেলেমেয়েদের নিয়ে দিদু শান্তিনিকেতন চলে এসেছিলেন। ওঁরা উঠেছিলেন শান্তিনিকেতনে নতুন বাড়িতে। আমার বিয়ের আগে একবার শান্তিনিকেতন বেড়াতে এসে দাদুকে প্রণাম করি। সেই আমার প্রথম নন্দলাল বসুকে দেখা। শেষের দিকে ইজি চেয়ারে সারাক্ষণ বসে থাকেন। কিন্তু তখনও দেখতাম আঁকছেন।’’
স্মৃতি থেকে কবেকার হারানো কথা ধরিয়ে দিচ্ছিলেন আরতিদেবী।
বিচিত্রা ও শিল্প সমিতি উঠে যাওয়ার পরও নিরুপায় নন্দলালের শান্তিনিকেতন চলে আসা সহজ ছিল না। কেন না, অবনীন্দ্রনাথ কোনও দিনই নিজের প্রিয় ছাত্রকে ছাড়তে চাননি। চিঠি লিখে নিষেধও করেছিলেন নন্দলালকে!
সে চিঠি পড়ে ‘রবিকাকা’ তাঁর ভাইপো অবনঠাকুরকে এক দীর্ঘ চিঠিতে লিখলেন, ‘‘নন্দলালকে যে চিঠি দিয়েছ, সেইটি পড়ে বড় উদ্বিগ্ন হয়েছি। তার জন্য আমাকে অনেক ব্যবস্থা ও খরচ করতে হয়েছে এবং আশাও অনেক করেছিলুম। আমার আশা নিজের জন্যে নয়, দেশের জন্যে। তোমাদেরও জন্যে। এই আশাতেই আমি আর্থিক অসামর্থ্য সত্ত্বেও বিচিত্রা-য় অকৃপণভাবে টাকা খরচ করেছিলুম। ...যদি তোমরা এর ব্যাঘাত কর, তাহলে আমার যা দুঃখ এবং ক্ষতি তাকে গণ্য না করলেও এটা নিশ্চয় জেনো নন্দলালের এতে ক্ষতি হবে এবং তোমাদেরও এতে লাভ হবে না।’’
এ চিঠি কবির অভিমানের চিঠি! তবু গুরু অবনঠাকুরের কথা ফেলতে না পেরে কলকাতায় সমিতির কাজে গেলেন নন্দলাল। তবে, কয়েক মাস পরেই শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন।
•••
কবি আর চিত্রকর ভুবনডাঙার মাঠেই স্বপ্ন দেখলেন নতুন এক শিল্প বিদ্যালয়ের। গড়ে উঠল নতুন এক কলাভবন।
তিন দশকে প্রচার বিমুখ নন্দলাল শান্তিনিকেতনে একে একে ছাত্র হিসাবে পেয়েছিলেন বিনোদবিহারী, রামকিঙ্করের মতো শিল্পীকে।
প্রখর গ্রীষ্মে মাথায় টোকা নিয়ে কাঁকর-বালি-সিমেন্টের মশালা ছুড়ে ছুড়ে সারা দিনমান কিঙ্কর যখন একের পর এক ভাস্কর্য করছেন, নন্দলাল মাথায় ভেজা তোয়ালে জড়িয়ে কেটলি হাতে চা নিয়ে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন। সন্তানস্নেহে ডেকেছেন, ‘এসো হে কিঙ্কর, এসো চা খাও!’ কখনও, কিঙ্কর-বিনোদের কাছে চেয়ে এক-আধটা সিগারেটও খেতেন।
রিকশায় চড়ে শান্তিনিকেতনের পথে
‘‘গুরুপল্লির পুব দিকে দাদু যে মাটির বাড়িটিতে থাকতেন, তার দক্ষিণ দিকের বারান্দায় একচিলতে কাঠ ঘেরা একটা জায়গা ছিল ওঁর স্টুডিয়ো। প্রতিবার শ্রীপঞ্চমীর দিন বিকালে কলাভবনের সকলকে আমন্ত্রণ জানাতেন দাদু। কবির বসন্তের গান গাওয়া হত, কেউ বাজাতেন এস্রাজ। গানের পর, সকলের হাতে ছোট ছোট রেকাবিতে তুলে দেওয়া হত শালফুল, আমের মুকুল আর, পলাশকলি। সেই তখন থেকেই বিশ্বভারতীর নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে ওঁর উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল,’’ প্রদ্যোতবাবুর স্মৃতিচারণের বাঁকেই পারিবারিক ছবির খাতার ভাঁজে মিলল গুরুপল্লির বাড়ির সে ছবি।
একটি ছবিতে দাদু নন্দলাল আর মা গৌরীদেবীর সঙ্গে প্রদ্যোতবাবু। সে যুগে গৌরীদেবীর অভিনয়ের খুব সুখ্যাতি ছিল।
রবীন্দ্রনাথের নিজেরও আস্থা ছিল গৌরীর অভিনয়ে। সে সময় অভিজাত পরিবারের মেয়েদের মঞ্চে উঠে অভিনয়ে লক্ষ্মণরেখা থাকলেও, কখনও নন্দলাল-সুধীরাদেবী আপত্তি করেননি। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁদের কাছে অনুমতি নিয়েছিলেন ‘নটীর পূজা’ নাটকে গৌরীদেবীর অভিনয়ের আগে!
‘‘সে বার মায়ের অভিনয় দেখতে এসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তাঁর গায়ে ছিল গুরুদেবের উপহার দেওয়া বিখ্যাত সেই আরবি জোব্বা।’’
আশ্রমকন্যা ক্ষমা ঘোষের একটি লেখায় মেলে, গৌরীদেবীর অভিনয়ে সেদিন এত মুগ্ধ হয়েছিলেন অবনঠাকুর, যে নিজের জোব্বাটি খুলে গৌরীকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘নে তোর নাচের বকশিশ।’ আর নন্দলালকে বলেছিলেন, ‘এই মেয়ে আগুন স্পর্শ করেছে। একে সাবধানে রেখো!’ এর কিছু দিন পরই নন্দলাল সন্তোষকুমার ভঞ্জের সঙ্গে বিয়ে দিলেন মেয়ের।
•••
কথার পিঠে কথা সাজিয়ে সারা জীবন অজস্র চিঠি লিখেছেন নন্দলাল। সে সব চিঠিতে লেখার থেকে ছবিটাই কখনও সখনও মুখ্য। এক ছাত্রকে যেমন পুরী থেকে চিঠিতে এঁকে পাঠালেন, একজোড়া তোপসে মাছের ছবি। লিখলেন, ‘এখানে মাঝে মাঝে ডিমভরা তোপসে পাওয়া যাচ্ছে।’
মিলল, নাতিকে লেখা একটি হারানো চিঠিও (চিঠিতে অবশ্য প্রদ্যোত নয়, ‘পিন্টু’)।
১০.১০.৪৩ –এ বরোদা থেকে দাদু লিখছেন, ‘‘পিন্টু— তোমরা সকলে আমার ৺বিজয়ার আঃ গ্রহণ করবে। দিদাকে বল এবার দশহরার প্রসেসন মোটে হলনা। দুদিন হল একটী ভাল রাঁধুনী পেয়েছি। ... তোমাদের সকলকার খবর সহ একটা বড় চিঠি লিখ। দিদাকে আমাদের সব খবর দিও। ...আঃ “দাদু”।’’
লেখা আর রেখা এ চিঠিতে মিলেমিশে গেছে। রেখার তুখোড় বাঁকে এঁকে পাঠিয়েছিলেন হনুমানের ছবি।
মাধবী বাড়ির যে ঘরে বসে কথা হচ্ছে, সেই ঘরে একরকম রোজই এসে বসতেন নন্দলাল। বাগানের দিকে মুখ করে বসে দেখতেন খোয়াই, সাঁওতাল পল্লির সহজিয়া জীবন, শালবনের মাথার উপর উড়ন্ত মেঘেদের ঘরবাড়ি।
•••
নন্দলালের ছাত্রদের লেখায় ওঁর ভ্রমণ-স্মৃতি পাই। কখনও সপরিবারে— ‘‘দিদা বেড়াতে ভালবাসতেন। একবার তাগদায়, এখনও একটা দৃশ্য খুব মনে পড়ে, তাগদায় রোজ বাবা আর দাদামশাই ঘোড়ায় চড়ে দার্জিলিং শহরের দিকে যেতেন। ওখানে দাদামশাইয়ের এক ছাত্রের বাড়ি ছিল। ছবিও এঁকেছিলেন তাগদায় থাকার সময়। পুরীতে গিয়েও বেশ কিছু ছবি এঁকেছেন। পুরীর স্মৃতি খুব উজ্জ্বল। পুরীতে গিয়ে দাদুকে পুলিশে ধরল।’’
পুলিশ?
‘‘সে বড় মজার গপ্পো। তখন ওড়িশার গভর্নর ছিলেন কৈলাস নাথ কাটজু। তাঁর সঙ্গে দাদুর চেনা পরিচয় ছিল। তো উনি কাউকে কিছু না বলে, গভর্নর হাউসের বাগান দেখছিলেন। আর তাতেই পুলিশ সন্দেহের বশে ওঁকে আটক করে। শেষে গভর্নরের হস্তক্ষেপে ছাড়া পেলেন। কৈলাসনাথ ক্ষমা চাইলেন, দাদুও খুব অপ্রস্তুত হয়েছিলেন।’’
দাদুর স্মৃতির ভিড়ে প্রদ্যোত ও আরতি
এক্ষুনি বুঝি বৃষ্টি নামবে।
কালো হয়ে এল আশ্বিন আকাশ।
তিন দশক কলাভবনের কাজে ডুবে থাকার পর ’৫১-তে নন্দলাল অবসর নেন। শেষের দিকে অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। একা থাকতে পচ্ছন্দ করতেন।
স্ত্রী সুধীরা বুঝেছিলেন, নন্দলাল সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চান।
সুধীরা তাই রইলেন অন্তরালে!
বনবনান্ত পেরিয়ে, দূরে লালবাঁধের জল ছুঁয়ে বৃষ্টি ধেয়ে আসছে। সেদিকে চেয়ে জানলার কাঁচ টেনে দিতে দিতে, প্রদ্যোতবাবু বলছিলেন নন্দলালের শেষ যাত্রার কথা।
‘‘৬৬ এপ্রিলে একদিন, হঠাৎ করেই খবর গেল, তখন দু’জনেই প্রেসিডেন্সিতে রিসার্চ করি। এক ডাক্তার খবর দিলেন, এখনও কানে বাজে। বললেন, ‘ওহে একটা দুঃসংবাদ দিই। তোমার দাদামশাই চলে গেলেন! আকাশ ভেঙে পড়ল যেন! সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী, পুত্রকে নিয়ে চলে এলাম শান্তিনিকেতন। দেখলাম, চির ঘুমে ঘুমিয়ে আমাদের দাদু!’’
•••
শার্সিতে বৃষ্টির জলজ আলপনা। আধো অন্ধকারে রঙিন কাঁচে সেই জল-আলপনা ক্রমশ জলরঙে আঁকা ক্যানভাস হয়ে যাচ্ছে। ছবি মুছে আরেক ছবি।
আরতিদেবী মোমদান এনে রাখলেন। মোম জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন, ‘‘দাদুকে সে দিন আর আমি দেখিনি। দিদার বাড়িতে গিয়ে ওঁর সেই চরম সময়ে পাশে থেকে গেলাম। দাদুর আঁকা দিদার একটা ছবি ছিল, পোর্ট্রেট। খুব সুন্দর। ওঁদের একা থাকা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে, কিন্তু দাদুর জীবনে দিদার ভূমিকা অনেকখানি। সংসারের সব নিজে দেখতেন উনি।’’
শোনা যায়, শেষ জীবনে দু’জনে আলাদা থাকতেন। নন্দলালের ছাত্রদের কেউ কেউ এমন লিখেছেনও, শিল্পীর মৃত্যুর সময় সুধীরাদেবীকে ডাকতে গেলে তিনি নাকি বলেছিলেন, তাঁকে যেন একটু ‘একা’ থাকতে দেওয়া হয়।
‘‘হ্যাঁ। উনি শেষ দেখা করতে গেলেন না। আসলে শোকের আগুনে ভিতরে ভিতরে পুড়ছিলেন। জানলা দিয়ে দেখলাম, শববাহকেরা ওঁর বাড়ির সামনে একটু অপেক্ষা করে চলে গেল। একটু পরে দাদুকে নিয়ে দূরে, পথের বাঁকে হারিয়ে গেল ওরা।’’
সন্ধে নামার একটু আগে মাধবীবাড়ির বাইরেও হাওয়ায় বিষণ্ণতা। বৃষ্টির পর চরাচরে লালচে-হলুদ আকাশের গায়ে যেন ফুটে উঠেছে কবেকার ধূসর মেঘের আলপনা। একটু আগেই দেখা নন্দলালের রেখার ভুবনের সঙ্গে কোথাও কি তার মিল!
ছবি ও অনুচিত্রণ: অর্ণব ঘোষাল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy