ব্ল্যাক বোর্ডের উপরে সংস্কৃতে লেখা দুটো মাত্র লাইন।
যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়—
‘আমি সকল শিক্ষকের স্বভাব চাই করিতে বর্ণন/এই দুঃসাধ্য কাজে নিলাম দেবী সরস্বতীর স্মরণ।’
ক্লাসে ঢোকামাত্র বোর্ডের দিকে এক ঝলক চেয়ে সহপাঠী সব্বাই বুঝে গেছে এ কাজটি কার! কিন্তু দামাল-দস্যি রজনীকান্তকে কারও কিচ্ছুটি বলার হিম্মত নেই।
ও দিকে মাস্টারমশাইয়ের কথা ভেবেও তাদের হাড় হিম।
লাস্ট বেঞ্চে বসে রজনী কিন্তু নির্বিকার। মাঝে মাঝে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে সে। আর মিটিমিটি হাসছে।
মাস্টারমশাই ক্লাসে আসার পরেও নিরুত্তাপ রজনী। বোর্ডে চোখ বোলালেন মাস্টার। এর পর তাঁর মুখচোখই বলে দিল কীর্তিমানটি কে, বুঝেছেন তিনি।
ডাক পড়ল রজনীর।
এই হল কিশোরবেলার রজনীকান্ত সেন। ক্লাসের মার্কামারা দুষ্টু ছেলে। পড়াশোনা, খেলাধুলোয় চ্যাম্পিয়ন। আবার দুষ্টুমিতেও পয়লা নম্বর।
গম্ভীর গলায় মাস্টার বললেন, ‘‘আমার স্বভাবই না হয় বর্ণনা করো তুমি। দেখি তোমার ক্ষমতা কেমন!’’
নির্বিকার রজনী হাসতে হাসতে বলল, ‘‘স্যার আপনার ক্লাসে এসে ঘুমোনোর কথাটা তো লিখিনি।’’
এ কথা শুনে সবাই ধরে নিয়েছিল, মারের চোটে রজনী এ বার আস্ত থাকলে হয়! উল্টে দেখল, তেমন কিছুই বললেন না গুরুমশাই।
আসলে রজনীর লেখালেখির অভ্যাস ছোট থেকেই। তাতে প্রশ্রয়ই দিতেন ওঁরা। পক্ষপাতিত্বও থাকত। এক এক সময় কোনও মাস্টারমশাইয়ের বিদায়-সভাতেও কবিতা লিখে শোনানোর ভার পড়ত রজনীর উপরই।
কিশোর রজনীকান্ত এ স্বভাব পায় তার বাবা-জ্যাঠার থেকে। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন। জ্যাঠা গোবিন্দনাথ সেন।
দৌহিত্র দিলীপকুমার
বয়স তখন চোদ্দো কী পনেরো, সংস্কৃত কবিতা লিখে বন্ধু তারকেশ্বরের সঙ্গে দেওয়ানেওয়া করা ছিল রজনীর এক প্রিয় খেলা। এই তারকেশ্বর আবার, বলা যেতে পারে, রজনীর প্রথম সঙ্গীতগুরু।
এ নিয়ে তারকেশ্বর পরে এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘‘চৌতাল, সুর ফাঁক প্রভৃতি একবার করিয়া তাহাকে দেখাইয়া দিতাম, তাহাতেই সে তাহা আয়ত্ত করিত এবং ওই সকল তালের মধ্যে আমাকে সে এমন কূট প্রশ্ন করিত যে আমার অল্পবিদ্যায় কিছুই কুলাইত না।’’
দুষ্টুমিতে প্রখর। অন্য দিকে সঙ্গীতে গুণপনা তাঁর ষোলো আনা। রজনীর গান শুনলে যেন সবার সম্মোহন হত। আবার গাইতে বসলে রজনীও যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য!
এক দিনের কথা।
রজনী তখন অবশ্য প্রাপ্তবয়স্ক। সন্তানের পিতাও বটে।
মজলিস বসেছে বৈঠকখানায়। বন্ধুরা হাজির। কটা সাহেব, দেবেন চক্রবর্তী…। বরাবরের মতো গাইতে বসে এ বারও হুঁশ নেই রজনীর।
এ দিকে ভিতর-বাড়িতে তখন হুলুস্থূল কাণ্ড!
রজনীকান্তের এক ছেলে ঘোরতর অসুস্থ। বেশ কয়েক বার চাকরকে দিয়ে স্বামীকে ডাক পাঠিয়েছেন স্ত্রী হিরণ্ময়ী। গানে বিভোর রজনীর নাগাল পায়নি সে। বার বারই বৈঠকখানায় গিয়ে অপেক্ষা করে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে।
তিন-চারবারের পর এক বন্ধুর নজরে এল। কে এক জন রজনীকে ডাকতে এসে ফিরে যাচ্ছে বারবার। তাঁর ঠ্যালাতেই এ বার ধ্যান ভাঙল যেন রজনীর। অন্দরে গেলেন তিনি।
দেখলেন, দালানে অসুস্থ ছেলে কোলে বসে হিরণ্ময়ী। অবসন্ন, অসহায় চোখে তাকিয়ে! কেঁদে চলেছেন অঝোর ধারায়। নিজেকে তখন মস্ত পাপীর মতো লাগছিল রজনীর!
পরে এই ঘটনাই বুকে ধরে রজনীকান্ত গান লিখেছিলেন—
‘স্নেহ বিহ্বল করুণা ছল ছল
শিয়রে জাগে কার আঁখি রে
মিটিল সব ক্ষুধা সঞ্জিবনী সুধা
এনেছে অশরণ লাগিরে।’
রজনীকান্তর জীবনে হিরণ্ময়ীর আসাটাও ভারী অদ্ভুত এক গল্প।
১২৯০ বঙ্গাব্দ। ৪ জ্যৈষ্ঠ।
ও দিনই বিয়ে হয় রজনীর। নাবালিকা হিরণ্ময়ীর সঙ্গে।
ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার স্কুল বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর তারকনাথ সেন। হিরণ্ময়ী তাঁর মেয়ে। তখন সবে ইস্কুলের ছাত্রী।
কন্যা সম্প্রদানের সময় এল।
চার হাত এক করতে চলেছেন পুরোহিত। ঠিক সেই সময় বাঁধল গোল।
রজনীর বাবা চিৎকার করে উঠলেন, ‘‘না না এ বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না!’’
মেয়ে-বাড়ির লোকের মাথায় বজ্রাঘাত। মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা হবে নাকি!
হট্টগোল লেগে গেল নিমেষেই। তখন কে কার কথা শোনে!
অত চিৎকারের মধ্যেই হিরণ্ময়ীর জ্যাঠা কোনও ক্রমে বললেন, ‘‘কেন, কোথায় কোন ত্রুটি পেলেন আপনারা? সব তো ঠিকই ছিল এতক্ষণ।’’
রজনীর জ্যাঠামশাই গোবিন্দনাথ এ বার গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘‘মেয়ের হাতে শাঁখা পলা কই, এ কি ব্রাহ্ম বিয়ে হচ্ছে?’’
এত ক্ষণে বোঝা গেল আপত্তির কারণ!
মেয়ে-বাড়ির লোক হিরণ্ময়ীর লেসওয়ালা জ্যাকেটের হাতা থেকে লেস উঠিয়ে দেখালেন, সোনার গয়নার উপর জ্বলজ্বল করছে শাঁখা।
তখন শান্ত হল বরপক্ষ।
সে-সময়কালে চেলি আর চাদর ছাড়া অন্য কোনও বেশ পরে বিয়ে ছিল নৈব নৈব চ। মেয়ের বাড়ি এত নিয়মের ধার ধারেনি। কিন্তু রজনীর পরিবার যে গোঁড়া হিন্দু।
ফলে গোল বেঁধেছিল গোড়াতেই।
শেষে অবশ্য নির্বিঘ্নেই মিটল বিয়ে।
বাসর রাত।
নতুন জামাইবাবুকে ঘিরে ধরেছে শ্যালিকার দল।
গান না শুনে তাঁকে ছাড়া হবে না। ছোট থেকে যতই চঞ্চল হোক রজনী, ঈশ্বর-প্রেমে সে বরাবরই মশগুল।
শ্যালিকাদের মন রাখতে সে দিন জামাইবাবুটি যে গান ধরলেন, তা’ও ওই ঈশ্বরভক্তিরই।—‘‘মধুর হাসিনী মধুর ভাষিণী, শ্যাম বিলাসিনী রে।’’
বিয়ে মিটল।
কিন্তু ওই পর্যন্তই।
হিরণ্ময়ীকে থাকতে হল স্বামীর কাছে নয়, দেশের বা়ড়িতে। রজনীকান্ত রাজশাহীতে, আইনের ছাত্র। স্বামী-স্ত্রীর যোগাযোগ বলতে তখন কালেভদ্রে এক-দুটো চিঠি!
পরে অবশ্য ‘বউমা’ হিরণ্ময়ীকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে রাজশাহীতে চলে এসেছিলেন রজনীর মা।
তখন রজনীকে দেখে কে!
তত দিনে তিনি ওকালতি ধরেছেন। কিন্তু নতুন বউকে পেয়ে শুরু হল কাজে ফাঁকি। আদালতের চেয়ে বাড়িতেই সময় কাটে বেশি।
আর হিরণ্ময়ী?
একগলা ঘোমটা টেনে বালিকা বধূ স্বামীকে খাবার দেয়। পান সেজে আনে। স্বামীর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আলগোছে সে-পান দিয়ে দেয়।
স্বামীর তাতে খুব গোঁসা।
বউয়ের সামনেই এক দিন রজনী মায়ের কাছে অনুযোগ করে বসলেন, ‘‘আমি কি এতই অস্পৃশ্য যে হাতে করে পানটিও দেওয়া যায় না?’’
লজ্জায় এক ছুট্টে বারান্দা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে হিরণ্ময়ী!
রাজশাহীর বসতবাড়ি (অধুনা বিলুপ্ত)
বছর ঘুরল।
নতুন বউয়ের আড় কিছুটা যেন ভাঙল।
হিরণ্ময়ী তত দিনে রজনীর আদরের হিরু। তাও স্বভাব যে পুরোপুরি বদলে গেল, তেমন নয়।
এই সময়কালেরও পরের কথা রজনীকান্তের মেয়ে শান্তিলতাদেবীর লেখায়।
তিনি এক জায়গায় বলেছেন, “বাবা বারান্দায় চেয়ারে বসতেন কোর্ট থেকে এসে। সেই সময়টা ছিল আমাদের সবারই একটা আনন্দের সময়। সবাইকে এসে বসতেও হত।... ঠাকুমা তখন জলখাবার সাজিয়ে দিতেন মায়ের হাতে। মা সেই শ্বেতপাথরের রেকাবিতে সরভাজা, ছানার পায়েস, ক্ষীরের সন্দেশ, পাথরের গেলাসে বেলের শরবত বাবার সামনে এনে দিতেন। বাবা বলতেন, মা, রাঙা বউ এগুলি কাকে দিয়ে গেলেন তা তো বুঝতে পারলাম না।’’
•••
দেখতে শুনতে গম্ভীর লাগলেও রজনীকান্ত বরাবরই রসিক!
এমনকী প্রাপ্তবয়স্ক রজনীর এক-এক রসিকতায় মাঝে মাঝে তাঁর কৈশোর উঁকি মেরে যেত।
ছুটির দুপুরবেলা।
শোয়ার ঘরে গা এলিয়ে ঘুমোচ্ছেন হিরণ্ময়ীদেবী। সঙ্গে আরও অনেকে।
কারও হুঁশ নেই তেমন।
রজনীকান্ত হঠাৎ ঘরে ঢুকে কারও লম্বা চুল বেঁধে দিতেন খাটের পায়ার সঙ্গে। কিংবা এর চুলের সঙ্গে ওর হাত। ঘুম ভাঙলে খেয়াল পড়ত সকলের। তবে তাঁদের বুঝতে অসুবিধা হত না, এর পিছনে কার হাত!
সুযোগ বুঝে দোয়াত-কলম নিয়ে কারও গোঁফ বা কারও ত্রিনয়ন এঁকে দিতেও পিছপা হতেন না রজনীকান্ত।
এমনকী অপকাণ্ড ঘটিয়ে তার মজা দেখতে ঘরের এক কোনায় অপেক্ষা করতেন তিনি চুপিসাড়ে। সকলের ঘুম ভাঙলেই হাততালি দিয়ে হেসে গড়িয়ে এক ছুট্টে হাওয়া।
আরও আছে!
তার এক-আধটি তো রীতিমতো মারাত্মক!
হিরণ্ময়ীর সেমিজের মধ্যে হামেশাই পুকুর থেকে জোঁক এনে ছেড়ে দিতেন স্বয়ং রজনীকান্ত। অল্প দূরে দাঁড়িয়ে তারও ‘মজা’ দেখা চাই।
পিঠের দিকে ঠাণ্ডা কী একটা নড়ছে, বুঝে হিরণ্ময়ীর অস্বস্তি।
দেখে যেন ‘কী হয়েছে কিছুই জানেন না’, এমন ভাব করে এসে রজনীকান্ত এসে দাঁড়াতেন, ‘‘রাঙাবউ, অমন করছ কেন? কী হল পিঠে, দেখাও দেখি!’’
লজ্জায় আরক্ত হিরণ্ময়ীর আগল ভেঙে তাঁকে ‘জোঁক’মুক্ত করতেন প্রেমাতুর রজনী।
•••
রজনীর একটি গান নিয়ে একবার ভয়ানক অভিমান হিরণ্ময়ীর!
রজনী লিখলেন, ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব তোমারি রসালো নন্দনে।’
রেগে গিয়ে হিরণ্ময়ীদেবী বললেন, ‘‘শেষে কী না এই গান লিখলে? তোমার জীবনকে কি আমি এতই দুর্বিষহ করে তুলেছি, যে তা তৃষিত মরু হয়ে গিয়েছে?’’
রজনী কিন্তু অত কিছু ভেবে আদৌ লেখেননি। তবু আহত হিরণ্ময়ীর মন রাখতে কথা দিলেন তিনি, এই গানটি নিজে আর কোনও দিন গাইবেন না। শুধু ছেলেমেয়েদের শেখাবেন। যাতে তাঁরা গাইতে পারে।
হিরণ্ময়ী ছিলেন তাঁর এতটাই প্রাণ!
সংসারের দশটা পাঁচটার ঘড়ির সঙ্গে কোনও দিনই তাল মেলাতে পারেননি রজনী।
কোর্ট থেকে ফিরে মায়ের কাছে এসে বলতেন, “মা পকেট কিন্তু শূন্য। কোর্টে যাই আসি। কিছুই পাইনে। আমার মনে হচ্ছে ওকালতি আমার হবে না।’’
মা আশ্বাস দিতেন— “এত ব্যস্ত কি রজনী, টাকা অত সহজে আসে না। নাই বা এল? তোমার টাকা না হলে কি চলবে না?”
রজনীকান্তের এমন অনেক গল্পের ভাঁড়ার এখনও মজুত ওঁর নাতি দিলীপকুমার রায়ের কাছে।
আটানব্বই বছরের দিলীপকুমার থাকেন কলকাতার দক্ষিণে। বংশের অর্থাভাব তাঁকেও ছুঁয়ে গেছে এক সময়।
যে জন্য দাদামশাইয়ের নামে তিনি যেমন নত হন, তেমন অভিমানও লুকিয়ে রাখেন না।
ডোভার টেরাসে তাঁর বাড়ির এক তলায় বসে দিলীপবাবু বলছিলেন, ‘‘দেখেছি, মা-মাসি-মামারা কেমন অদ্ভুত চুপ থাকত দাদামশাইকে নিয়ে। এমনকী দিদিমাও তাঁকে নিয়ে খুব একটা কিছু বলতেন বলেও মনে পড়ে না। ছোটবেলায় একবার দিদিমাকে দাদামশাই নিয়ে অনেক কিছু জানতে চেয়েছিলাম। সে বার দেখলাম, হঠাৎ উনি রেগে গেলেন। বললেন, যাঁর মৃত্যুর পর দিন জানতাম না ছেলেমেয়েদের কী ভাবে মুড়িটুকু খেতে দেব, তাঁকে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবি না!’’
পরে মায়ের কাছে অবশ্য দাদামশাইয়ের অনেক গল্প পেয়ে ঝুলিতে রসদ পুরেছেন দিলীপবাবু।
তেমনই এক রজনী-কাহিনি শোনা ওঁর কাছে—
সকালবেলা তখনও ঘুমের আমেজ ভাঙেনি। গত রাতের আলিস্যি ছড়িয়ে রয়েছে বাড়ির এ দিক, ও দিক।
বারান্দায় বসে রজনী।
তামাক সাজিয়ে দিল বাড়ির কাজের লোক।
স্নান, পুজো সেরে মা-ও এসে বসেছেন ছেলের পাশে। এই সময়গুলো প্রায় দিন এমনই কাটত।
এক্কেবারে একান্তে মা আর ছেলের।
মা বললেন, ‘‘রজনী তোমার লেখা একটা গান গাও তো।’’
ছেলে আলবোলা সরিয়ে গান ধরলেন, ‘‘তুমি অরূপ স্বরূপ স্বগুণ নির্গুণ দয়াল ভয়াল হরি হে…।’’
—কেমন লাগল মা?
—কেমন লাগল কী বলব বাবা! এ কথা তুমি কোথায় পেলে? এ সুরই বা তোমাকে কে দিল? এতেই তুমি ডুবে থাকো বাবা। আমার আর বুঝবার কিছু নেই!
রজনী উঠে যেতেন খুশি হয়ে।
এতটাই মা-অন্ত রজনী, কোর্টে যাবার আগে জটিল মামলার বিষয়গুলো নিয়েও মা-র সঙ্গে কথা না বলে গাড়িতে উঠতেন না তিনি। মা না-ই বা হলেন উকিল, রজনীর তাতে কী’ইবা এসে যায়!
বিকেলে ফিরে সারাদিনের রোজগার তুলে দিতেন মায়ের হাতেই। আর ছেলেমেয়েদের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি করে তামার পয়সা।
বড় মেয়ে শান্তিলতা বলেছেন, “যেগুলি রুপোর টাকার মতো ঝকঝক করত, সেগুলি বাবা আমাদের ছোটদের দিতেন। আমরা তাতেই খুব খুশি থাকতাম।’’
এক দিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছে শান্তিলতার। ছোট্ট মেয়ে। মা-বাবার পাশেই ঘুমোত সে।
চোখ খুলতেই দেখে, বাবা নেই।
বাবা কোথায়!
ঘুমমাখা চোখে ঘরের মধ্যে ইতিউতি তাকাতেই শান্তিলতা দেখতে পেল, টেবিলে বসে বাবা কী যেন লিখছেন। তবে সেই ‘বাবা’ ঠিক যেন তার চেনা ‘বাবা’ নয়। অচেনা। দূরের কেউ। সাধকপুরুষেরা যেমন হন, তেমন।
আধো আলো। আধো অন্ধকার। তার মধ্যেই বিভোর হয়ে লিখে চলেছেন রজনীকান্ত। ঈশ্বর, সঙ্গীতসাধনা, মানবপ্রেমের এক আশ্চর্য দ্যুতি যেন তাঁকে ঘিরে রয়েছে।
শান্তিলতা পরে বলেছেন, ‘‘ভোর বেলায় বিছানায় বসেই সেই গানে সুর দিয়ে নিজেই গুনগুন করে গাইছেন (বাবা), এই অপূর্ব দৃশ্য, অপূর্ব অনুভূতি প্রত্যক্ষ করেছি।’’
অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে তখন সবে মাত্র আলো ফুটছে। ঘুম ভাঙেনি কারও। রজনীকান্ত উঠে পড়ে ছেলেমেয়েদের ডাকলেন, “চলো। বেরোতে হবে।’’
সবাই অবাক।
—এখন! কোথায়?
তার বেশি প্রশ্ন করার ফুরসত পেল না কেউ। বাবার কথামতো রাস্তায় নেমে পড়ল সকলে।
বেরিয়ে দেখে আরও অনেকে ইতিমধ্যে হাজির হয়ে গিয়েছে। সদলবলে শুরু হল নগর পরিক্রমা। খঞ্জনি বাজিয়ে গান গেয়ে চলেছেন রজনীকান্ত, ‘‘আমরা নেহাত গরিব, নেহাত ছোট, তবু আছি সাত কোটি ভাই জেগে ওঠো।’’
গলা মেলালেন অনেকে।
শেষ জীবনে অসুস্থ রজনী
স্বদেশী। স্বাধীনতা।
রজনী জড়ালেন সেখানেও।
মায়ের কাছে দিলীপবাবু শুনেছেন, বিলিতি সাদা নুন নিষিদ্ধ ছিল তাঁদের বাড়িতে। বদলে চলত কালো কালো সৈন্ধব লবণ বা করকচ লবণ। চিনিও কাশীর চিনি। সে প্রায় ধুলোর মতো।
এক বার কলকাতায় এসেছেন রজনীকান্ত। কাজ সেরে ফিরে যাবার দিন দেখা হল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে।
কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘‘শোনো রজনী, আমার ছেলেদের দিকে চাও! ওদের কিছু দাও। ওদের সামনে এসে দাঁড়াও।’’
ওখানেই উপস্থিত ছিলেন জলধর সেন। তিনিও গলা মেলালেন, ‘‘রজনী ভায়া একটা গান বেঁধে দাও এই ছেলেদের। এরা কিছু পাচ্ছে না। তুমি কথা দাও, সুর দাও। এদের হাতে দেশকে ভালোবাসার মন্ত্র দাও। এরা পথের নিশানা পাক।’’
নিঃশব্দে ঘরে গেলেন রজনী। লিখলেন। সুর দিলেন।
বাইরে বেরিয়ে সবার সামনে গলায় ধরলেন, ‘‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই।’’
দীনদুখিনী মায়ের জন্য গলা মিলিয়ে পথে নামলেন ছেলেরা। একেবারে সামনের সারিতে রজনীকান্ত সেন।
শিয়ালদা হয়ে সারকুলার রোড ধরে মিছিল চলেছে। পা মেলাতে পাশে রইলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীরা।
•••
সে দিনও ঠাকুরঘরে মায়ের সঙ্গে বসেছিলেন রজনীকান্ত। পুজো শেষে মায়ের দেওয়া পুজোর পান খেলেন এক খিলি।
পানের চুনে ঝাঁঝ লেগে রজনীকান্তের গলাটা একটু পুড়ে গেল যেন। এমন তো কতই হয়!
তখন কে জানত, সেই হল শেষের শুরু! কেউ বুঝতেও পারেনি ওই গলার ‘পোড়া’ আসলে জীবনটাকেই পুড়িয়ে খেতে আসছে!
দিব্যি গান গেয়ে চললেন রজনীকান্ত। বাড়তে লাগল গলার সেই ব্যথা। তার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাও।
ফল দিচ্ছিল না কিছুতেই।
দিলীপবাবু বললেন, ‘‘শুনেছিলাম তাঁর চিকিৎসায় এক বার কাশীতে এক মহারাজের কাছে গিয়েছিলেন সবাই। তখন এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। শোনা থেকে আজও অবধি সে-কথা ভুলতে পারিনি। ওখানেই নাকি হঠাৎ একদিন হারিয়ে গিয়েছিল দাদামশাইয়ের ছোট মেয়ে। আমার ছোট মাসি।’’
নৌকোয় করে একটু ঘুরবেন বলে সবাই মিলে বেরিয়েছিলেন সে দিন। কিন্তু কিছু দূর এসে দেখা গেল রজনীর ছোট মেয়ে পাশে নেই।
অতটুকু মেয়ে! কোথায় গেল সে! খোঁজ খোঁজ।
তখন সন্ধে হব হব প্রায়।
হঠাৎ দশাশ্বমেধ ঘাটের চওড়া সিঁড়িতে, একী! কে বসে...?
অবাক হয়ে সবাই দেখেন, এ যে তাঁদের সবার আদরের ছোট মেয়ে!
কী করে যে ওখানে চলে গিয়েছিল সে, কিছুই বলতে পারেনি পরে।
দিলীপবাবু বলছিলেন, ‘‘মায়ের কাছে শুনেছি ওই বয়সে ওই অবস্থাতে ছোট মাসি গান গাইছিল, বল দাও মোরে বল দাও, প্রাণে দাও মোরে শকতি!’’
স্ত্রী হিরণ্ময়ীদেবী
২৮ মাঘ, ১৩১৬।
সারা রাত যন্ত্রণার পরে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হল রজনীকান্তকে। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, ট্র্যাকিওটমি ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
মেডিকেল কলেজে ক্যাপটেন ডেনহাম হোয়াইট একটা বড়সড় দল নিয়ে গলায় অস্ত্রোপচার করতে ঢুকলেন রজনীকান্তের।
অপারেশন হয়ে গেল।
বেডে নিয়ে আসা হল রজনীকান্তকে।
জ্ঞান ফিরছে ধীরে ধীরে। গলায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। সামনে লাগানো নল।
হিরণ্ময়ীকে দেখে ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘‘এই দেখো, কী রকম ব্যবস্থা করে যতীন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। ডাক্তার দেবতা।’’ যতীন, চিকিৎসক যতীন দাশগুপ্ত, রজনীর আত্মীয়।
ব্যাস! এটুকুই যা বলতে পেরেছিলেন। তার পর কে যেন অলক্ষ্যে এসে কণ্ঠ থেকে স্বরটুকু ছিঁড়ে নিয়ে গেল তাঁর।
সকলে স্তব্ধ।
সুরস্রষ্টার গলায় আজ শব্দটুকুও নেই! শেষ কয়েক মাস খাতা পেন্সিলই ছিল রজনীকান্তের কথা বলার একমাত্র সম্বল।
মেডিকেল কলেজের পাশেই ইডেন হাসপাতাল রোডের ১২ নম্বর কটেজ। ওখানেই কাটতে লাগল রজনীকান্তের পরের দিনগুলো।
দেখা করে যেতেন অনেকে।
একে একে। দল বেঁধে। রামতনু লাহিড়ীর ছেলে শরৎ কুমার লাহিড়ী, রামেন্দ্রসুন্দর, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, গিরিশ ঘোষ…।
থিয়েটার করে রজনীকান্তের চিকিৎসার জন্য টাকা তুলে দিলেন গিরিশ ঘোষ। তা জেনে লজ্জিত রজনী খাতার উপর পেন্সিল বুলিয়ে জানতে চাইলেন, ‘‘আমাকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ বলতে পারিস?... ঋণী হয়ে রইলাম যে...।’’
১৩১৭, জৈষ্ঠ্য মাস।
অসুস্থ কবিকে দেখতে এলেন রবীন্দ্রনাথ। বহু বার দুই কবির দেখা হয়েছে সভা-সমিতি বা ব্রাহ্ম সমাজের নানা অনুষ্ঠানে। তবে শেষ দিনগুলোয় আবার রবি-সান্নিধ্য পাবার ইচ্ছে হয়েছিল রজনীকান্তের। সে ইচ্ছেও পূরণ হল তাঁর।
কটেজের কাছে গাড়ি এসে থামল। রজনীকান্তের সামনে এসে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। দু’জনে দু’জনের দিকে নিঃশব্দে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আনমনা কবি এক সময় অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘‘এ কাকে দেখতে এসেছি। কাকে দেখছি!’’
রাজশাহীতে যখন পড়ছেন রজনীকান্ত, সে সময় রাজশাহী-থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রানী’ নাটকে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করলেন তিনি।
‘...এ রাজ্যতে
যত সৈন্য, যত দুর্গ, যত কারাগার
যত লোহার শৃঙ্খল আছে, সব দিয়ে
পারে না কি বাঁধিয়া রাখিতে দৃঢ়বলে
ক্ষুদ্র এক নারীর হৃদয়।... ’
রজনীকান্তর ‘রাজা’ হৃদয় ছুঁয়েছিল রাজশাহীর। বড় সাধ ছিল সে সংলাপ স্বয়ং কবির সামনে বলবেন তিনি। সে আর পূরণ হল না।
মৃত্যুর রাজাসনে বসে তখন দয়ালের অপেক্ষা করছেন কান্তকবি!
বোলপুরে ফিরে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন, ‘‘সে দিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি।... শরীর হার মানিয়াছে কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই।... কাঠ যত পুড়িতেছে অগ্নি আরও তত বেশী করিয়াই জ্বলিতেছে।...’’
সেই অবশিষ্ট কাঠটুকুও এক দিন পুড়ে খাক হয়ে গেল!
২৮ ভাদ্র, ১৩১৭। রাত্রিবেলা।
কান্তকবির শেষ যাত্রায় পা মেলালেন ওঁর সুহৃদেরা।
হিরণ্ময়ীকে কথা দিয়েছিলেন, একটি গান সারা জীবনে তিনি গাইবেন না কখনও। তবে সে গান যেন তাঁর অন্তিম লগ্নে গাওয়া হয়।
এটুকুই ইচ্ছে ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা!
কবির দেহ বেরোল মেডিকেল কলেজের কটেজ থেকে।
সামনে জনতার ঢল।
সবাই গলা মিলিয়েছেন—
‘‘কবে তৃষিত এ মরু
ছাড়িয়া যাইব
তোমারই রসালো নন্দনে...
কবে তাপিত এ চিত
করিব শীতল
তোমারই করুণা চন্দনে।’’
তখন সবে সূর্যের প্রথম আলো দেখবে বলে আড় ভাঙছে আরও একটি দিন!
ঋণ: কান্তকবি রজনীকান্ত (শান্তিলতা রায়),
রজনীকান্ত কাব্যগুচ্ছ, অর্চনা ভৌমিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy