Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ত্রিভুজ

তিনটি নাটক। নির্দেশনায় ব্রাত্য বসু। কান পাতলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।তিনটি নাটক। নির্দেশনায় ব্রাত্য বসু। কান পাতলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।

‘বারবধূ’ দেখে সস্ত্রীক অসীমের সামনে মহানায়ক। ছবি: সৌজন্যে অসীম সামন্ত।

‘বারবধূ’ দেখে সস্ত্রীক অসীমের সামনে মহানায়ক। ছবি: সৌজন্যে অসীম সামন্ত।

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৩৯
Share: Save:

বাংলা থিয়েটারে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্রেখট-এর নাটক প্রযোজনা তাঁর।

আর্থার মিলার বা দস্তয়েভস্কিকে বাংলা রঙ্গমঞ্চে প্রথম এনেছিলেন তিনিই।

এই মানুষটিরই শেষ জীবন কেটেছে রাজাবাজারের প্রতাপ মঞ্চের ব্যাকস্টেজে, একফালি বিছানায়!

তখন সম্বল বলতে দিন গেলে বাড়ি থেকে বউয়ের পাঠানো কুড়িটা টাকা। একটা ক্যাসেট রেকর্ডার। তাতে নিজেরই পুরনো নাটকের টুকরো। আর কয়েকটা জ্যামিতির বই! সিঁড়ি ভাঙার সব অঙ্কে গোহারান হেরে গিয়ে স্কুলপাঠ্যের সম্পাদ্য-উপপাদ্যই ছিল যে তখন তাঁর সময়-গুজরানের আঁকিবুঁকি।

তিনি অসীম চক্রবর্তী।

সত্তর দশকে ‘বারবধূ’ নাটক করে ‘অশ্লীলতা’র দায়ে অভিযুক্ত বিতর্কিত নির্দেশক-অভিনেতা।

‘মুম্বই নাইটস’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’র পাশাপাশি ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায় তৃতীয় যে নাটকটি প্রস্তুতির পথে, তার কাহিনি এই অসীম চক্রবর্তীকে নিয়েই।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘অদ্য শেষ রজনী’ অবলম্বনে একই নামে নাটকটি লিখেছেন ‘আকরিক’ থেকে ‘বিলে’র মতো নাটকের কারিগর উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। প্রযোজনায় পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ। প্রথম শো ১৪ জানুয়ারি। একাডেমি। সন্ধে সাড়ে ছ’টা।

সত্তরের দশক। উত্তর কলকাতা। শব্দে, আলোয়, সেটে, আবহাওয়ায় ব্রাত্যর নাটক আবার যে টাইমমেশিনে চড়িয়ে দর্শককে ফেলে আসা সময়ে ‘পার্সেল’ করে দিতে চায়, প্রস্তুতির আলাপেই তার আভাস পাওয়া গেল।

ঘড় ঘড়, টং টং, ঘটাং ঘট শব্দ করে হেলতে দুলতে একটা এক-কামরার ট্রাম মাঝে মাঝেই ঘুরে যাবে মঞ্চে। সময়ের এলিয়ে চলা, প্রেমের জারিয়ে ওঠার জানান দিতে। হাওয়ার গায়ে স্বপ্নাবেশের ঘন নীল চাদর বোলাতে। অলিগলি, ঘুলঘুলি, চিলেকোঠা, জাফরিওয়ালা বাড়ির সালতামামি ফিরিয়ে আনতে।

মঞ্চে থাকবে ‘স্পেস’ নিয়ে মায়ার খেলা। বাড়িটা হয়ে যাবে থিয়েটার, আর থিয়েটারটা বাড়ি। বাস্তবতা-পরাবাস্তবতার এক আশ্চর্য সহবাস।

অসীমকে নিয়ে শ্যামলের উপন্যাসটি লেখা ’৭৫ থেকে ’৭৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। একটি পত্রিকা তাদের শারদ সংখ্যার জন্য যার পাণ্ডুলিপিটি নেয়। বিজ্ঞাপনও শুরু করে।

এর পর হঠাৎ সম্পাদক লেখককে ডেকে বলেন, এ লেখা তাঁরা ছাপতে পারবেন না। কেননা একটি নাটকের অভিনেতা, অভিনেত্রী উপন্যাসের চরিত্র হয়ে উঠেছে।

বুঝতে অসুবিধে হয় না, আপত্তিকর সে-নাটকটির নাম ‘বারবধূ’। আর অভিনেতাটি হলেন অসীম চক্রবর্তী, অভিনেত্রী কেতকী দত্ত নাটকের নায়িকা।

তত দিনে ‘বারবধূ’ নিয়ে জল বহু দূর গড়িয়ে গেছে। নিষিদ্ধ করার ফতোয়া, হল বুকিং বাতিল করা, কোর্টকাছারি, অভিনয় বন্ধ করে দেওয়া, গ্রুপ থিয়েটারের বহু মান্যিগন্যি মানুষের লাগাতার বিরুদ্ধপ্রচার, তা নিয়ে তর্কাতর্কি— সব মিলিয়ে ডামাডোল। সময়কালটি জরুরি অবস্থার। ফলে অনুমান, কোনও এক কড়া নির্দেশনামায় পত্রিকার শারদসংখ্যায় প্রকাশিতব্য উপন্যাসটি বাতিল হয়ে যায়।

বারবধূ-পর্ব ঘিরে ‘অদ্য শেষ রজনী’ নাটকের আলাপ শুরু। সে-নাটকে ঢুকে পড়ার আগে মানুষ, নাট্যকর্মী অসীম চক্রবর্তী সম্পর্কে দু’চার কথা জেনে নেওয়া যাক।

ঈগল-নাসা। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। ফর্সা গায়ের রং। উচ্চতা ছ’ফুট ছাড়িয়ে। ধবধবে সাদা ঢোলা পাঞ্জাবি আর বড় ঘেরের পাজামা পরা। বুকের বোতাম খোলা। এ মানুষটিকে শুধু মঞ্চে কেন, এক-আধ বার রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে দেখলেও ভুলতে পারা মুশকিল।

পা থেকে চুল অবধি ছিল তাঁর থিয়েটারে মোড়া। শিক্ষকতা করতেন। ছেড়েছেন। ওটুকু মাইনে পেলে থিয়েটারে টাকা ঢালবেন কী করে, তাই। মোটা মাইনের, মোটা কমিশনের সেলস-এর পেশায় ঢুকেছেন। তাও ওই থিয়েটারে টাকার জোগান দেবেন বলে। তাকেও বিদায় দিয়েছেন, মঞ্চকে আরও আঁকড়ে ধরবেন, তাই।

ব্যাঙ্ক, পরিচিত জন, এমনকী কাবুলিওয়ালার কাছেও ধার নিয়েছেন, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা নিঃশেষ করেছেন। সব ওই থিয়েটারের জন্য।

পেটে দানাপানি জোটেনি, তবু থিয়েটার-প্রেম ছাড়তে পারেননি। সে-শুধু তাঁর নিজের দল ‘চতুর্মুখ’-এর জন্য নয়। অন্য দলে অর্থের টান পড়লেও ভাঁড়ারে যখন-যেমন ছিল, উপুড় করে দিয়েছেন।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে এক বার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘অসীম কেমন মানুষ জানেন, আপনি হয়তো কবিতার বই ছাপতে পারছেন না, হাতের ঘড়ি, আংটি খুলে দিয়ে বলবে—নিন, ছাপুন গিয়ে।’’

একের পর এক থিয়েটার করে গেছেন। হল বুক করে শো করেছেন, কিন্তু কানাকড়ি প্রফিট জোটাতে পারেননি। শেষে পার্কেও থিয়েটার বসিয়েছেন। সরকারের শুল্ক দিতে গিয়ে তাতেও জেরবার। ষাটের দশকে ‘নচিকেতা’ করলেন। ‘দেশ’ পত্রিকা লিখল, ‘‘চিন্তাশীল যাঁরা তাঁদের কাছে এই নাটকের আবেদন নিশ্চয়ই আছে।’’ অন্য সব কাগজও ধন্য-ধন্য করল। কিন্তু কাউন্টার? সেই ঢনঢন!

স্টারে তখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার, লিলি চক্রবর্তী, বাসবী নন্দীদের ‘শেষাগ্নি’ চলছে। রঙমহলে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। বিশ্বরূপা-য় ‘সেতু’ মিথ হয়ে গিয়েছে। দর্শকের ঢল সে-সবে।

অসীম আর্থার মিলারের ‘ডেথ অব আ সেলসম্যান’ অবলম্বনে নিজেই লিখলেন ‘জনৈকের মৃত্যু’। শো শুরু হতেই ঝড়। হইহই বিক্রি। তার সঙ্গে বোদ্ধামহলও স্তম্ভিত।

অসীমকে ঘিরে তখন আড্ডা হেদুয়ার ‘বসন্ত কেবিন’-এ। নয়তো কফিহাউস। হাজির রথী-মহারথীর দলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-শক্তি চট্টোপাধ্যায়-পূর্ণেন্দু পত্রীরা। অসীম ক্ষমতাধর এক প্রতিভাকে তখন চিনছেন ওঁরা। আমেরিকায় টেনেসি উইলিয়ামস কি নীল সিমনের নাটক বেরিয়েছে, ফ্রান্সে ক্যামু বা জঁ জেনের— সাত দিনের মধ্যে তা অসীমের কব্জায়।

এ মানুষ যে লঘু থিয়েটার, জনপ্রিয় নাটক করে নামের কাঙাল হতে চান না, তত দিনে স্পষ্ট সবার কাছেই।

তা হলে সেই অসীমই কেন ‘ভালবাসার ব্লো হট নাটক’ স্লোগান দিয়ে ‘বারবধূ’ নামালেন?

অর্থাভাবে? ‘বারবধূ’থেকে লাখ-লাখ টাকা নিশ্চিত, এই ভেবে? তা হয়তো নয়। টেনেসি উইলিয়ামের ‘স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’ অবলম্বনে ‘পুতুল বাগচি’ আর সুবোধ ঘোষের গল্প নিয়ে ‘বারবধূ’ দুটোই একসঙ্গে পাঠ করা হয়েছিল গ্রুপে। ‘বারবধূ’ শুনে কেঁদে ফেলেন অভিনেত্রী কেতকী দত্ত। নাটকের ‘সাফল্য’ নিয়ে আগাম আঁচ পেয়েছিলেন তিনিই। অসীম নন। দেড় হাজার রজনী পার করা নাটকটি ছিল বারবনিতার গল্প। অনেকটা তারই জেরে ‘বারবধূ’ ‘অশ্লীলতা’র দায়ে অভিযুক্ত হয়। কিন্তু নাটক দেখে অভিভূতদের দলে যাঁরা পড়েন, তাঁদের মধ্যে আছেন শিবনারায়ণ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে মন্মথ রায়ের মতো প্রাজ্ঞজন। এমনকী মহানায়ক উত্তমকুমারও।

তা’হলে? তবে?

প্রবল জনপ্রিয়তাই কি শেষমেশ শত্রু হয়ে দাঁড়াল অসীমের? ঈর্ষাকে একটা তাত্ত্বিক মোড়কে ঢেকে কালিতে কালিতে ভরিয়ে দিয়ে তাঁকে দৌড় থেকে ছিটকে দেওয়া হল?

অনেক যদি-কিন্তুর ভিড়ে, ছোবল খেতে খেতে অসীম পাল্টা প্রশ্ন তোলেন— শুধু বারবনিতা নিয়ে নাটকই যদি আপত্তির কারণ হয়, তো একই সময় চলা ‘নান্দীকার’-এর ‘ভালোমানুষ’ কেন ছাড় পায়! সে’ও তো তাই। চাপানউতোর এ বার পাহাড়ফাটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল!

নাটক ‘অদ্য শেষ রজনী’র পরিক্রমা অসীমরূপী অমিয়তে শুরু হয়েও সেই সময়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। অমিয়র সংসারযাপন, অভাব-অনটন, প্রেম-অপ্রেম থেকে বেড়ে ওঠা কাহিনি কখনও তারই গড়া থিয়েটারে ঢুকে, কখনও তাকেও ছাপিয়ে গিয়ে এমুখো-ওমুখো আলপথে হাঁটা দেয়! বাঁজা জমির বিষময়তায় আলো ফেলে। জনপ্রিয়তার সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার যে চিরকালীন সংঘাত, তাকে ‘অ্যাড্রেস’ করে। এলোপাথা়ড়ি ধাক্কাধাক্কি চালায়।

এ সবই সংলাপে-কাহিনিতে ধরে যন্ত্রণার, বমনের, পলায়নের, জিততে চাওয়ার, কখনও বা ঈর্ষাপরায়ণতার, আবার কাতরতারও গল্প বলে যান অমিয় (অনির্বাণ ভট্টাচার্য), তার বউ মালা (অঙ্কিতা মাজি), অভিনেত্রী রজনী (দেবযানী চট্টোপাধ্যায়), নাট্যপ্রেমী বিষ্ণু দত্তরা (সত্রাজিৎ সরকার)। সংলাপের চলনেই যুগ থেকে যুগান্তরে একে একে যেন আয়না জেগে ওঠে। তাতে মুখ দেখা যায় অসংখ্য। অনবরত। কত কালের স্তব্ধতা মুছে একে একে শব্দরা জুড়ে জুড়ে ভাষা বুনে যায়।

বাকি দুই


ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’।

• ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-কে মঞ্চে আনছেন ব্রাত্য বসু। মঞ্চে অভিনয়, সেই সঙ্গে পর্দায় বার কয়েক ছায়াছবি।
তাও ঋত্বিকের সিনেমার নয়, এ নাটকের কুশীলবেরই অভিনয়ে তৈরি। সিনেমা আর নাটকের যাতায়াতে গড়া এ থিয়েটার।
প্রযোজনা: নৈহাটি ব্রাত্যজন। প্রথম শো: ২ জানুয়ারি।


‘মুম্বই নাইটস’-এ গৌতম হালদার, অনন্যা ভট্টাচার্য।

• স্থান মুম্বই। গল্পে বলিউড। মুহুর্মুহ কোরিওগ্রাফ। ফিল্মি গান। তার মধ্যে ‘অ্যাবসার্ড’ গল্পের মোড়কে ‘ভারচ্যুয়াল’
দুনিয়াকে চ্যালেঞ্জ। এ নিয়েই ব্রাত্যর তৃতীয় নাটক ‘মুম্বই নাইটস’। প্রযোজনা: মিনার্ভা রেপার্টরি। প্রথম শো: ১২ নভেম্বর।

থিয়েটার চলছে না। অভিনেতা অসীম চক্রবর্তীকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, তাই হলে ভাঙচুর হচ্ছে। শুনে হাসপাতালে ‘বন্ড’ সই দিয়ে সটান মঞ্চে এসে উঠেছিলেন অসুস্থ অসীম চক্রবর্তী। উইংসের পাশে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন নার্স!— এমন এক থিয়েটার-উপাসককে এত কাল, এত এত কাল ভুলে ছিল বাংলা থিয়েটার! এ নাটকের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে শত সহস্র বছর ধরে চাপা পড়া কোনও গহ্বর থেকে যেন মুক্ত হতে চলেছে এক প্রাচীন সভ্যতা!

রজনী এখনও বাকি!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy