মলিকিউলার বায়োলজিস্ট রিচার্ড জন রবার্টস
মলিকিউলার বায়োলজিস্ট রিচার্ড জন রবার্টস ‘ফিজ়িয়োলজি অর মেডিসিন’-এ নোবেল প্রাইজ় পান ১৯৯৩ সালে। তাঁর ‘স্প্লিট জিন’-এর আবিষ্কার জিন গবেষণা ও মলিকিউলার বায়োলজি-র ক্ষেত্রে নতুন দিশা দেখিয়েছে। একান্ত সাক্ষাৎকারে সার্স কোভ-২ ভাইরাস নিয়ে অনেক অজানা তথ্য তিনি জানালেন আনন্দবাজারকে।
প্র: প্রথমে গোয়েন্দা হতে চেয়েছিলেন। তার পর রসায়নবিদ। সবশেষে মলিকিউলার বায়োলজিস্ট হলেন। কী ভাবে?
উ: তখন সাত-আট বছর বয়স হবে। স্কুলে পড়ি। সেই সময় থেকে গাণিতিক ধাঁধা সমাধান করাটা একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল। মনে হত গাণিতিক ও লজিক্যাল ধাঁধা সমাধান করেই হয়তো গোয়েন্দা হতে পারব। কিন্তু ১১ বছর বয়সে ক্রিসমাসের সময় বাবা একটা কেমিস্ট্রি সেট উপহার দিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিকে ঝুঁকলাম। যে কোনও আবিষ্কার, যত ছোটই হোক না কেন, তার মধ্যে আমি উত্তেজনার রসদ পেতাম। আবিষ্কারের ভালবাসাই যে কোনও গবেষণার মূল চালিকাশক্তি।
প্র: এমনকি, বিস্ফোরক নিয়েও পরীক্ষা করেছিলেন!
উ: হ্যাঁ। স্থানীয় একটা লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে দেখলাম বিস্ফোরক বানানো খুবই সহজ। সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বেশ মজা হত। ভাগ্য ভাল যে, সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় কোনও চোট-আঘাত লাগেনি।
প্র: এই ‘ভাগ্য ভাল’ বা ‘লাকি’ শব্দটা আপনি আপনার একাধিক লেখায়-বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। কেন?
উ: তার কারণ আমি নিজের জীবন দিয়ে দেখেছি যে, ‘লাক’ জিনিসটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন রসায়নবিদ থেকে কী ভাবে মলিকিউলার বায়োলজিস্ট হলাম। আমি বলব তার পিছনেও ‘লাক’-এর একটা ভূমিকা রয়েছে। যখন আমি পিএইচডি করছি, তখনও আমি জানি যে আমি কেমিস্ট হব। কিন্তু তখন জন কেন্ড্রিউয়ের লেখা ‘দ্য থ্রেড অব লাইফ’ বইটি আমার হাতে আসে। এটাকে জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বলতে পারেন। কারণ, ওই বইটি পড়ার পরে সিদ্ধান্ত নিই, যে করেই হোক আমাকে মলিকিউলার বায়োলজিস্ট হতেই হবে। আর একটি ঘটনার কথাও এখানে বলব। ৯/১১-র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসবাদী হামলায় যে প্লেনগুলি হাইজ্যাক করা হয়েছিল, তার মধ্যে একটি প্লেনে আমার টিকিট বুক করা ছিল। কিন্তু যাওয়ার আগের দিন ঘটনাচক্রে আমি সেই টিকিট অন্য একটি কারণে বাতিল করে দিয়েছিলাম। ফলে জীবনের কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘লাক’-ই মূল তফাত গড়ে দেয়।
প্র: এই মুহূর্তে সার্স কোভ-২ ভাইরাসের জন্য সারা বিশ্বে প্রতিষেধক তৈরির গবেষণা চলছে। সেই গবেষণা সফল হওয়ার পিছনেও কি ‘লাক’-এর ভূমিকা রয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
উ: কিছুটা তো বটেই। কারণ, ইতিমধ্যেই প্রতিষেধকের একাধিক গবেষণায় অনেক সম্ভাবনাময় দিক উঠে এসেছে। তার মধ্যে কোনটা কাজ করবে, কোনটা নয়, তা আমরা এখনও জানি না। তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটাও ঠিক শুধুই ভাগ্যের উপরে ভরসা করলে হবে না। আপনি যদি প্রথম বার ভাগ্যের সহায়তা পান, তা হলে সেই সুযোগটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। ‘হিউম্যান চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল’-এর (যে পরীক্ষায় সুস্থ মানুষের দেহে প্যাথোজেন প্রবেশ করিয়ে তার ফলাফল এবং প্রতিষেধকের কার্যকারিতা দেখা হয়) মাধ্যমে হয়তো তাড়াতাড়ি উত্তর পাওয়া সম্ভব।
প্র: কিন্তু ‘চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল’ নিয়ে তো বিতর্ক রয়েছে...
উ: হ্যাঁ রয়েছে। কিন্তু এখন যে জরুরি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে সারা বিশ্ব যাচ্ছে, সেখানে প্রথাগত পুরনো পদ্ধতিতে প্রতিষেধকের গবেষণা করার মতো সময় আমাদের হাতে রয়েছে কি না, সেই বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। উল্টো দিকে ‘চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল’-এর মাধ্যমে দ্রুত কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব।
প্র: সার্স কোভ-২ ভাইরাস সম্পর্কে প্রতি দিনই প্রায় নতুন তথ্য উঠে আসছে। আগের দিন যে মতটাকে অভ্রান্ত বলে মনে হচ্ছিল, পরে সেটাই মনে হচ্ছে ঠিক নয়।
উ: যে কোনও গবেষণার ক্ষেত্রে এমনটাই হয়। সার্স কোভ-২ ভাইরাসের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হচ্ছে। এই ভাইরাসটি সম্পর্কে এখনও অনেক কিছুই আমাদের অজানা। সংক্রমিত হওয়ার পর ব্যক্তিবিশেষে তার ফলও পৃথক হচ্ছে। কেন সংক্রমণের ফল পৃথক, তা স্পষ্ট করে এখনও বোঝা যায়নি। এমনও দেখা যাচ্ছে, চার জন সদস্যের পরিবারে তিন জন সংক্রমিত হয়েছেন, আর এক জন হননি। যাঁরা সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও সংক্রমণের মাত্রার তফাত রয়েছে।
এ বার কেন তিন জনের সংক্রমণের মাত্রা আলাদা বা কেন একসঙ্গে থাকা সত্ত্বেও আর এক জন সংক্রমিত হলেন না, তার পিছনে শুধুই শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা না কি অন্য কোনও ‘ফ্যাক্টর’ রয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে, সার্স কোভ-২ ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। খুব দ্রুত এক জনের থেকে অন্য জনের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে সার্স ও মার্সের সংক্রমণ হলেও সার্স কোভ-২’র মতো ভাইরাসের সঙ্গে আগে আমাদের কখনও পরিচয় ঘটেনি। এই ভাইরাস অচেনা, তাই এত বেশি বিপজ্জনক।
প্র: শুধুমাত্র ভাইরাসের সংক্রামক ক্ষমতার কারণেই কি এতটা অসহায় অবস্থা আমাদের? না কি কোথাও আমাদের তরফে পরিকল্পনার খামতিও রয়েছে?
উ: ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষমতা প্রধান কারণ তো বটেই। কিন্তু এই দিশেহারা অবস্থার পিছনে দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও অভাব (অ্যাবসেন্স অব এফেকটিভ পলিটিক্যাল লিডারশিপ) রয়েছে বলে আমি মনে করি। একটা ব্যাপার প্রথম থেকে বোঝা গিয়েছিল যে, যত দিন না এর কোনও প্রতিষেধক বাজারে আসছে, তত দিন সংক্রমিতের থেকে অন্যদের দূরে থাকতে হবে। তার জন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। যে সমস্ত দেশ ঠিক সময়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের ‘কন্ট্যাক্ট’ আটকাতে পেরেছে, প্রান্তিক মানুষদের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে পরিকল্পিত ভাবে লকডাউন করতে পেরেছে, সে সমস্ত দেশে সংক্রমণের হার তুলনামূলক ভাবে কম এবং সে দেশ অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু আমেরিকার মতো দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে কোভিড পরিস্থিতি জটিল হয়েছে, যার সমাধান দ্রুত হবে বলে মনে হচ্ছে না।
প্র: কোভিড-১৯ পেশাগত অনিশ্চয়তার পাশাপাশি সমাজের একটা বড় অংশের মধ্যে খাবার ও পুষ্টিজনিত নিরাপত্তার অভাবও তৈরি করেছে।
উ: হ্যাঁ। নিরাপত্তার এই অভাব ভবিষ্যতেও থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার এবং স্থানীয় স্তরে সেই পরিকল্পনা যাতে বাস্তবায়িত হয়, তা সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন। খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খল যেখানে ভেঙে পড়েছে, তার পুনঃস্থাপন করা প্রয়োজন।
প্র: ভারতের কোভিড-পরিস্থিতিও ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। এই নিয়ে কোনও পরামর্শ?
উ: ওই যে বললাম প্রতিষেধক বাজারে না আসা পর্যন্ত সংক্রমিতের থেকে দূরে থাকতে হবে। এটাই সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র পথ। সংক্রমিতকে চিহ্নিত করে তাঁকে বাকি জনগোষ্ঠীর থেকে আলাদা রাখা, এটা করলে সংক্রমণের গতি থামানো সম্ভব। তাই দূরত্ব-বিধি মানুন ও মাস্ক পরুন।
সাক্ষাৎকার: দেবাশিস ঘড়াই
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy