ফাইল ছবি।
লক্ষ্মী আর সরস্বতী। বাঙালির ঘরে এখন অভাব বলতে এই দু’টোর। দুনিয়া চেনে এমন বড় শিল্পপতি নেই বাঙালির ঘরে। আর নেই বিজ্ঞানে নোবেলজয়ী কোনও বঙ্গসন্তান।
নিজের ঘরে তেমন শিল্পপতি নেই বলে মাঝেমধ্যেই এ-দেশ ও-দেশ থেকে বড় শিল্প আনার স্বপ্ন দেখানো হয় বাঙালিকে। বাঙালি সেই স্বপ্ন দেখে, এখনও!
কিন্তু এ-দেশ ও-দেশ থেকে বিজ্ঞানে কোনও বঙ্গসন্তানের নোবেল-জয়ের স্বপ্নটা দেখতে বোধহয় ভুলেই গিয়েছে বাঙালি!
নোবেল-বিজ্ঞানে বাঙালি ব্রাত্যই!
১১৮ বছর হয়ে গেল নোবেল পুরস্কারের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিনটে বছর বাদ দিলে যে ১১৫ বার বিজ্ঞানে (পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞান) নোবেল দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে নাম নেই এক জন বঙ্গসন্তানেরও। ইতিহাস বলছে, বিজ্ঞান গবেষণার সেরা পুরস্কারের মঞ্চে জাতি হিসেবে বাঙালি আপাতত, ব্রাত্যই!
বাঙালিকে নোবেল-আনন্দ দিয়েছেন সাকুল্যে তিন জন। ১৯১৩-য় সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ। ৮৫ বছর পর ১৯৯৮-এ অমর্ত্য সেন। অর্থনীতিতে। তার ২১ বছর পর ২০১৯-এ ফের অর্থনীতিতে বাঙালির ঘরে নোবেল আনলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশ চন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও অমল রায়চৌধুরীর জাতির গলায় বিজ্ঞানের সেরা পদকটা এখনও ঝোলেনি। পুরস্কারের জন্য মেঘনাদের নাম পাঁচ বার মনোনীত হওয়ার পরেও।
৮-এ ৪, তবু বাঙালি নেই...
এমন নয়, বিজ্ঞানে নোবেলের মঞ্চ থেকে একেবারেই দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে ভারতীয় বা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের! সাহিত্য, শান্তি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান-সহ নোবেল-জয়ের ইতিহাসে ভারত এখনও পর্যন্ত গর্ব বোধ করতে পেরেছে ৮ বার (মাদার টেরিজাকে ধরে)।
তার মধ্যে বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন ৪ জন। হরগোবিন্দ খোরানাকে বাদ দিলে যাঁদের তিন জনই দক্ষিণ ভারতীয় বা বংশোদ্ভূত। চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরামন, সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর (‘চন্দ্র’ নামেই জনপ্রিয়) ও বেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণণ (‘বেঙ্কি’ নামে জনপ্রিয়)।
হালে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানের গবেষণায় একটি নামই মনে করতে পারে বাঙালি। অশোক সেন। কিন্তু পুরস্কারের নিয়মবিধির জন্য তিনিও নোবেল পাননি। পেয়েছেন সমতুল্য একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ২০১২ সালে তাঁকে দেওয়া হয় ৩০ লক্ষ ডলার অর্থমূল্যের ‘ফান্ডামেন্টাল ফিজিক্স প্রাইজ’।
বিজ্ঞানীরা বাঙালির ‘হাফ দেবতা’! কিন্তু...
গড়পড়তা বাঙালিকে প্রশ্ন করুন। বিজ্ঞানী বলতে তাঁরা বোঝেন, ‘হাফ-দেবতা’! কলেজে পা দেওয়া ছেলেমেয়েদের কাছে জানতে চান। গড়গড়িয়ে বলে দেবে দুই ‘বোস’ আর ‘সাহা’র নাম। জানতে চান, এর পর কোনও নাম মনে পড়ছে কি না। থমকে যাবে।
আর টুইটে যাঁরা নিয়মিত বিদেশি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ভালবাসেন, তাঁদের গবেষণাগুলির টুইট বেশি ‘রি-টুইট’ করেন চোখে পড়ার, বাড়তি ‘লাইক’ পাওয়ার মোহে, সেই বাঙালি বিজ্ঞানীদের একাংশের কাছে মতামত জানতে চেয়ে ই-মেল পাঠালে তাঁরা নিরুত্তর থাকতেই বেশি পছন্দ করেন! না হলে যে আয়নায় মুখ দেখতে হয় নিজেদের!
যাঁরা মতামত দেন, তাঁরা বিস্তর ভেবেচিন্তে বলেন, ‘‘বিজ্ঞানে বাঙালির নোবেল? অশোকদা (সেন) ছাড়া তো আর কোনও সম্ভাব্য নাম মনে পড়ছে না। আগামী ১০ বছরে সম্ভাব্যের তালিকায় বাকি যে দু’-চারটি নাম মনে আসছে, তাঁরা হয় দক্ষিণ ভারতীয় বা বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক। কোনও বাঙালির নাম নেই সেখানে।’’
কেন ব্রাত্য বাঙালি?
অনেকগুলি কারণ রয়েছে। নিজের ও পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব। উধাও ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা। ছক-ভাঙা অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। যা ৫০ বছর আগেও বাঙালির ছিল যথেষ্টই।
কারণ রয়েছে আরও। অতীত-সর্বস্বতায় ডুবে থেকে অন্যকে অবজ্ঞা, নিজের সব কিছুকেই অভ্রান্ত, অনতিক্রম্য বলে ধরে নেওয়ার ঔদ্ধত্য। অহমিকা। আশপাশকে অস্বীকার করে ‘মুর্খের স্বর্গে’ বাস করার বদভ্যাস। আর বশ্যতার অভ্যাস। কিছু করে দেখানোর জেদটা হারিয়ে ফেলেছে বলে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে যা বাঙালির ‘গুণ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে!
ঝুঁকি নেওয়ার সাহস হারিয়েছে বাঙালি?
মস্ত বড় ঝুঁকিটা নিতেই হয়েছিল এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজির পোস্ট ডক্টরাল ছাত্রী স্বাগতা ঘোষকে। বিজ্ঞান-গবেষণার জন্য। বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (এনসিবিএস)’-এর পরিচিত পরিবেশ, কলকাতার আত্মীয়-পরিজনকে ছেড়ে বছরদু’য়েক আগে স্বাগতা পাড়ি দিয়েছেন সুইডেনে।
আরও পড়ুন- এক্সক্লুসিভ অভিজিৎ: কলকাতা প্রাণবন্ত মেধাচর্চার একটা বড় জায়গা ছিল, এখন আর তা বলা যাবে না
আরও পড়ুন- ‘প্রেসিডেন্সিতে সবাই উচ্চবর্ণের, জেএনইউ-তে আমার জাতপাতের চেতনা, আর হার্ভার্ড শেখাল কঠোর পরিশ্রম
গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক (পোস্ট ডক্টরাল) স্বাগতা বললেন, ‘‘ঝুঁকিটা আমাকে নিতেই হয়েছিল। কারণ, আমি যা নিয়ে গবেষণা করি, তার জন্য যে ধরনের যতটা উন্নত মানের গবেষণাগার, যন্ত্রপাতি, পরিকাঠামো দরকার, সেটা ভারতে পাইনি। সি ভি রমন, সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখরকেও তাঁদের গবেষণার বেশির ভাগটাই বিদেশে করতে হয়েছিল। আর সেখানে তাঁরা অনেক নামজাদা বিজ্ঞানীর সাহচর্য, সহায়তা পেয়েছিলেন।’’
নিয়ম নন, স্বাগতা কয়েক জন ব্যতিক্রমেরই এক জন। ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে।
বিজ্ঞান-গবেষণার পুরোটাই ঝুঁকি। কারণ, যে পথে গবেষণা এগতে পারে আর তার যা ফলাফল হতে পারে ভেবে গবেষকরা গ্র্যান্ট বডি বা কমিটিগুলি থেকে অর্থ মঞ্জুর করান গবেষণা চালানোর জন্য, প্রাকৃতিক কারণেই সেই পথ বদলে যেতে পারে। ফলাফল একেবারেই অন্য রকম হতে পারে। যা গ্র্যান্ট কমিটি বা সংস্থাগুলির অভিপ্রেত না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অর্থাভাবে গবেষণা থামিয়ে দিতে হয়। অথচ, বিজ্ঞানের বহু বড় আবিষ্কারই হয়েছে আচমকা। একটা পথ ধরে এগতে গিয়ে অন্য একটি পথ খুলে গিয়েছে, যার কথা আগে কেউ ভাবেননি।
স্বাগতার কথায়, ‘‘সরকারি অর্থ-সহায়তার ক্ষেত্রে সমস্যাটা মোটেই কম নয়। টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু গবেষণায় যখন অর্থের প্রয়োজন, টাকা সেই সময়ে পৌঁছয় না। দেরি হয়। ফলে, গবেষণার প্রভূত ক্ষতি হয়।’’
বাঙালির ঐতিহ্য: সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, অমল রায়চৌধুরী ও অশোক সেন
বেঙ্গালুরুর ‘ইনস্টিটিউট অফ স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন (ইনস্টেম)’-এর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট সঞ্চারী বন্দ্যোপাধায়ের বক্তব্য, এটার কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক গাফিলতি। অর্থ মঞ্জুর যাঁরা করছেন, অনেক সময়েই তাঁরা বিজ্ঞানের সেই ধারার গবেষণা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। ফলে, গবেষণার কোন অংশে কখন অর্থ সহায়তার প্রয়োজন কতটা, সেটা তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন না। যার খেসারত দিতে হয় গবেষক, বিজ্ঞানীদেরই।
গবেষণা থমকে গেলে জার্নালে ভাল পেপার প্রকাশ করা যায় না। ভাল পেপার তৈরি করতে না পারলে অ্যাসেসমেন্টের সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলি বেঁকে বসে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এই কড়াকড়িটা বেশি। ফলে, চাকরির নিরাপত্তা বা গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে তখন প্রশ্ন ওঠে, জানাচ্ছেন স্বাগতা।
স্বাগতার মতো সঞ্চারীও উন্নত মানের গবেষণাগার পাওয়ার লক্ষ্যে মাসতিনেকের মধ্যেই পাড়ি দিচ্ছেন ডেনমার্কে। যোগ দিচ্ছেন কোপেনহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মোটা মাইনে-বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাট? নাকি গবেষণা?
মেধাবী বাঙালির বিজ্ঞান-প্রতিভার উন্মেষে কি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে উত্তরোত্তর বেড়ে চলা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব? সেই অভাবের জন্যই কি ঝুঁকি নেওয়ার সাহসটা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে বাঙালি?
তেমনটাই মনে করেন মোহালির ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)’-এর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের সহকারী অধ্যাপক ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘ওই সময় বাঙালি বিজ্ঞানীদের উন্নত মানের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষায় আর্থিক সহায়তা পেতেও এতটা অসুবিধা হয়নি। তা সে নিজের পরিবার থেকেই হোক বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।’’
নোবেলে বঙ্গ: রোনাল্ড রস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সি ভি রমন, মাদার টেরিজা, অমর্ত্য সেন ও অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, ‘‘সৃজনশীলতার উন্মেষের সঙ্গে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।’’ বিজ্ঞানের গবেষণায় সফল হতে গেলে অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হয়। অর্থনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক নিরাপত্তার অভাব বাঙালির সেই ঝুঁকি নেওয়ার সাহসটাকেই কমিয়ে দিয়েছে।
এই অর্থনৈতিক বিপন্নতাই খুব সহজে ভাল থাকার, কোনও নতুন চিন্তাভাবনা না করে বহুজাতিক সংস্থায় মোটা মাইনের চাকরি, ফ্ল্যাট, গাড়ি, বাড়ি কেনার মানসিকতা তৈরি করে। এটা এক ধরনের ‘মিডিওক্রিটি’। যার গ্রাসে পড়লে আর জিনিয়াস হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। বিজ্ঞানে তাকলাগানো গবেষণার জন্য যেটা সবচেয়ে জরুরি।
আইনস্টাইনের সেই ‘সুইস ফেডারাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (ইটিএইচ-জুরিখ)’ এবং ‘নোভার্টিস’-এ টানা ১০ বছর গবেষণা করেছেন ইন্দ্রনীল। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘বিদেশে জন্মানো বা বড় হয়ে ওঠা বাঙালিদের মধ্যেও দেখেছি, বিজ্ঞানে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা গবেষণার অনিশ্চিত কেরিয়ার ছেড়ে কম ঝুঁকির ও মোটা মাইনের চাকরিতে ঢুকে পড়ছে। যোগ দিচ্ছে আইবিএম, গুগলের মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলিতে। ছেলেমেয়ে খুব ভাল রেজাল্ট করলেই মা, বাবারা তাদের ঠেলে দিচ্ছেন চাকরির দিকে। মোটা মাইনের চাকরি। ঝুঁকি অনেকটাই কম কেরিয়ারে। ফলে, বাঙালি মেধা আর থাকছে না বিজ্ঞানের গবেষণায়। ঢলে পড়ছে প্রযুক্তির কোলে!’’
বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)’-এর কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্সের ‘ভাটনগর পুরস্কার’ জয়ী অধ্যাপক অরিন্দম ঘোষ জানালেন, তাঁর বাঙালি বন্ধুদের বেশির ভাগই বিদেশে এখন আর অধ্যাপনায় নেই। আইবিএম বা গুগলে চাকরি করেন। অথচ, তাঁর দক্ষিণ ভারতীয় পুরনো বন্ধুদের বেশির ভাগই এখনও রয়েছেন অধ্যাপনায়। মৌল বিজ্ঞান বা ফলিত বিজ্ঞানের গবেষণায়।
ইন্দ্রনীল মনে করেন, বিজ্ঞানের গবেষণায় বাঙালিদের চেয়ে তামিল, কন্নড়, মালয়ালি ছাত্রছাত্রীরা এখন অনেক বেশি মোটিভেটেড এবং ডেডিকেটেড। তারা অনেক বেশি মোটিভেশনের সাথে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাঙালির অতীত-বিলাস!
নতুন কিছু ভাবছি, একেবারেই নতুন ভাবে ভাবছি, কথাটা বাঙালির মুখে আর শোনা যায় না। তা হলেই যে ঝুঁকি নিতে হবে! লক্ষ কোটি ভগবানে ভরসা রেখে চলা বাঙালির মেনে নিতে অসুবিধা হয়নি, আইনস্টাইন ‘ভগবান’। স্টিফেন হকিং ‘ভগবান’। তাঁদেরও যে চ্যালেঞ্জ জানানো যায়, জানানোর জন্য নতুন ভাবে ভাবতে হবে, গত ৫০ বছরে বাঙালি তা ভাবতেই ভুলে গিয়েছে। অথচ ওই চ্যালেঞ্জ জানানোটাই সফল বিজ্ঞান-গবেষণার রীতি।
বাঙালি শিশুকে শেখানো হয় অন্য ভাবে। ‘বড়রা ভুল করতেই পারেন না’! যদি ভুল ধরা পড়ে যায় শেষমেশ, তা হলে বয়সের দোহাই দিয়ে তা এড়িয়ে যেতে শেখানো হয়! ভাবুন, কী মস্ত ভুল হয়ে যাচ্ছে বাঙালি শিশুর শিক্ষায়!
‘‘বিজ্ঞানে কোনও গডফাদার, গডমাদার হয় না। মনীষী-প্রিয় বাঙালিকে সেটা সবচেয়ে আগে বোঝানো দরকার’’, বলছেন স্বাগতা।
যাঁরা মুখ খুললেন: (মধ্য়মণি) জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার, অর্ণব রায়চৌধুরী (১), নবকুমার মণ্ডল (২), সঞ্চারী বন্দ্যোপাধ্যায় (৩), তরুণ সৌরদীপ (৪), প্রতাপ রায়চৌধুরী (৫), অরিন্দম ঘোষ (৬), ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় (৭), সোমক রায়চৌধুরী (৮), স্বাগতা ঘোষ (৯), সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায় (১০)।
অথচ, বাঙালি ডুবে থাকে অতীত-বিলাসে। মনীষীদের ছবি টাঙানো থাকে ঘরে, অফিসের কিউবিক্লে। যাঁদের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা ‘অপরাধ’ বাঙালি সমাজে! শিশুকে শেখানো হয়, ওঁদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। ওঁদের ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়াও অসম্ভবই।
হঠাৎ গাছে ফল আসে? ঘরানা লাগে
গাছে হঠাৎ ফল আসে না। তার জন্য সঠিক জমিতে সঠিক সময়ে সম্ভাবনাময় বীজ রোপণ করতে হয়। তার পর সেই বীজ থেকে চারা গাছ আর তা থেকে বৃক্ষ হতে সময় লাগে। ফল মেলে তার পর। লাগে দীর্ঘ সময়ের প্রতীক্ষা।
আবার, সব জমিতে সব রকমের ফল হয় না। ঘরানাও তেমনই একটা জিনিস। বারাণসী আর লখনউয়ের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানা তো এক দিনের নয়। যদিও দু’টি জায়গাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চার জন্য বন্দিত।
বড়ে গোলাম আলি, ভীমসেন জোশী, রবিশঙ্কররা ভারতের সর্বত্র জন্মাননি। এটা সত্য। এটাও মিথ্যা নয় যে, তাঁরা বা তাঁদের ছাত্ররা বিদেশে গিয়ে হাজার তালিম দিয়েও লন্ডন বা নিউইয়র্কে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সেই ঘরানা তৈরি করতে পারেননি।
এমনটাই বলছেন এনসিবিএস-এর নিউরোসায়েন্স বিভাগের সিনিয়র প্রফেসর ও ‘সেন্টার ফর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিপেয়ার’-এর অধিকর্তা সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়।
তাঁর বক্তব্য, বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে উজ্জ্বল হয়ে ওঠার প্রস্তুতির জন্য দীর্ঘ সময় লাগে একটা জাতির। গড়ে উঠতে হয় একটা ঘরানা। বিজ্ঞানে দুই ‘বোস’ আর ‘সাহা’র পর মূলত রাজনৈতিক কারণে সেই ঘরানা তৈরি হতে পারেনি বাঙালির।
অশোক সেনের মতো প্রতিভার উন্মেষ একেবারেই বিক্ষিপ্ত ঘটনা। ব্যতিক্রম। তা বাঙালি জাতির মধ্যে কোনও ঘরানা তৈরি করতে পারেনি। অশোকের সমকালীন বা তাঁর পরের প্রজন্মের যে বাঙালি বিজ্ঞানীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বা বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের মধ্যেও সেই ঘরানা গড়ে ওঠেনি। ঘরানা তো ইমপোর্ট বা এক্সপোর্ট করা যায় না। তার জন্য স্বতন্ত্র ‘সয়েল’ বা মাটি লাগে। এঁটেল মাটিতে এক রকম ফসল ফলে, দোঁয়াশ মাটিতে অন্য রকম।
আরও পড়ুন- ২০ বছর পেরিয়ে গেল বয়স, এরপর সমুদ্রে ছুড়ে ফেলা হবে মহাকাশ স্টেশনকে
আরও পড়ুন- ‘আমার তত্ত্বের ফাঁকফোকর খুঁজছি, তোমরাও খুঁজে দেখ’, এখনও বলেন জিম পিবল্স
প্রায় এমনটাই মনে করেন আইআইএসসি-র পদার্থবিজ্ঞানের সিনিয়র প্রফেসর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সৌরপদার্থবিজ্ঞানী অর্ণব রায়চৌধুরীও।
তাঁর কথায়, ‘‘আমি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ি। আমার শিক্ষক শ্যামল সেনগুপ্ত সখেদে বলতেন, বাঙালি জাতির মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান-চর্চার ঘরানাটাই তৈরি হয়নি। তবে আমি মনে করি, সেটাই একমাত্র কারণ নয়। দুই ‘বোস’, ‘সাহা’, ‘মহলানবিশ’-এর সময় জাতীয়তাবাদের আলাদা উদ্দীপনা ছিল। শিল্পে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্রিটিশদের বিজ্ঞানের গবেষণা দিয়েই হারিয়ে দিতে হবে, এই জেদটা ছিল। যা দুই ‘বোস’, ‘সাহা’দের উদ্দীপিত করেছিল। আর তার ছাপ পড়েছিল তাঁদের গবেষণায়। রোমাঞ্চকর আবিষ্কারে। ফলে, তাঁরা নোবেল না পাওয়ায় এখনও বাঙালির একাংশকে ‘আহা উহু’ করতে দেখা যায়। বোস, সাহাদের সেই স্পিরিটের অভাব এখন যথেষ্টই। যা স্বাধীনতার পর থেকেই প্রকট হয়েছে। এখন রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিভাজনে তা হয়ে উঠেছে প্রকটতর।’’
অর্ণব অবশ্য এও মনে করেন, এটা আদত কারণ নয়। অনেকগুলি কারণের একটি মাত্র। তাঁর বক্তব্য, শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-চিত্রকলায় বিশ্বের সর্বত্রই একটা সময় রেনেসাঁ হয়েছিল। তার পর একটা দীর্ঘ সময় খরায় কেটেছে। বাঙালির বিজ্ঞান-চর্চার ক্ষেত্রেও অনেকটা সেটাই ঘটেছে। ঘটে চলেছে।
একটি প্রজন্মেই কি বাঙালির বদলে গিয়েছে অনেক কিছু? সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহার নাম এক সময় পৌঁছে গিয়েছিল শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘরে ঘরে। অথচ ঠিক তার পরের প্রজন্মেরই পদার্থবিজ্ঞানী অমল রায়চৌধুরীর নাম জানেন ক’জন শিক্ষিত বাঙালি? প্রশ্ন করলে, প্রায় সব বাঙালিকেই পাল্টা প্রশ্ন করতে শুনবেন, ‘কে উনি?’ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে মৌলিক অবদানের জন্য বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে যিনি সমাদৃত সেই অধ্যাপক রায়চৌধুরীর চেয়ে বাংলার পাড়ার পুজোয় ফিল্মি গান গাওয়া ‘সিঙ্গার’রাও আজ বেশি জনপ্রিয়!
আগামী বছরের প্রস্তুতি: কার মেডেল প্রাপ্য পদার্থবিজ্ঞানে? এক ভারতীয় বিজ্ঞানীকে মনোনয়ন করতে বলেছে নোবেল কমিটি
কারা পদক পেতে পারেন, তা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞানীর মতামত নেয় নোবেল কমিটি। ভারত থেকে নোবেল কমিটি অর্ণবের কাছেও মতামত জানতে চেয়েছে বারতিনেক।
সেই অর্ণবের আক্ষেপ, ‘‘অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীর মাপের বিজ্ঞানীর নাম ঘরে ঘরে না পৌঁছলে বড় বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন কী ভাবে দেখতে শিখবে বাঙালির তরুণ প্রজন্ম?’’
অর্থনীতিতে আসে, বিজ্ঞানে কেন নয়?
পুণের ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)’-র অধিকর্তা সোমক রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘অর্থনীতিতে বাঙালির একটা ঘরানা তৈরি হয়ে গিয়েছে। যে কোনও কারণেই হোক, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেটা দুই বসু, সাহা, মহলানবিশের বাংলায় হয়নি। খুঁজলে দেখবেন, বিদেশে প্রায় প্রতিটি নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান বা সহকারী প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন কোনও না কোনও বাঙালি অর্থনীতিবিদ। বিজ্ঞানে কিন্তু অতটা দেখা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে যেমন ইংরেজি, ফিজিক্সের পাশাপাশি ইকনমিক্স নিয়ে পড়ারও প্রচণ্ড আগ্রহ দেখা যায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। আবার পুণে, বেঙ্গালুরুতে ইকনমিক্স নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়ার আগ্রহ তুলনায় কিছুটা কমই বলব। যে মাটিতে যে ফসল ফলে, অনেকটা যেন সেই রকমই।’’
স্বাগতা ও ইন্দ্রনীলের বক্তব্য, আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণা উত্তরোত্তর পরীক্ষানির্ভর হয়ে পড়ছে। প্রয়োজন হয়ে পড়ছে খুব উচ্চ মানের গবেষণাগার ও যন্ত্রপাতির। সেটা অর্থনীতির গবেষণায় অতটা লাগে না। ঝুঁকিও অনেকটাই কম অর্থনীতির গবেষণায়।
আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় এই পরীক্ষানির্ভরতার গুরুত্ব, তাৎপর্য কতটা, তরুণ প্রজন্মের বাঙালির বিজ্ঞান-মেধাকে তা বুঝতে দেওয়া হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞান শিক্ষার পাঠক্রমে। অরিন্দমের মন্তব্য, ‘‘বাংলা থেকে বিজ্ঞানের গবেষণায় আসা ছাত্রছাত্রীরা দেখছি, তত্ত্বের দিকে বেশ দড়। কিন্তু পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যাপারে ততটা দড় নয়। পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞানের পাঠক্রমে কলেজগুলিতে তত্ত্ব ও পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখতে হবে।’’
গোড়ায় গলদ!
গলদটা কি একেবারে গোড়ায়? প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায়? যা শিশুর প্রতিভার ‘অঙ্কুরোদ্গম’-এর মাটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাল বীজ (প্রতিভা)-এর অভাব নেই বাংলায়। কিন্তু সেই প্রতিভা খুঁজে বের করা আর তাতে শান দেওয়ার মতো শিক্ষক, অভিভাবক নেই বাঙালির ঘরে।
বাঙালি বিজ্ঞানীদের একাংশের বক্তব্য, সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষক, অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ। শিশুরা আসলে ‘বিরাট শিশু’! ভবিষ্যতের সব সম্ভাবনাই তার মধ্যে লুকনো রয়েছে। তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যে। বড় হয়ে সে কী হবে, কী হতে পারে, তার একটা ‘রোডম্যাপ’ ছকে রাখে শিশুর জন্মকালীন জিনগুলিই।
তাই টলোমলো পায়ে কোনও শিশু ভুলে থাকে ফুলে। আর কারও কান্না থামে কামানের নাটবল্টু খুলে। কামানের ভেতরে কী কী আছে, জানতে সে তখন ‘বিরাট শিশু’ হয়ে যায়, কৌতূহলে। দু’টি শিশুর স্বাভাবিক ও প্রাথমিক পছন্দটা এই ভাবেই দু’টি আলাদা ‘রুট’ ধরে। আপন খেয়ালে। তাকে শিখিয়ে দিতে হয় না। এই পছন্দটা তার ‘ন্যাচারাল’।
ভারতে নিউট্রিনো গবেষণার পথিকৃৎ বিজ্ঞানী, কলকাতার ‘সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (এসআইএনপি)’-এর ‘রাজা রামান্না চেয়ার প্রফেসর’ নবকুমার মণ্ডল মনে করেন, শিশুদের পছন্দের পথেই ভাবার স্বাধীনতা দেওয়া হলে পরে ভাল ফলনের আশা করা যায়। আমাদের ভাল লাগা, পছন্দ-অপছন্দ তার ওপর চাপিয়ে দিলে চলবে না। এটা বিদেশে হয় না।
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ঝকঝকে সড়ক ছেড়ে মহাকাশবিজ্ঞানের ‘ভুলভুলাইয়া’য় মজে যাওয়া পুণের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)’-এর পদার্থবিজ্ঞানের চেয়ার প্রফেসর, বিশিষ্ট মহাকাশবিজ্ঞানী তরুণ সৌরদীপ বলছেন, ‘‘এই সাবমিশন চলছে স্কুলের গণ্ডি পেরনোর পরেও। ১২ ক্লাস টপকালেই মা, বাবারা ঠেলছেন আইআইটি-র দিকে। ডাক্তারির দিকে। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান/গণিত-চর্চায় তেমন রোজগার নেই যে! অনেকে সে সবের মোহ ছেড়ে বিজ্ঞানের গবেষণায় ডুবে থাকতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না। বাবা-মায়ের চাহিদার কাছে তাঁদের আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে। সাবমিশন। যেতে হচ্ছে প্রযুক্তির পেশায়। বাঙালির মধ্যেই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ঝোঁকটা কম দেখছি। অন্য জাতি বা ভাষাভাষির ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে।’’
চাপ দিলে শিশুর ব্রেন সেল বাড়ে না
সুমন্ত্র মনে করেন, শিশুর চিন্তার স্বাধীনতা খর্ব করা হলে, তার পক্ষে তা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সারা জীবন ধরে যার বোঝাটা তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। হালের গবেষণা এটাই বলছে। শিশুদের কল্পনাশক্তি বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হলে তাদের মস্তিষ্কের কোষগুলি দ্রুত হারে বাড়ে। কোষগুলির মধ্যে যোগাযোগ আরও দ্রুত ও নিয়মিত হয়। তাতে মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে। নতুন নতুন আইডিয়া জন্মানোর জমিটা তৈরি হয়। তার জন্য ওষুধপত্র লাগে না। তা না হলে, সেই শিশু পরে বিজ্ঞানের গবেষণায় এলে তার কল্পনাশক্তির অভাবটাই প্রকট হয়ে ওঠে। যে বিষয় নিয়ে ছাত্র বা ছাত্রীটি এত দিন পড়াশোনা চালিয়ে এলেন, তার কোন দিকটি তিনি গবেষণার জন্য বেছে নেবেন, সেটাই স্থির করে উঠতে পারেন না। আর সেটা হলে সেই ছাত্র বা ছাত্রীর কাছ থেকে সেরা গবেষণাটাও আশা করা যায় না। সুমন্ত্রের কথায়, ‘‘তাই আমি বলি, কী নিয়ে গবেষণা করবে, সেটা তুমি বেছে নাও। আমি বলে দেব কেন?’’
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা বড়ই ‘শিক্ষক-সর্বস্ব’। শিক্ষকরা তাঁদের ‘ভগবান’! ঘরে টাঙানো ছবির আর পাঁচটা মনীষীর মতো। নিজেকে চেনা, আত্মবিশ্বাসের দাঁড়িপাল্লায় বাঙালি বিজ্ঞান পড়ুয়াদের ওজন যেন আর কিছুতেই বাড়তে চায় না! যে ভাবে গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর মতো রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমেই রবীন্দ্র-স্মরণ প্রথা হয়ে দাঁড়ায়।
ইন্দ্রনীলের কথায়, ‘‘হয়তো রবীন্দ্রনাথও খুশি হতেন, যদি কেউ নিজের ভাবনায় নিজের লেখা কোনও কবিতা দিয়ে তাঁকে স্মরণ করত। তাতে শিশুদের মধ্যে প্রতিভার স্ফূরণ ঘটানো যেত। এটা বিদেশিদের ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু বিদেশে থাকা বাঙালিদেরও দেখেছি, তাঁরাও ওই প্রথা ভেঙে বেরনোর চেষ্টা করেননি। তাই বেরতেও পারেননি। তাঁরাও তাঁদের সন্তানদের ছুটিয়ে চলেছেন ‘যত বেশি পার উপার্জন কর’ মন্ত্রে।’’
‘স্যর’ মানেই সবজান্তা নন!
শিশু যখন শুধুই ডুবে থাকতে চায় খেলায়, নিজেই চিনতে থাকে ‘অচেনার আনন্দ’কে, তখন তার ঘাড়ে গাদাগাদা বই, ভারী সিলেবাস আর খাতার পর খাতা ভরানো হোম টাস্কের বোঝা চাপালে সে তো বিরক্ত হবেই। এটা বিদেশে হয় না।
তরুণ ও নবকুমার মনে করেন, এতে শিশুর স্বাভাবিক পছন্দ, সহজাত ইচ্ছা, প্রতিভা, কল্পনাশক্তি, জিনগত তাগিদটাই বাধা পাচ্ছে। তবু সে সব মেনে নিচ্ছে স্যর, মা-বাবার ভয়ে। প্রাথমিক ভুলটা হচ্ছে এখানেই। শিশুর চিন্তার স্বাধীনতাকে দাবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কল্পনাশক্তি বা আইডিয়াই বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মূল কথা। সেই কল্পনাশক্তির বিকাশের পথটাই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। শিশুকে শুধুই বই মুখস্থ করতে বলা হচ্ছে। বিজ্ঞান বা গণিতের সূত্রগুলি অন্য ভাবে সমাধান করা যায় কি না, তা ভাবতে শেখানো হচ্ছে না। স্যর ভাবছেন, অত সময় দিলে অন্য ছাত্রদের পড়িয়ে তাঁর বাড়তি রোজগার হবে না। মা-বাবারাও ভাবছেন, অন্য ভাবে ভাবতে শেখালে রেজাল্ট খারাপ হবে ছেলেমেয়েদের। এই ভাবেই স্যর, অভিভাবকরা সবজান্তা হয়ে যাচ্ছেন!
ভাবতে শেখানো হচ্ছে না...
মুম্বইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)’-এর কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্সের ‘ভাটনগর পুরস্কার’ জয়ী অধ্যাপক প্রতাপ রায়চৌধুরী মনে করেন, বিজ্ঞানে ভাবনা বা ইমাজিনেশনটাই সবচেয়ে বড় সম্পদ। সেই কল্পনাশক্তিকে বাড়িয়ে তোলারও বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি রয়েছে। যা বহু দিন ধরেই চালু পশ্চিমের উন্নত দেশগুলিতে। বাংলায় তা এখনও চালু হয়নি, সেই অর্থে। ভারতে এ ব্যাপারে পথ দেখিয়েছিল মধ্যপ্রদেশের ‘হোসেঙ্গাবাদ বিজ্ঞান আন্দোলন’।
প্রতাপ বলছেন, ‘‘মানতেই হবে এ দেশে বিজ্ঞানে ভাবতে শেখানোর পথ দেখিয়েছিল ওই আন্দোলনই। অনুসরণ তো দূরের কথা, বাঙালিরা তা অনুকরণও করতে পারেনি!’’
স্যর যা বলছেন, সেটাই করতে হবে!
‘কেন’ আর ‘কী ভাবে’ এই প্রশ্ন শৈশবে যাঁদের মাথায় আসেনি, বড় হয়ে তাঁরা কেউই সফল বিজ্ঞানী হতে পারেননি।
কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে তো শুরু থেকেই সাবমিশন। আত্মসমর্পণ। ছোটদের সব কিছু মেনে নিতে হবে। প্রশ্ন করতে পারবে না শিশুরা।
প্রতাপের কথায়, ‘‘স্যর বলে দিচ্ছেন অঙ্কটা এই ভাবে কষতে হবে। শিশু অন্য উপায়ের কথা ভাবছে। কিন্তু স্যরকে তা বললেই বিপদ। স্যর পড়াচ্ছেন পদার্থের তিনটি অবস্থা। ছাত্রের মাথায় প্রশ্ন আসছে, কেন সেই অবস্থার সংখ্যা ৫/৬ নয়? কিন্তু সেটা বললেই স্যর তাকে চুপ করিয়ে দেবেন। অভিভাবকরাও। এটা পশ্চিমী দেশগুলিতে হয় না। ওরা শিশুকে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা দেয়।’’
শিশুর কাছ থেকে শিখতে হবে স্যরদেরও!
নবকুমার মনে করেন, গোটা স্কুল-স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। শিশুদের কাছ থেকে শেখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে শিক্ষক, অভিভাবকদের। স্যরদের সবজান্তা হয়ে থাকলে চলবে না। তাঁর কথায়, ‘‘শুধুই জ্ঞান বিলি করার বদভ্যাস ছাড়ুন শিক্ষকরা। শিশুদের ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে শিখুন। প্রশ্নের তোড়ে শিশুদের কাছে হেরে যাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করুন শিক্ষকরা। ওই কৌতূহল, ওই প্রশ্নই যাবতীয় আবিষ্কারের জন্মদাত্রী।’’
সোমক অবশ্য ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার সিলেবাসে পিছিয়ে থাকার অভিযোগ মানতে নারাজ। বরং তিনি মনে করেন, ‘পশ্চিমের চেয়ে এ ব্যাপারে কোনও অংশে কম নই আমরা’। তবে তাঁর বক্তব্য, ফলিত বিজ্ঞানের গবেষণায় আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে। এগিয়ে আসতে হবে শিল্প সংস্থা-সহ বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিকেও। বিজ্ঞানের পাঠক্রমে পরীক্ষানিরীক্ষাকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। তার জন্য কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণাগার উন্নত মানের হতে হবে।
বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু? বিজ্ঞান মানে না যে...
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুলের শিক্ষকদের ইগোটা সবচেয়ে বড় সমস্যা। শিশুর সঙ্গে শিক্ষকদের বয়সের ফারাকটা বেশি থাকে স্কুলে। তাই স্কুলের শিক্ষকরা শিশুদের প্রশ্নের কাছে কিছুতেই মাথা নোয়াতে চান না। ইগোয়। শিক্ষকদেরও যে জটিল প্রশ্নের মুখে ফেলা যায়, স্কুল স্তরের ছাত্রছাত্রীদের তা শেখানোও হয় না। কলেজ-স্তরে সেটা কিছুটা কম। কিন্তু তত দিনে শিশুর যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়ে গিয়েছে। চালু ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে সে ভুলে গিয়েছে। বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে সাবমিশনে। ‘বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু...’ এই নীতি নিয়ে চললে আর যা-ই হোক, অন্তত বিজ্ঞানের গবেষণা হয় না। চালু ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার ভাবনাটা হারিয়ে ফেললে বিজ্ঞানে আবিষ্কার করা সম্ভব হয় না। এমনটাই মনে করেন ‘ইনস্টেম’-এর গবেষক সঞ্চারী বন্দ্যোপাধ্যায়।
সমস্যা ভারতেরই: অধ্যাপক জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার
তুলনায় বেশি, কম হতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা শুধুই বাঙালির, মানতে রাজি নন ভারতে মহাকাশবিজ্ঞান গবেষণার অগ্রদূত অধ্যাপক জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার। বরং তিনি মনে করেন, ‘‘ভারতে বিজ্ঞানের গবেষণায় বাঙালি বরাবরই নেতৃত্ব দিয়েছে। সেটা শুধুই দুই বোস, সাহা, মহলানবীশের সময়েই নয়, এখনও বাঙালি সেই ভূমিকা বজায় রেখেছে। গবেষক ছাত্রছাত্রী, বিজ্ঞানীদের মধ্যে এখনও বাঙালিই পাই বেশি।’’
‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে পাঠানো অধ্যাপক জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকারের ই-মেলের একটি
নবকুমার ও সঞ্চারীর বক্তব্যও সেটাই। তাঁরাও মনে করেন, বিজ্ঞানের গবেষণায় এখনও ভারতে এগিয়ে রয়েছেন বাঙালিরাই। এমনকী, আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ এখনও বাঙালিদের থেকেই আসেন।
নবকুমারের আক্ষেপ, ‘‘তবে এ দেশে থেকে তাঁরা তাঁদের সেরাটা বের করে আনতে পারছেন না।’’ সঞ্চারী মনে করেন, সেটা হচ্ছে না গবেষণায় সরকারি অর্থবরাদ্দ কমছে, সেই অর্থ পৌঁছতে দেরি হচ্ছে বলে। গবেষণার কোন অংশে কত দ্রুত অর্থসাহায্য প্রয়োজন, সেই সম্পর্কে গ্র্যান্ট বডি বা কমিটিগুলির স্পষ্ট ধারণা নেই বলে।
নারলিকারের বক্তব্য, সেটা গোটা ভারতের সমস্যা। এ দেশে বিজ্ঞান গবেষণার খোলনলচে বদলাতে হবে। শুধুই প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নয়, মৌল বিজ্ঞানের গবেষণাতেও প্রয়োজন আরও বেশি সরকারি ও বেসরিকারি অর্থবরাদ্দ। আরও বেশি অর্থবরাদ্দ করতে হবে বেশি সংখ্যায় উন্নত মানের গবেষণাগার বানানোর জন্য। ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ (প্রতিভা সন্ধান) প্রক্রিয়া আরও নিখুঁত ও মজবুত হওয়া দরকার। আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলির মতো।
‘‘আর সেটা করা গেলে ভারতে উন্নত মানের বিজ্ঞান গবেষণায় নেতৃত্ব দেবেন সেই বাঙালিরাই’’, জোরালো বিশ্বাস নারলিকারের।
সমর্পণ ছেড়ে আত্মসমীক্ষায়...
বাঙালিই খুঁজে নিক ঘুরে দাঁড়ানোর পথ। আত্মসমর্পণে নয়। আত্মসমীক্ষায়। অনুকরণ বা অনুসরণে নয়। অনন্য বা অনতিক্রম্য হয়ে ওঠার সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞায়। তাতে সময় লাগে লাগুক। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে মেঘনাদ সাহার বার বার বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ বাঙালি ভুলে যাক পদক জয়ের গৌরবে! আজ হোক বা কাল।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy