আত্মজীবনী দ্য ফল অব আ স্প্যারো-তে লিখেছিলেন, ‘‘অস্থিতপঞ্চক সভ্যতার দ্রুতবেগের এই যান্ত্রিকযুগের কোলাহলময় ডামাডোল থেকে আমার মুক্তির রাস্তা হল পাখি দেখা।’’ বইটি ‘চড়াই উতরাই’ নামে বাংলায় অনূদিত হয়েছিল। পাখি যে গবেষণার বস্তু হতে পারে, ঘরের বাইরে গিয়ে তাদের ইতিহাস বার করা যায়, এই বিষয়টা ভারতীয়দের মধ্যে তাঁর আগে সে রকম ভাবে কেউ ভাবেননি। ভারতের পাশাপাশি আফগানিস্তান, তিব্বত, ভুটানের পাখির প্রজনন, তাদের বাসস্থান, জীবনযাত্রা সব কিছু নিয়ে খুঁটিয়ে কাজ করেছেন তিনি। প্রতিটি সমীক্ষার উপর লিখেছেন বই। তাঁর লেখা বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস আজও পক্ষী-প্রেমীদের কাছে বাইবেলসম। তিনি সেলিম আলি, ভারতের ‘বার্ডম্যান’! কাল তাঁর ১২৪তম জন্মদিন (জন্ম ১৮৯৬)।
সেলিম স্বপ্ন দেখতেন প্রাণিবিজ্ঞানী হওয়ার, পক্ষী-তত্ত্ব তাঁর বিষয় হবে। দুঃসাহসী অভিযাত্রী হবেন, দুর্ধর্ষ শিকারি হবেন। শৈশবের এই সব ডাকাবুকো চিন্তার জন্মের কারণ বোধ হয় তাঁর মামা, সে কালের দুঁদে শিকারি আমিরউদ্দিন তৈয়বজি। খুব ছোট বয়সে বাবা-মা মারা যাওয়ায় মামার বাড়িতেই বড় হয়েছেন সেলিম ও তাঁর ভাইবোনেরা। সেখানে মাঝেমধ্যেই বাঁশের ঝাঁকায় করে আসত তিতির ও বটের পাখি। ছোট্ট সেলিম তাঁর চেয়েও ছোট্ট ভাগ্নে সুলেমানকে নিয়ে সকলের অলক্ষ্যে পাখির ঝাঁকা থেকে কয়েকটা পাখি সরিয়ে ফেলে প্যাকিং বাক্সের খাঁচা বানিয়ে তার মধ্যে পাখিগুলো রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মশগুল হয়ে দেখতেন। পরবর্তী কালে ‘বার্ডম্যান’ হয়ে ওঠার বীজ বোনা হয় এ ভাবেই।
অঙ্ক ছিল ছাত্র সেলিমের আতঙ্ক, যে ভীতির কথা তিনি আত্মজীবনীতে লিখতে ভোলেননি, ‘‘ছেলেবেলায় ক্লাসে বসে ক্ষেত্রমিতির অখাদ্য সব অঙ্ক কষার চেয়ে আমি ঢের বেশি ভালবাসতাম মনোরম পরিবেশে মনের সুখে পাখির পিছনে ছুটতে।’’ ন’-দশ বছর বয়সে মামার কাছ থেকে এয়ারগান উপহার পাওয়ার পরে সেলিমের প্রিয় খেলা হল এয়ারগান দিয়ে চড়াই শিকার। এমনই এক দিন তাঁর চোখ আটকে গেল মৃত এক চড়াইয়ের গলায়। গলার পরিচিত মেটে দাগ নয়, তার বদলে হলদে ছাপ! রহস্য উদ্ধার করতে মৃত পাখিটিকে নিয়ে গেলেন মামার কাছে। মামাও বুঝতে না পারায় মরা পাখির সঙ্গে একটি চিঠি লিখে সেলিমকে পাঠিয়ে দিলেন ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র তৎকালীন অবৈতনিক সেক্রেটারি ডব্লিউ এস মিলার্ডের কাছে। সোসাইটির দেওয়াল জুড়ে মাউন্ট করা জীবজন্তু, শো-কেসে সাজানো প্রজাপতি, পাখির ডিম— এমন সব হাজারও জিনিস প্রথম বার দেখে ছোট্ট সেলিমের মনে যে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল, তা তাঁর জীবনটাই বদলে দেয়। সেই দিনের কথা প্রসঙ্গে সেলিম পরে লিখেছেন, ‘‘বিএনএইচএস-এর সঙ্গে সেই আমার প্রথম যোগাযোগ। পরে আমার জীবন গড়ে তুলতে এবং বিশেষ একটি খাতে বইয়ে দিতে এই যোগাযোগ বড় রকমের সাহায্য করেছিল।’’ সে দিনের ছোট্ট সেলিম জানতেন না, ভবিষ্যতে তিনিই হবেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ভারতীয় সেক্রেটারি এবং পরবর্তী কালে প্রেসিডেন্ট।
উচ্চশিক্ষা স্থগিত রেখে ১৯১৪ সালে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিতে সেলিম চলে যান বর্মায় (বর্তমানে, মায়ানমার)। বর্মায় এসে শাপে বর হল। কাজের অবসরে তাঁর সময় কাটত চা বাগান, ফলের বাগানে বিস্তর পাখি দেখে। যদিও তাঁর পক্ষী-সমীক্ষা সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। শুধু দু’চোখ ভরে দেখতেন আর নোটবুকে পাখির খুঁটিনাটি বর্ণনা লিখে রাখতেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর পরবর্তী জীবনে দারুণ কাজে লেগেছিল। ১৯১৭ সালে বর্মা থেকে বম্বে চলে আসেন অসমাপ্ত পড়াশোনা শেষ করতে। সেই সময় সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজের জীববিদ্যার অধিকর্তা রেভারেন্ড ফাদার ব্ল্যাটারের প্রেরণা ও তাড়নায় প্রাণিতত্ত্ব নিয়ে স্নাতক হন সেলিম। ১৯২৪-এ প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজ়িয়ামের (বর্তমান নাম ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ বাস্তু সংগ্রহালয়) প্রকৃতিবিজ্ঞান বিভাগে গাইড লেকচারারের চাকরি পেয়েছিলেন। এই কাজটা আবার তাঁর পড়াশোনা করার ইচ্ছেটাকে বাড়িয়ে দিল। সুযোগ এল জার্মানি থেকে। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ়ুলজিক্যাল মিউজ়িয়ামে কাজ করার সময় আলাপ হয় দিকপাল জীববিজ্ঞানীদের সঙ্গে। পাখিদের প্রজনন নিয়ে কাজ করতে গেলেন হেলিগোল্যান্ড দ্বীপে। শিখলেন পাখিদের পায়ে রিং পরানোর কারিকুরি, যা পরে তিনি এখানে এসে শুরু করেছিলেন। দেশে এসে কোনও চাকরি না পাওয়ায় তাঁর মাথায় আসে অঞ্চলভিত্তিক পাখি জরিপের চিন্তা। সাহায্যের আশ্বাস পান নিজ়ামের প্রশাসন থেকে। প্রথম কাজ শুরু করেন হায়দরাবাদে। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০— এই দু’দশকে হায়দরাবাদ দিয়ে শুরু করে গোটা ভারতের পাখির প্রজনন, তাদের বাসস্থান, জীবনযাত্রা সব কিছু নিয়ে প্রথম পুঙ্খানুপুঙ্খ সমীক্ষা করেন তিনি।
বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি-র মিউজ়িয়ামে প্রথম পা রাখা বদলে দিয়েছিল সেলিম আলির জীবন।
সমীক্ষার কাজ শেষ করতে গিয়ে সেলিমের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভারতকে নিবিড় ভাবে চিনেছিলেন, পরিচয় হয়েছে বহু নামী পক্ষী-বিশারদদের সঙ্গে। প্রতিটি অঞ্চলের সমীক্ষার পরে লিখেছেন বই। কাশ্মীর, হিমাচলপ্রদেশ, গঢ়বাল, কুমায়ুনে পক্ষী-সমীক্ষার কাজ করতে করতে তাঁর মনে হয়েছিল পশ্চিম তিব্বত থেকে আসা বড়িহাঁস, কালো সারসের প্রজননস্থলে না গেলে জীবন বৃথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমস্যা উপেক্ষা করে তোড়জোড় করেছিলেন কৈলাস ও মানস সরোবর অভিযানের। পাশে পেয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের পক্ষী-তাত্ত্বিক ও ফোটোগ্রাফার লোক ওয়ান থো-কে, যিনি সিকিমে পাখি সংগ্রহ ও ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজে খরচ জুগিয়েছিলেন সেলিমকে। ওয়ান থো-র একটি লেখায় পাওয়া যায়, সিকিমে এক বার একটি পাখির বাসার ছবি তোলার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার পরে পাখিটিকে ঠাঁইনাড়া করার জন্য ‘গড সেভ দ্য কিং’ গানটি গলা ছেড়ে গেয়েছিলেন সেলিম! এক একটা সার্ভে ছিল এক একটা অ্যাডভেঞ্চার। কখনও অসতর্ক হয়ে গভীর খাদে পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গিয়েছিলেন, আবার কখনও জঙ্গলে বুনো হাতির সামনেও পড়েছেন। তিব্বত যাওয়ার তোড়জোড় যখন করছেন, ঠিক সেই সময় কচ্ছের রাজা মহারাও বিজয়রাজের কাছ থেকে টেলিগ্রাম আসে কচ্ছের রান অঞ্চলে ফ্লেমিংগোদের সমাগম দেখার জন্য। সেখানে অ্যাভোসেট এবং রোজ়ি পেলিক্যান আবিষ্কার করেন। ভারতে এই দু’টি প্রজাতি সম্পর্কে তিনিই প্রথম লেখেন। বিখ্যাত পক্ষীবিদ রিচার্ড মেইলের্ৎসহাগেন-কে আফগানিস্তানের সমীক্ষায় সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন সেলিম। তাঁর মতে, তিনি ছিলেন তাঁর দেখা সেরা পক্ষীবিদ। তাঁর কাছ থেকেই সেলিম জেনেছিলেন, পাখিদের গায়ের পোকারাও সমীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সব পোকা সব প্রজাতির পাখির গায়ে বসে না। তাই যদি ভিন্ন প্রজাতির পাখির পালক থেকে একই ধরনের পোকা পাওয়া যায়, তা হলে বুঝতে হবে তাদের বংশধারায় কোথাও মিল আছে! ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভুটানে ছ’টি সংগ্রহ অভিযান করেছিলেন সেলিম। উত্তর-পূর্ব ভারত ও ভুটানের পাখিদের নিয়ে তাঁর বই ফিল্ড গাইড টু দ্য বার্ডস অব দি ইস্টার্ন হিমালয়াজ়।
সেলিম প্রথম সাইবেরিয়ান সারস দেখেছিলেন ১৯৩৭ সালে রাজস্থানের ভরতপুরের কেওলাদেও ঘানার অরণ্যে। জায়গাটি ছিল পরিযায়ী হাঁসদের স্বর্গরাজ্য। এখন অভয়ারণ্য হলেও তখন সেটি ছিল রাজা সুরজমলের শিকারভূমি। ১৯৩৮ সালে নভেম্বর মাসে পক্ষী-মেধ যজ্ঞের প্রধান হোতা ছিলেন তখনকার বড়লাট লিনলিথগো। মারা পড়েছিল ৪,২৭৩ হাঁস আর রাজহাঁস! এই শিকার বন্ধ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছিলেন সেলিম, পাশে পেয়েছিলেন জওহরলাল নেহরুকে। সমীক্ষার মতো পক্ষী-সংরক্ষণ নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। সেলিম অকারণে জীবহত্যাকে বর্বরতা মনে করতেন। যদিও পাখির নমুনা সংগ্রহের জন্য তাঁকেও পাখি শিকার করতে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘তা যদি না করতাম, ভারতীয় পাখিদের সম্পর্কে চর্মসংরক্ষণমূলক জ্ঞানের ক্ষেত্র কিছুতেই প্রশস্ত হতে পারত না।’’
তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে গোয়ার বার্ড স্যাংচুয়ারি, কেরলের থাট্টেকাড বার্ড স্যাংচুয়ারি, পুদুচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স বিভাগ ইত্যাদি। বাদ যায়নি পাখির নামও। ২০১৬ ভারতে আবিষ্কৃত হয় হিমালয়ান ফরেস্ট থ্রাস, যার বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে জ়ুথেরা সেলিমআলি।
সারা জীবনে পেয়েছেন বহু সম্মান ও পুরস্কার। সে সবের ফিরিস্তি দিয়ে তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘‘পাখি নিরীক্ষণ করার মতন আপাত নিরর্থক বৃত্তিতেও কেউ যদি কায়মনোবাক্যে লেগে থেকে নিজেকে উজাড় করে দেন, তা হলে তাঁর প্রাপ্তির ঘর কিছুতেই ফাঁকা যাবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy