Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Science News

সুনামির গ্রাসে যেতে পারে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গও!

ফের সুনামি আছড়ে পড়ল ইন্দোনেশিয়ায়। ভারত মহাসাগরের উপকূলে। মৃতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ৮০০-র কাছাকাছি। তবে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা। ১৪ বছর আগে এই ইন্দোনেশিয়াতেই ভয়াবহ সুনামিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ। ২০১৪ সালেও ভয়াবহ সুনামি হয়েছে ভারত মহাসাগরে। কেন বার বার ফুঁসে উঠছে ভারত মহাসাগর? সুনামি  থেকে আগামী দিনে কতটা বিপদের আশঙ্কা রয়েছে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের? এই সব নিয়েই খড়্গপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি)-র জিওলজি অ্যান্ড জিওফিজিক্স বিভাগের ভূতপূর্ব প্রধান, ভূপদার্থবিজ্ঞানী শঙ্কর কুমার নাথের সঙ্গে কথা বললেন আনন্দবাজার ডিজিটালের তরফে সুজয় চক্রবর্তী।একটু বেশি মাত্রার ভূকম্প হলে বা সেই ভূকম্প উপকূলের আরও কাছাকাছি হলে, হতেই পারে সুনামি। আর তাতে প্লাবিত হয়ে যেতেই পারে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ।

ভয়াবহ সুনামি আছড়ে পড়ছে সমুদ্রোপকূলে। ছবি সৌজন্যে: অধ্যাপক শঙ্কর কুমার নাথ।

ভয়াবহ সুনামি আছড়ে পড়ছে সমুদ্রোপকূলে। ছবি সৌজন্যে: অধ্যাপক শঙ্কর কুমার নাথ।

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১২:৩০
Share: Save:

শঙ্কর কুমার নাথ: সমুদ্রের গর্ভের একেবারে তলদেশে ‘গ্র্যাভিটি ফল্ট’ হলেই সুনামির জন্ম হয়।

‘গ্র্যাভিটি’ বা অভিকর্ষ বল সম্পর্কে আমাদের ধারণা রয়েছে। যে বলে পৃথিবী সব কিছুকে তার নিজের কেন্দ্রের দিকে টানছে। কিন্তু ‘গ্র্যাভিটি ফল্ট’ বলতে কী বোঝায়?

শঙ্কর কুমার নাথ: জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের গ্রহের পিঠ বা সারফেসে যেমন নিয়মিত রদবদল ঘটে চলেছে, ঠিক তেমনই সেই রদবদল ঘটে চলেছে পৃথিবীর অন্দরেও। ভূগর্ভে। এই গ্রহের পিঠ আর তার ভেতরটায় রয়েছে বিভিন্ন শিলাস্তর বা টেকটনিক প্লেট। সেই প্লেটগুলি কিন্তু থেমে নেই। তারা গতিশীল। সব সময় তারা একে অন্যকে ধাক্কা মারছে। তাদের মধ্যে সংঘর্ষ (কলিশন) হচ্ছে। তাতে চাপ তৈরি হচ্ছে। বল বা ফোর্সের জন্ম হচ্ছে। আর সেখান থেকেই জন্ম হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে তাপ ও গতিশক্তির। ধাক্কাধাক্কি হলেই একটা প্লেট আর একটা প্লেটের তুলনায় নীচে নেমে যাচ্ছে। এটাই ‘গ্র্যাভিটি ফল্ট’-এর উৎস। তার জন্যই সমুদ্রগর্ভে সুতীব্র ভূকম্পের জন্ম হয়। আর তার ফলে সৃষ্টি হয় শূন্যতা বা ‘ভয়েড’।

প্লেটগুলির মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হলে তো প্রচুর পরিমাণে শক্তির জন্ম হওয়ার কথা। সেই বাড়তি শক্তিটা কোথায় যায়?

শঙ্কর কুমার নাথ: সেই শক্তিটাই তখন বেরিয়ে আসতে চায় সব কিছু ঠেলেঠুলে। তখনই হয় ভূকম্প। যাতে কেঁপে ওঠে সমুদ্রগর্ভের বিভিন্ন শিলাস্তর বা টেকটনিক প্লেটগুলি।

কিন্তু পৃথিবী তো শূন্যতা পছন্দ করে না...

শঙ্কর কুমার নাথ: সেই শূন্যতা ভরাতেই সমুদ্রগর্ভে চার পাশ থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসে জলরাশি। সেই জলরাশি এসে একে অন্যকে ধাক্কা মারে। ওই ধাক্কাধাক্কিতে চার পাশ থেকে ছুটে আসা জলরাশিগুলির গতিবেগ অনেকটাই বেড়ে যায়। ধাক্কাধাক্কিতে জন্ম হয় প্রচুর পরিমাণে শক্তিরও। সেই শক্তিরও বেরিয়ে আসার প্রয়োজন হয়। তখনই সমুদ্রগর্ভের তলদেশ থেকে সেই জলরাশি প্রচণ্ড গতিবেগে উঠে আসে ওপরের দিকে। আছড়ে পড়ে সমুদ্রোপকূলে, ভয়ঙ্কর তীব্র গতিবেগে। আর তা কয়েক লহমার মধ্যেই উপকূল ছাড়িয়ে ‘রাক্ষস’-এর মতো গ্রাস করে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। সেটাই সুনামি। এটাই হয় ভারত মহাসাগরে তৈরি হওয়া সব সুনামির ক্ষেত্রে।

তার মানে, আপনি বলতে চাইছেন, ভারত মহাসাগরে যে সুনামিগুলি হয়, তার কারণ, সমুদ্রগর্ভের তলদেশে সৃষ্টি হওয়া ‘গ্র্যাভিটি ফল্ট’?

শঙ্কর কুমার নাথ: ঠিক তাই। ‘গ্র্যাভিটি ফল্ট’-ই ভারত মহাসাগরে সুনামির কারণ।

সমুদ্রগর্ভে সব ভূকম্পেই কি সুনামি হয়?

শঙ্কর কুমার নাথ: না, তা হয় না। কিন্তু সুনামি হতে হলে সমুদ্রগর্ভে ভূকম্পটা হতেই হবে। তার মানে, সব ভূকম্প সুনামির জন্ম দেয় না ঠিকই, কিন্তু সব সুনামির জন্যই সমুদ্রগর্ভে তীব্র ভূকম্পের প্রয়োজন হয়।

আর কোনও উপায়ে কি সুনামি হয়? বলতে চাইছি, প্রশান্ত মহাসাগরে যে ভয়াবহ সুনামিগুলি হয়, সেগুলির কি অন্য কোনও কারণ রয়েছে? নাকি সেগুলিও হয় ‘গ্র্যাভিটি ফল্ট’-এর জন্য?

শঙ্কর কুমার নাথ: আরও একটি কারণে সুনামি হয়। যখন তুলনায় একটি ভারী প্লেট একটি হাল্কা প্লেটের নীচে ক্রমশই ঢুকে যেতে থাকে পৃথিবীর অভিকর্ষ বল (গ্র্যাভিটি) ও সার্ন্দ্র বল (ভিসকাস ফোর্স)-এর টানে। সে ক্ষেত্রে ওই এলাকায় একটা ‘সাবডাকশান জোন’-এর সৃষ্টি হয়। দু’টি প্লেটের মধ্যে ঘর্ষণ (ফ্রিকশান)-এর ফলে প্রচুর পরিমাণে চাপ, তাপ আর বলের সৃষ্টি হয়। যা বেরিয়ে আসতে চায়। তখনই তীব্র ভূকম্প হয় সমুদ্রগর্ভে।

আরও পড়ুন- কম্পন-সুনামি, ইন্দোনেশিয়ায় মৃত ৩৮৪​

আরও পড়ুন- বাতাসের বিষ থেকেই বিকল্প জ্বালানি! উপায় বাতলে ভাটনগর পেলেন দুই বাঙালি​

প্রশান্ত মহাসাগরে সুনামি হয় আকছার। কিন্তু অতলান্তিক ও ভারত মহাসাগরে সুনামি কেন তুলনায় বিরল ঘটনা?

শঙ্কর কুমার নাথ: তার কারণ, প্রশান্ত মহাসাগরে বড় বড় ‘সাবডাকশান জোন’ তৈরি হয়। আর সেটা একটা ‘কনটিন্যুয়াস প্রসেস’। সব সময়েই হচ্ছে। আর সেই সবগুলিই ‘অ্যাক্টিভ সাবডাকশান জোন’। তার ফলে, এখনও পর্যন্ত ভয়াবহ সুনামিগুলির ৮৫ শতাংশই হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে। আর প্রশান্ত মহাসাগরে সেই ‘অ্যাক্টিভ সাবডাকশান জোন’গুলির একটি নির্দিষ্ট এলাকা (‘মার্জিনাল এরিয়া’) রয়েছে। তার নাম- ‘রিং অফ ফায়ার’। যে এলাকাটি পর্বতমালা, সুগভীর সমুদ্র ও সুড়ঙ্গ দিয়ে ঘেরা। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে কয়েকটি ছোট, বড় টেকটনিক প্লেট রয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ‘প্যাসিফিক প্লেট’। এটা ৪ কোটি বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে রয়েছে্। তার চার পাশে রয়েছে ‘নাজকা প্লেট’, ‘নর্থ আমেরিকান প্লেট’ ও ‘অস্ট্রেলিয়ান প্লেট’। রয়েছে আরও একটি প্লেট। তার নাম- ‘অ্যান্টার্কটিক প্লেট’। ‘নাজকা প্লেট’ ও ‘নর্থ আমেরিকান প্লেট’-এর মধ্যে রয়েছে আরও একটি ছোট প্লেট। তার নাম- ‘কোকোস প্লেট’। ‘প্যাসিফিক প্লেট’ ছাড়া অন্য প্লেটগুলিকে বলা হয় কন্টিনেন্টাল প্লেট। এদের মধ্যে সব সময়েই সংঘর্ষ হয়ে চলেছে। আর তার ফলেই, তৈরি হয়েছে ‘রিং অফ ফায়ার’। যা ক্রমাগত ছোট, বড়, মাঝারি এবং তীব্র মাত্রার ভূকম্পের জন্ম দিচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরে। ভূকম্প তীব্র হলেই হচ্ছে সুনামি।

ভয়াবহ সুনামির উপগ্রহ চিত্র

কিন্তু অতলান্তিক মহাসাগরে কখনও ‘অ্যাক্টিভ সাবডাকশান জোন’ তৈরি হয় না। সেখানে সবই ‘প্যাসিভ সাবডাকশান জোন’। মানে, যা তুলনায় অনেকটাই দুর্বল। অতলান্তিক মহাসাগরের তলদেশে থাকা শিলাস্তরগুলিও খুব ছোট ছোট। ফলে, তাদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিতে তেমন শক্তিরও জন্ম হয় না। যা আকছারই হয় প্রশান্ত মহাসাগরে। আর ভারত মহাসাগরে তো কোনও ‘সাবডাকশান জোন’ই তৈরি হয় না। ফলে, ভারত মহাসাগরে ভয়াবহ সুনামি খুবই বিরল ঘটনা। সেখানে সুনামি হয় একটি প্লেট অন্য একটি প্লেটকে ঠেলছে বলে। সেটা একনাগাড়েই চলছে। বছরে ৬ থেকে ৭ সেন্টিমিটার গতিবেগে উত্তর-পূর্বে। তাতে কোনও প্লেটই একে অন্যের নীচে চলে যাচ্ছে না। কিন্তু কখনও কখনও গ্র্যাভিটি ফল্ট তৈরি হচ্ছে। তার থেকেই তীব্র ভূকম্পের জন্ম হচ্ছে সমুদ্রগর্ভে। যা ঘটনাচক্রে, সুনামির জন্ম দিচ্ছে ভারত মহাসাগরে।

যে ভাবে প্রশান্ত মহাসাগর ধরে এগিয়েছিল (লাল দাগ) জাপানের ২০১১ সালের সুনামি

কিন্তু এখন তো ভারত মহাসাগরে ভয়াবহ সুনামির ঘটনা ঘটছে। ২০০৪-এ সুমাত্রায় সুনামিতে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এটা কেন ঘটছে?

শঙ্কর কুমার নাথ: তার কারণ, ভারত মহাসাগরের তলদেশে থাকা ইন্ডিয়ান আর অস্ট্রেলিয়ান প্লেটগুলি (শিলাস্তর)-র মধ্যে ঠেলাঠেলি চলছে।বছরে ৬ থেকে ৭ সেন্টিমিটার গতিবেগে। এই ঠেলাঠেলিতে প্রচুর পরিমাণে শক্তির জন্ম হচ্ছে। যা ভূকম্পের জন্ম দিচ্ছে। আর সেখান থেকেই হচ্ছে সুনামি।

এর থেকে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, বাংলাদেশ বা এই এলাকার অন্য কোনও দেশের কি বিপদের আশঙ্কা রয়েছে ভবিষ্যতে?

শঙ্কর কুমার নাথ: নেই, তা বলা যাবে না। কারণ, ২০০৪-এ সুমাত্রার সুনামি ভাসিয়ে দিয়েছিল ভারতের মহানদী (ওড়িশা), কোঙ্কন উপকূল। এমনকি, চেন্নাই উপকূলও। তার পরেও ২০১৪ সালে ভয়াবহ ভূকম্প হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া-লাগোয়া ভারত মহাসাগরের সমুদ্রগর্ভে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৯.১। তার ফলে, হয়েছিল আরও একটি ভয়াবহ সুনামি। হয়েছিল প্রলয়ঙ্করী বন্যা। তা ভাসিয়ে দিয়েছিল ১৪টি দেশকে। তার মধ্যে ভারত ছাড়াও ছিল শ্রীলঙ্কা, তাইল্যান্ড, মায়ানমার, মলদ্বীপ, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ। ছিল পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া, তানজানিয়া, কেনিয়া, মাদাগাস্কার আর সিসিলি দ্বীপপুঞ্জও।

আমাদের গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের আশঙ্কা কতটা?

শঙ্কর কুমার নাথ: যথেষ্টই। ১৯৬৪ সালে সুন্দরবনের কাছে বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে সমুদ্রগর্ভে ৫.৪ মাত্রার একটি ভূকম্প হয়েছিল। তার চেয়ে একটু বেশি মাত্রার ভূকম্প হলে বা সেই ভূকম্প উপকূলের আরও কাছাকাছি হলে, হতেই পারে সুনামি। আর তাতে প্লাবিত হয়ে যেতেই পারে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ।

ছবি ও গ্রাফিক তথ্য সৌজন্যে: অধ্যাপক শঙ্কর কুমার নাথ

গ্রাফিক : শৌভিক দেবনাথ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE