কিছু বাঙালি খাবারের সঙ্গে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ থাকা জরুরি: ‘অবাঙালিরা নিজেদের ঝুঁকিতে এই খাবারগুলো খেতে পারেন।’ বাঙালি খাদ্যরসিকদের প্রিয় কিছু খাবার ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’ এই আপ্তবাক্যকে দশ গোল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আশ্চর্যজনক ভাবে বাঙালিরা যে কোনও খাবারই খুব সহজে হজম করে ফেলতে পারে। বাঙালির পাকযন্ত্র সত্যিই বিস্ময়কর।
ছোটবেলা থেকেই আমাদের উৎসাহিত করা হয়। আমরা লাতিন সাহিত্য, ফ্রয়েড-উত্তর সিনেমা জলের মতো গিলি। পাবলো নেরুদা তো আমাদের কাছে কেকওয়াক। আর ইরানের পারমাণবিক চুক্তি বা ইউরোপের আর্থিক অনিশ্চয়তা তো আমাদের কাছে জলভাত।
এই রকম ডায়েটের পর বদহজম বলে কিছু থাকতে পারে? কাজেকাজেই প্রবেশ তেলেভাজার। তালিকা তার বড়ই দীর্ঘ। আলুর চপ, ফুলুরি, বেগুনি, পেঁয়াজি, ডিমের ডেভিল, আলুর বোম। আর প্রত্যেকটারই কোলেস্টোরেল চরমে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা অসামান্য। তেলেভাজা দুর্বল হৃদয়দের খাদ্য নয়। কিন্তু বাঙালিদের একটা প্রধান খাবার।
এই গল্পটা তো সবাই জানেন তেলেভাজার সঙ্গে ঝালমুড়ি আর কাঁচালঙ্কা চিবোচ্ছিলেন এক বাঙালিবাবু। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে। তাই দেখে এক ইংরেজ সাহেব তাঁকে জেলে পাঠিয়ে দেন। সেই সাহেবের নাকি মনে হয়েছিল ওই খাবারের অসম্ভব ক্ষমতা আছে আস্ত একটা রেজিমেন্ট উড়িয়ে দেওয়ার।
ডুবো তেলে ভাজা যে কোনও খাবারকেই বলা হয় তেলেভাজা। তবে সেগুলো মুচমুচে ভাজা হতে হবে। নানা আকারের সেই ভাজাগুলোর মধ্যে বেগুনের পাতলা টুকরো থেকে মশলা মেশানো সবজির মিশ্রণ— থাকে সবই। কলকাতায় বৃষ্টি হলে, ম্যাচ থাকলে, আচমকা অতিথির আগমন ঘটলে, তেলেভাজাই বাঁচিয়ে দেয়। বা ধরুন আপনি ট্র্যাফিক জ্যামে ফেঁসে আছেন, হঠাৎ একটা সাইনবোর্ড উঁকি দিল। তাতে লেখা ‘পটলার তেলেভাজার দোকান’। ব্যস, আপনাকে আর পায় কে?
তবে তেলেভাজার সঙ্গে বাঙালিয়ানার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে বলাই যায়। তেলেভাজার নাম শুনলেই বাঙালি মাত্রেরই যখন তখন খিদে পেতে আরম্ভ করে। সব চেয়ে কম সময়ে সব চেয়ে উপাদেয় খাবার হিসেবে তেলেভাজার কোনও তুলনা নেই। বেশ কিছু সব্জিকে একসঙ্গে মিশিয়ে চটপট তেলেভাজা বানিয়ে ফেলতে পারেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই করে ফেলতে পারেন।
মূল্যবৃদ্ধির বাজারই হোক বা রক্তের উচ্চচাপ— সব রকমের খাদ্য বিশারদদের সব যুক্তিকেই তেলেভাজা নিজের স্টাইলে উড়িয়ে দিয়েছে। সব বয়সের মানুষ তা সে গরিব হোক বা বড়লোক, ধোঁয়া ওঠা তেলেভাজার গন্ধ আর তাতে প্রথম কামড় বসানোর লোভে সমান ভাবে পাগল। দুঃখ একটাই, কোনও ঐতিহাসিকই তেলেভাজার জন্ম থেকে তার এই সুদীর্ঘ যাত্রা লিপিবদ্ধ করেননি। রসগোল্লা বা কবিরাজি কাটলেটের ইতিহাস নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে তার সিকিভাগ মনোযোগ পায়নি তেলেভাজা। ব্যস্ত রাস্তার গনগনে আগুনেই তেলেভাজার আদর। মর্নিং ওয়াকার হোক বা ব্যস্ত অফিস যাত্রী, ক্লান্ত ট্র্যাফিক পুলিশ, অল্পবয়েসি সিনেমা পাগল, আঁতেল, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী বা শ্রমিক— তেলেভাজার দোকানের ছাউনির নীচে সবাই এক লাইনে। কাগজের ঠোঙাবন্দি হয়ে বা শালপাতার মোড়কে বিটনুন ছড়িয়ে হাতে হাতে চালান হয়ে যায় গরম গরম বেগুনি- ফুলুড়ি। ব্যস্ ওখানেই ইতি। তার পর আবার হালের চারতারা রেস্তোরাঁ আর তার নানাবিধ রান্নার প্রশংসা। রাস্তার তেলেভাজা পড়ে থাকে রাস্তাতেই। খেয়ে সবাই আনন্দ পায় কিন্তু ছাপার কালিতে তার জায়গা হয় না।
ইতিহাসে তেলেভাজা কখনও সখনও জায়গা করে নিয়েছে। যেমন অনেকেই জানেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বরাহনগরে ফাগুলাল শাহের দোকানের তেলেভাজা মাঝেমধ্যেই আনিয়ে খেতেন। আর সুভাষচন্দ্র বসু বিধান সরণির খেদুর দোকানের গরম গরম তেলেভাজার এতটাই ভক্ত ছিলেন যে পরে ওই দোকানের নামকরণ হয়ে যায় নেতাজির তেলেভাজা। তবে এইটুকুতেই তো তেলেভাজার গোটা ইতিহাসকে ধরে ফেলা যায় না।
আমি ভালমতোই জানি পরের বার রথের মেলা থেকে ফেরার সময় এক ঠোঙা তেলেভাজা কিনে এনে কিছু না ভেবেই চিবোতে বসে যাব। তেলেভাজা খাবার সময় আর কোনও রকম ভাবনা চলে না। চুপচাপ খেয়ে যেতে হয়। একটা খুব স্বাদু কামড়ের জন্য জীবনটা এক লহমায় কেমন যেন থমকে দাঁড়ায়। আমাদের গোটা সিস্টেমের ভেতর তেলেভাজা এমন ভাবে ঢুকে বসে আছে যে তাকে নিয়ে আর ভাবার কোনও জায়গা নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy