গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ একটা যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। পরকীয়া অপরাধ নয়। পরকীয়া করার জন্য কারও জেল হতে পারে না। কিন্তু পরকীয়া ডিভোর্সের গ্রাউন্ড হতে পারে। অর্থাৎ, পরকীয়ার অভিযোগ এনে স্বামী বা স্ত্রী ডিভোর্স চেয়ে দেওয়ানি বিধিতে আইনত মামলা করতে পারেন। এই অবধি রায়টা চমৎকার ছিল। তারপরই কেমন একটা দিকভ্রান্ত হয়ে গেল রায়ের বয়ান। বিচারপতিরা বললেন, বিয়েতে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি নয়। স্বামীও স্ত্রীর সম্পত্তি নয়। চাইলে বিয়ের বাইরে নারী, পুরুষ অন্য কারও সঙ্গে প্রেম ও যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। কোর্ট আরও বললেন যে, স্ত্রীর সতীত্বের বিষয়টা নাকি এদেশের ব্রিটিশ মূল্যবোধ, ভিক্টোরিয়ান নীতিবাগিশতা। অর্থাৎ বাইরের আমদানি। ভারতীয় মূল্যবোধ এর থেকে আলাদা? রায়ের এই জায়গাটা একটা বোম ফাটার মতো মনে হয়েছে। ভারতীয় মূল্যবোধ পরকীয়াকে অনৈতিক মনে করেনি প্রি-কলোনিয়াল পিরিয়ডে? ব্যভিচার মনে করেনি? ইতিহাস তো তাই বলে না। সাহিত্য তাই বলে না। ভারতীয় জীবনের ডকুমেন্টশন তো তাই বলে না?
বিয়ে একটা ইনস্টিটিউশন। এবং পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতায় বিয়ের একটা অলিখিত, কিন্তু মূল শর্ত হল স্বামী বা স্ত্রীর একে অন্যের প্রতি যৌন কমিটমেন্ট থাকবে, থাকতে হবে। আমরা কত রকম সম্পর্কের মধ্যে থাকি। বিয়ে বা প্রেমের সম্পর্কে এটাই স্পেশাল যে সেখানে যৌনতার মতো অতি উত্তেজনার, অতি উন্মাদনার, অতিরিক্ত অধিকারবোধের একটা নাটকীয় রসায়ন সারাক্ষণ এটাকে পাকে পাকে ঘিরে রেখেছে। সমস্ত সম্পর্কের ভেতর থেকে যে ক্লাইম্যাক্স সম্পর্কে আমরা পৌঁছতে চাই তা-ই বিয়ে, তা-ই প্রেমজাত সম্পর্ক। সেই বিয়ে থেকে যদি যৌনতার স্ফুলিঙ্গটাকেই সরিয়ে নেওয়া হয়, যদি আমাদের স্বামী বা স্ত্রী আমাদের চোখের সামনে দিয়ে অন্য কাউকে গমন করে আমাদের কাছে হাসতে হাসতে ফিরে এসে বলে,‘‘ওগো, কই গেলে গো, আজ রানির সঙ্গে পরকীয়া করে এলাম,’’বা বলেন যে, ‘‘আজ রাজা তো ছাড়তেই চাইছিল না, আমি শুধু তোমার মায়ের কাল চোখ অপারেশন ভেবে ফিরে এলাম।’’তাহলে সেটা কি আমরা মেনে নিতে পারব? একই সঙ্গে বিয়ে আর একই সঙ্গে যৌন স্বাধীনতা— এই দুয়ের প্র্যাকটিস কি সম্ভব?
বিয়ের একটা গভীর মানসিক তৃপ্তির জায়গা আছে। যদিও ডিভোর্স এখন কোনও ব্যাপার নয়, তবু মানুষ বিয়ে করে কারণ বিয়েতে এক ধরনের নিরাপত্তার অনুভব আছে, যেটা প্রথমে যৌন কমিটমেন্ট দিয়ে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, ভবিষ্যৎ, পরবর্তী প্রজন্মের বেড়ে ওঠা, সম্পত্তির অধিকার এবং শেষ জীবনের আশ্রয়— এই রকম সব কিছুর সুদূরপ্রসারী ফলাফল পর্যন্ত রুটেড। সম্পত্তির অধিকারের বিষয়টা তো বিরাট একটা বিষয়। সেক্ষেত্রে এই রায় আপাতভাবে নারীর অধিকারের সঙ্গে সহযোগিতা করছে মনে হলেও আসলে কোথাও গিয়ে মেয়েদের মধ্যে এই আইনই নতুন এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধের কারণ হয়ে উঠবে। পুরুষের ক্ষেত্রেও তাই ঘটবে। নিরাপত্তার বোধ না থাকলে একটা সুস্থ সম্পর্ক কখনও থাকবে না স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। উভয়ের স্বার্থ এক হবে না। ফিউচার প্ল্যানিং বলে কিছু থাকবে না। একজন যদি শারীরিক ভাবে, মানসিক ভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে, তাহলে অপরজন তাকে টানবে কেন? এই সব নিরাপত্তাহীনতা সারাক্ষণ তাড়া করবে বিবাহকে। একটা কুৎসিত টানাপড়েন চলতে থাকবে। দুটো মনোরোগী অসুস্থ সম্পর্কে বসবাস করবে। বিয়ে থাকবে কিন্তু কমিটমেন্ট থাকবে না, এটা হতে পারে না। তার থেকে বিয়ে জিনিসটা তুলে দিয়ে দেখা যেতে পারে। তাতে যদি ব্যক্তি সত্যি সত্যি তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা প্র্যাকটিস করার সুযোগ পায়!
আরও পড়ুন: পরকীয়া অপরাধ নয়, স্বামী প্রভু হতে পারেন না স্ত্রীর, রায় সুপ্রিম কোর্টের
আরও পড়ুন: নমাজের জন্য মসজিদ অত্যাবশ্যক নয়, সুপ্রিম কোর্টে বহাল আগের রায়
তবু মনে হয় পরকীয়া কোনও দিন মেনস্ট্রিম হতে পারে না। পরকীয়া চিরদিন ছিল, আছে আর থাকবে আন্ডার দ্য কার্পেট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy