Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Science News

সাড়ে ৫৬ মিনিট আগের সিদ্ধান্তেই বাজিমাত! বিশ্বে নজির গড়ল ইসরো

দেশপ্রেমের আবেগে ঘা লাগার পরোয়া সে দিন করেনি ইসরো। উৎক্ষেপণের জন্য রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ হাজির হয়েছেন, ইসরো তারও পরোয়া করেনি। বুঝিয়ে দিয়েছিল, অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে এইখানেই ফারাকটা বিজ্ঞানের।

চন্দ্রযান-২।

চন্দ্রযান-২।

সৌমিত্র সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৯ ১৪:০৭
Share: Save:

৫৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড আগে নেওয়া একটি সিদ্ধান্তই সে দিন আমাদের বুকের ছাতি বাড়িয়ে দিতে পেরেছিল! গর্বে। গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে পেরেছিল, আমরাই পারি।

হতে পারি, যে অর্থে বলা হয়, ‘গরিব দেশ’, কিন্তু যার উৎক্ষেপণ নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে গোটা দেশ, তাকিয়ে থেকেছে নাসা, ইসা (ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা ইএসএ), জাক্সা (জাপান স্পেস এজেন্সি)-র মতো বিশ্বের তাবড় মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলি, নিরাপত্তার সঙ্গে কোনও আপস না করে সেই ‘চন্দ্রযান-২’-এর উৎক্ষেপণ স্থগিত ঘোষণা করেছিল ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো।

৫৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড আগের সেই সিদ্ধান্ত!

১৫ জুলাই। রাত পৌনে ২টো। এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চন্দ্রযান-২-এর উৎক্ষেপণ ঘিরে যখন দেশপ্রেমের অথৈ আবেগে ভাসছে ভারতের এমনকী, প্রত্যন্ত প্রান্তের মানুষও, কী হয় কী হয় উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায় যখন দূরদর্শন আর ইসরোর টুইটার হ্যান্ডলের উপর রাত পেরিয়ে ভোর হওয়ার কিছু আগে পর্যন্ত নজর রেখেছেন দেশের আপামর মানুষ, তখন বলা নেই, কওয়া নেই উড়ানের ঠিক ৫৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড আগে ইসরো দুম করে ঘোষণা করে দিল, আজ হচ্ছে না। কবে হবে? ইসরো তার কোনও দিনক্ষণ সে দিন জানায়নি! শুধু এইটুকুই বলা হয়েছিল, নতুন দিনক্ষণ শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে।

কী ভাবে চাঁদে পৌঁছবে ‘চন্দ্রযান-২’? দেখুন ভিডিয়ো

অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের ফারাকটা কোথায়, বোঝাল ইসরো

ব্যস, এইটুকুই। দেশপ্রেমের আবেগে ঘা লাগার পরোয়া সে দিন করেনি ইসরো। উৎক্ষেপণের জন্য রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ হাজির হয়েছেন। তা সত্ত্বেও ইসরো বুঝিয়ে দিয়েছিল যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাধ্য়বাধকতা বা অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞান কোনও আপস করতে রাজি নয়। যে অন্ধ বিশ্বাসের জন্য আর্কিমিডিসকে হত্যা করা হয়েছিল, চরম হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল গ্যালিলেওকে, তা যে বিজ্ঞানের পক্ষে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়, সে দিন তা বুঝিয়ে দিতে এক সেকেন্ডও দ্বিধা করেনি ইসরো। বুঝিয়ে দিয়েছিল, যে কোনও ভুল-ত্রুটিকেই খুব সহজে গ্রহণ করতে পারে ও গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে একমাত্র বিজ্ঞানই। যা অন্ধ বিশ্বাস পারে না কোনও দিনই।

ভারতের চন্দ্রাভিযান সম্পর্কে জানেন এই তথ্যগুলি?

আরও পড়ুন- চাঁদে এখন না নামলে পরে খুবই পস্তাতে হত ভারতকে!​

আরও পড়ুন- চাঁদই হতে চলেছে আগামী দিনের সেরা ল্যাবরেটরি!​

সে দিন নাসা কিন্তু পারেনি!

১৯৮৬ সালে ঠিক এই কাজটাই করতে পারেনি নাসা। পারেনি বলেই উৎক্ষেপণের ১ মিনিট ২৯ সেকেন্ডের মধ্যেই ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল নাসার মহাকাশযান ‘চ্যালেঞ্জার’। মারা গিয়েছিলেন এক মহিলা-সহ সাত জন মহাকাশচারী। সে দিন কেন পারেনি নাসা? তার অনেকগুলি কারণের মধ্যে অন্যতম হল, তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন কিছু ক্ষণ আগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, ‘‘এক মহিলা স্কুল শিক্ষককে মহাকাশে পাঠানোর সাহস দেখাল আমেরিকা।’’ সেই উৎক্ষেপণের কয়েক মুহূর্ত আগে ‘চ্যালেঞ্জার’ মহাকাশযানের নিরাপত্তা নিয়ে ফ্লরি়ডার কেপ ক্যানাভেরালে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সংশয় দেখা দিলেও, শেষ মুহূর্তে সেই অভিযান স্থগিত ঘোষণা করতে পারেনি নাসা।

তদন্ত করেছিলেন নোবেল পুরস্কার জয়ী বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান

পরে সেই ঘটনার তদন্ত কমিশন গড়া হয়েছিল। যার প্রধান ছিলেন নোবেল পুরস্কার জয়ী কণাপদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। তিনি দেখেছিলেন এবং তদন্ত কমিশনের সদস্যদের সামনে রীতিমতো পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন, সে দিন শূন্যের নীচে তাপমাত্রা অনেকটাই নেমে গিয়েছিল ফ্লরিডার কেপ ক্যানাভেরালে। তার ফলে রকেটের দু’টি লিকুইড প্রপেল্যান্ট চেম্বারের মধ্যে থাকা ‘ও রিং’টি ওই ভীষণ ঠান্ডায় জমে গিয়েছিল। তাই তা ফুলে-ফেঁপে উঠে জায়গাটাকে ভরাট করতে পারেনি। ফলে, প্রপেল্যান্ট চেম্বারদু’টির মধ্যে থাকা তরল গ্যাস ‘লিক’ করেছিল। তার ফলেই ঘটেছিল ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

হয়তো সেই একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারত গত ১৫ জুলাই, চন্দ্রযান-২-এর উৎক্ষেপণের দিন। কিন্তু ইসরোর বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল না। ইসরোর সিদ্ধান্ত তাই গোটা বিশ্বের কাছে হয়ে থাকল দৃষ্টান্তমূলক।

ইসরো আগ্রহ বাড়াল ছাত্রছাত্রীদের, আলো ফেলল কুসংস্কারের আঁধারেও...

আরও দু’টি কারণে, ইসরোর এই চন্দ্রাভিযান পথ দেখাবে আগামী প্রজন্মকে। কয়েক দশক ধরে অধ্যাপনার অভিজ্ঞতার নিরিখে বলছি, এই ধরনের অভিযান যত হবে ততই ভারতে মহাকাশবিজ্ঞান (কসমোলজি) ও জ্যোতির্পদার্থর্বিজ্ঞান (অ্যাস্ট্রোফিজিক্স) নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণায় উৎসাহ বাড়বে ছাত্রছাত্রীদের। ছাত্রছাত্রীরা আরও বেশি করে বুঝতে পারবেন, মহাকাশবিজ্ঞান ও জ্যোতির্পদার্থর্বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য আর বিদেশে যেতে হবে না। এই দেশেই সেই জায়গাটা তৈরি হচ্ছে, দ্রুত।

আরও পড়ুন- ৩০ বছরের মধ্যেই চাঁদে বড় শিল্পাঞ্চল গড়ে ফেলবে মানুষ!​

আরও পড়ুন- চার বছরের মধ্যেই চাঁদের পাড়ায় ‘বাড়ি’ বানাচ্ছে নাসা!​

পাশাপাশি, এই ধরনের অভিযান ও গবেষণা গ্রহ, তারা নিয়ে আমাদের অন্ধ বিশ্বাসের শিকড়টাকে আরও আলগা করে দিতে সাহায্য করবে। আপামর মানুষ বুঝতে পারবেন, গ্রহ, তারাদের জানতে আর ব্যাখ্যা করতে যদি কেউ সঠিক ভাবে পারে, তা সেটা বিজ্ঞানই। কোনও অন্ধ বিশ্বাস নয়!

লেখক কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের অ্যাকাডেমিক ডিন (ফ্যাকাল্টি)

টেলিফোন সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইসরো

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE