পঞ্চাশের দশক। কানাডার কিউবেক। রাত্রি। নিজের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয়ে গেলেন রাষ্ট্রের ‘সাজানো’ এক অপরাধী!
এর পর একে একে কাহিনির পরম্পরা যত গড়িয়েছে, এ-নাটকে ততই যেন মুছে যেতে থেকেছে স্থান-কালের বেড়াজাল।
ছায়া হয়ে জুড়ে গেছে এক-একটি দেশ। এক-একটি সময়। সরকারি প্রয়োজনে নিরীহ মানুষকেও ‘অপরাধী’ সাজানোর রাষ্ট্রীয় জারিজুরির এক-একটি আখ্যান।
অশোকনগর নাট্যআনন-এর নতুন দুটি প্রযোজনার প্রথমটি এমনই এক কাহিনির— যার নাম ‘রাষ্ট্রীয়...’।
প্রথম শো ৩ জানুয়ারি, সন্ধে সাড়ে ৬টা। তপন থিয়েটার। নাট্যআনন-এর ২৫ বছরের জন্মবার্ষিকী ও নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় দিেন।
দ্বিতীয় নাটকটি ‘মহানাবিক’। যার প্রথম শো ২ জানুয়ারি, সন্ধে ৭টা, একাডেমি।
মহানাবিক-এর সময়কাল ষষ্ঠ শতক। গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের রাজ্যপাট। কাহিনির প্রতিটি বিন্দুতে শিল্প-কৃষি বিতর্ক, ভূস্বামী-বণিক দ্বন্দ্ব, রাজায় রাজায় যুদ্ধ, একাধিক স্বার্থগোষ্ঠীর লড়াই।
এখানেও সময়কালের কাঁটাতারটি যেন হুশ করে উধাও হয়ে জ্যান্ত হয়ে ওঠে সমকাল। দুটি নাটকেরই নির্দেশক চন্দন সেন।
শশাঙ্কর রাজ্যপাটের মতোই পঞ্চাশের দশকে কানাডার ঘটনাটিও জলজ্যান্ত ইতিহাস। ঘোরতর বিতর্কিত। রীতিমতো সাড়াজাগানো।
১৯৮০ সালে যাকে নিয়ে একটি ফরাসি ছবিও হয়ে গিয়েছে— ল’অ্যাফেয়ার কফিন (দ্য কফিন অ্যাফায়ার)। গান বেঁধেছেন ডেল বয়েল ‘মাই ড্যাডি সিন হিম, উইথ শ্যাকলস্ অন দ্য হ্যান্ডস’।
এমনকী জ্যাকস হার্বার্ট নামের এক সাংবাদিক, যিনি কিনা এই ভুয়ো মামলাটি নিয়ে বই লিখে ফেলেছিলেন, তাঁকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয় সেই যাটের দশকে। মোটা জরিমানা হয় তাঁর।
আরও আছে। এই মামলাটি ঘিরে কানাডায় যে শোরগোল শুরু হয়, অনেকটা তারই কারণে ১৯৭৬ সালে মৃত্যুদণ্ডাদেশ স্থগিত হয়ে যায় ও দেশে।
এমন একটি ঐতিহাসিক কাহিনির নথিপত্র ইত্যাদি ঘেঁটে নাটকটি লিখে ফেলেছেন সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা থিয়েটারে সুমন্ত্রর আগমন বেশি দিনের নয়, কিন্ত এ-নাটক নির্মাণে তাঁর মুন্সিয়ানা চোখে পড়ার মতো। জমাট সংলাপ, গল্পের তুখড় গতিতে সওয়ার হওয়া এ-কাহিনির সূক্ষ্ম খেলা টান টান হয়ে যায় সওয়াল-জবাবে তুমুল চড়াই-উৎরাইয়ে, এলোপাথাড়ি ধাক্কাধাক্কিতে। এক-এক সময় যেন ঘাই মেরে যায় উৎপল দত্তর ‘ব্যারিকেড’ নাটকের বুনন।
সবার উপরে আইন সত্য তাহার উপর নাই— এমন স্লোগান দিয়ে কোটি কোটি কাহিনি, ফিল্ম, থিয়েটার হয়েছে, সেখানে এই নাটকের চেহারাটা কিন্তু এক্কেবারে আলাদা। রাষ্ট্রীয় থাবায় পড়ে আইন-আদালতের চেহারাটা যে কী ঠুনকো হয়ে পড়ে, গোটা থিয়েটারটা দাঁড়িয়ে আছে এই সূক্ষ্ম কৌণিক আধারের উপর।— দরকার পড়লে, গ্রেফতারি চাইলে নিরপরাধকে ‘অপরাধী’ বানিয়ে হাজতে পাঠানো, এমনকী তাঁকে চরম শাস্তি দেওয়াটাও রাষ্ট্রের কাছে পুতুলখেলা। এমন একটি ‘বার্তা’ নিয়ে বাংলায় কোনও থিয়েটার আগে হয়েছে কি? মনে তো পড়ে না।
পেনসিলভেনিয়া থেকে আসা তিন শখের শিকারি কুইবেকে এসে রহস্যজনকভাবে মারা গেলেন। কানাডার এই অঞ্চলটি পর্যটন-ব্যবসার ওপর দাঁড়িয়ে। এই খুনের পর সেই ব্যবসা প্রায় উঠে যাওয়ার মুখে। পর্যটক আসা কমতে থাকল। একে একে হোটেল বন্ধ হওয়ার মুখে। টুরিজ্মকে জড়িয়ে অন্যান্য রোজগারপাতির অবস্থাও সঙ্গিন।
এমনকী মার্কিন সেক্রেটারি জন ডালাস সাফ জানিয়ে দিলেন, কুইবেকে তাঁদের যে সব কারখানা খোলার কথা ছিল, সব ক’টির ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হল।
এই অবস্থায় অর্থনীতিকে বাঁচাতে রাষ্ট্রের গ্রেফতারি চাই। চাই-ই চাই। নইলে ‘আইনশৃঙ্খলা’র অবনতি, উপদ্রুত এলাকা ঘোষণার মতো খাঁড়ায় টালমাটাল হয়ে পড়বে ক্ষমতাসীন নেতা-আমলার রাষ্ট্রীয় মাথারাও। তাঁদের লাভের গুড় যাবে অন্য খানে। এ তাঁদের সইবে না।
ফলে তদন্ত। অ্যাটর্নি জেনারেল ডুপ্লেসিস-এর (পঞ্চানন বন্দ্যোপাধ্যায়) নজরদারিতে তদন্তে নামলেন গোয়েন্দাপ্রধান ম্যাটে (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়)। শুরু হল ‘অপরাধী’ বানানোর গোপন প্লট। ভুয়ো সাজানো আইনি লড়াই (অভিযুক্ত পক্ষের আইনজ্ঞ হার্বার্টের চরিত্রে চন্দন সেন)।
সেটে বাহুল্য নেই। এক্কেবারে ব্যাকস্টেজে আখাম্বা একটা ক্রশ, শেকলে জড়ানো। তার নীচেই দু’ধারে দুটি ‘এক্সিট’। মঞ্চের এ ধারে ও ধারে ছোট্ট ছোট্ট মুভেবল বক্স। সওয়াল দৃশ্যে বিচারপতির আসন। অফিস-বাড়িতে চেয়ার-টেবিল। ব্যস্। আলোর চমক নেই। পোশাকে, মিউজিকে যে বাহুল্য আছে, তাও নয়। এ-নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বা ‘স্টার অ্যাট্রাকশন’ বলে যদি কিছু থাকে, তা হল তার কাহিনি। তার চোরা বাঁক। চোখা চোখা সংলাপের ছোবল। রহস্য কাহিনির ধাঁচে সর্পিল গতি। মাপা অভিনয়।
‘মহানাবিক’ লিখেছেন ‘অদ্ভুত আঁধার’, ‘আগুনের বর্ণমালা’র মতো থিয়েটারের নাট্যকার হর ভট্টাচার্য। তাঁর সহায়ক গ্রন্থ বলতে ছিল দু’টি— ড.নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব)’ ও ড. দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’। বাকিটা কল্পনা। এই কল্পকাহিনিতেই নাট্যকার সংকটের ব্যাখ্যায় গিয়েছেন নিজের মতো করে।
সময়কাল শশাঙ্কের (চন্দন সেন) হলেও কাহিনির চলাচলে আগাগোড়া জড়িয়ে থাকেন গৌড়াধিপতির দু-আড়াইশো বছর আগের, বিখ্যাত সেই মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত। মালয়, জাভা, সুমাত্রায় আজও যাঁর শিলালিপি পাওয়া যায়। বুদ্ধগুপ্তর বংশধর কুলিক (ইঞ্জিনিয়ার) চিরগুপ্ত। বহু বছর বাদে তিনি কর্ণসুবর্ণে ফিরলেন। শশাঙ্কেরই শাসনাধীন তাম্রলিপ্তে তখন জঙ্গলের রাজ চলছে।
বিদেশে বিভিন্ন নৌ-নির্মাণশালায় কাজ করে চিরগুপ্তর ধারণা এদেশের সূত্রধর, নৌ-শিল্পীরা কোনও অংশে কম নন। শশাঙ্কের রাজ্যপাটের কৃষিনির্ভর অর্থনীতির যে ভিত্তি, তাঁকে তিনি আমূল বদলাতে চান। উৎপাদনের উপায়-উপকরণের উন্নয়ন চান। এখানে জাহাজ-নির্মাণশালা হবে। লৌহনিষ্কাশন শিল্প হবে। আর তার জন্য চাই জমি। এই জমি নেওয়ার পথেই গোল বেঁধে গেল কৃষির সঙ্গে যুক্ত থাকা সামন্তপ্রভুদের সঙ্গে বণিকদের। শশাঙ্কের সায় কুলিক চিরগুপ্তর প্রতি ষোলো আনা। কিন্তু কোথাও যেন তাঁর পিছুটান সামন্তরাজাদের জন্যও। তাঁদেরই কারও কারও সাহায্য নিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন যে! শেষমেশ আচার্য দেবভট্টর (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়) কাছে শশাঙ্কের আত্মসমর্পণের ভাষা বড় নির্মম— ‘আমি বড় একা আচার্য’! —কোথাও কি মিলে যাচ্ছে সমকালের স্বর? একদা ক্ষমতাবানের ভঙ্গি? তাঁর হতাশা?
আলো-মঞ্চ-সঙ্গীত-শব্দে এখানেও কোনও চমক নেই। ক্ষতবিক্ষত, বিধ্বস্ত, ছত্রখান হয়ে যাওয়া সময়ের দলিলই এ-নাটকের ট্রাম্পকার্ড।
তার নায়ক।
মহানায়ক! মহানাবিক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy