রায়ের পর নীরপ্রীত। ছবি পিটিআই
বয়স তখন মাত্র ১৬। চোখের সামনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে বাবাকে— দেখেছিল কিশোরী। ১৯৮৪ সালের ১ নভেম্বরের সকালটা তাই নীরপ্রীত কৌরের মনে দগদগে ক্ষত। দিল্লি রাজনগরের একটি গুরুদ্বারের কাছে উন্মত্ত জনতা চড়াও হয়েছিল নীরপ্রীতের বাবা নির্মল সিংহের উপরে। তিনি ছিলেন ওই গুরুদ্বারের ‘গ্রন্থী’ (প্রধান পুরোহিত)।
আজ কংগ্রেস নেতা সজ্জন কুমারের শাস্তির পরে দিল্লি হাইকোর্টের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন নীরপ্রীত। ‘‘৩৪ বছর পরে বিচার,’’ গলা বুজে আসে নীরপ্রীতের— ‘‘উনি এ বার জেলে যাবেন। তবে অনেক দেরি হয়ে গেল।’’
২০৭ পাতার রায়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় ধরা আছে ওই সকালটার কথা। মূলত তিন সাক্ষী— জগদীশ কৌর, তাঁর সম্পর্কিত ভাই জগশের সিংহ, এবং নীরপ্রীত কৌরের কথা শুনেছে হাইকোর্ট। নীরপ্রীতের বয়ানে রয়েছে, নির্মল সিংহকে প্রথমে কেরোসিনে চোবানো হয়। ক্ষিপ্ত জনতা দেশলাই বাক্স খুঁজছিল। এক পুলিশ অফিসার দেশলাই এগিয়ে দেন। আগুন লাগিয়ে দিলেও নির্মল সিংহ কোনওমতে একটা নর্দমায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। গ্রন্থী বেঁচে আছেন দেখে বিদ্যুতের স্তম্ভে বেঁধে তাঁর গায়ে ফের আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। নির্মল আবারও নর্দমায় ঝাঁপিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। নীরপ্রীত জানিয়েছেন, ওই সময়ে লোহার র়ড হাতে উন্মত্ত জনতা ফিরে আসে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাদের মধ্যে এক জন ফসফরাস ছিটিয়ে দেয় নির্মলের গায়ে।
আরও পড়ুন: শিখ-হত্যায় শাস্তি কংগ্রেস নেতার
পরের দিন নীরপ্রীত পুলিশকে জানান, স্থানীয় কাউন্সিলর সজ্জন কুমার বলেছেন, শিখদের যে সব হিন্দু বাঁচাতে যাবে, তাদেরও মেরে ফেলা হবে। নীরপ্রীতের কথায়, ‘‘সজ্জন বলেছিলেন, ইন্দিরা গাঁধীকে মেরেছে এমন এক জন শিখকেও ছাড়া হবে না।’’ সজ্জনের বিরুদ্ধে কথা বলায় শিখ জঙ্গিদের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয় নীরপ্রীতের বিরুদ্ধে। পরে তুলে নেওয়া হয়। নীরপ্রীত বলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা সাজানো হয়। জেল হয়। মাকেও ছাড়েনি। তিন বছর জেলে ছিলেন মা।’’
নীরপ্রীতের মতো ভয়ঙ্কর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে জগদীশ কৌরও। একই দিনে স্বামী আর ছেলেকে চোখের সামনে মরতে দেখেছেন তিনি। মারা হয় তাঁর সম্পর্কিত ভাইদেরও। আজ জগদীশ বলেছেন, ‘‘কিছুটা স্বস্তি। এত বছর আমরা যে অবিচার সহ্য করেছি, তা যেন কাউকে করতে না হয়।’’
নীরপ্রীত-জগদীশদের লড়াইয়ে আগাগোড়া পাশে ছিলেন এইচ এস ফুলকা। ৭৩ বছরের এই আইনজীবী গত বছর পঞ্জাব থেকে আম আদমি পার্টির টিকিটে জিতে বিধায়ক হন। বিধানসভায় বসার সুযোগ পেলেও যাননি। বার কাউন্সিল জানায়, রাজনৈতিক পদে থেকে তিনি শিখ-বিরোধী দাঙ্গায় আক্রান্তদের হয়ে লড়তে পারবেন না। পর দিনই ইস্তফা দেন ফুলকা। আজ বলছেন, ‘‘ঐতিহাসিক। মামলাটা খুব কাছের। ৩৪ বছর ধরে প্রতি স্তরে কী ভাবে বিচার বাধা পেয়েছে, তার নজির এই মামলা।’’ ফুলকার মতে, এ বছর জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্টের তৈরি বিশেষ তদন্তকারী দল মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তাঁর মতো লড়ে গিয়েছেন সিবিআইয়ের বিশেষ আইনজীবী আর এস চিমা-ও। ২০০৫ সালে সিবিআই তদন্ত শুরুর সময় থেকে তিনি ছিলেন। জগদীশের সাহসের প্রশংসা করে তিনি বলছেন, ‘‘সঠিক সময়ে বিচারের জয়। আইনের হাত অনেক লম্বা, অপরাধীদের ধরবেই। মানুষ আরও এক বার বুঝলেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy