ভারতে আসার পথে আকাশে জ্বালানী ভরছে রাফাল। ছবি: ভারতীয় বায়ুসেনার টুইটার থেকে।
রাফাল আসার পরে আকাশযুদ্ধের প্রযুক্তিতে চিনকে পিছনে ফেলে দিতে চলেছে ভারতীয় বায়ুসেনা। আর উৎকর্ষের এই লড়াইয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনী কার্যত তুলনাতেই আসবে না। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে, চিনের চেংদু এয়ারক্র্যাফটস ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপ নির্মিত চতুর্থ প্রজন্মের ‘মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট’ জেএফ-১৭ থান্ডার এমনকি, পঞ্চম প্রজন্মের (বেজিংয়ের দাবি অনুযায়ী) ‘স্টেলথ এয়ার সুপিরিওরিটি ফাইটার’ জে-২০-র চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে রাফাল।
চিনের পাশাপাশি পাকিস্তান, মায়ানমার এবং নাইজিরিয়ার বিমানবাহিনী জেএফ-১৭ থান্ডার ব্যবহার করে। তবে চিন এখনও তার আধুনিকতম যুদ্ধবিমান জে-২০ অন্য কোনও দেশকে বিক্রি করেনি। তবে পাকিস্তানকে জেএফ-১৭-র আধুনিকতম সংস্করণ ‘ব্লক-৩’ দিয়েছে চিন।
লাদাখ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভারতকে একসঙ্গে দু’টি ফ্রন্টে (চিন ও পাক) লড়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে বলে প্রতিরক্ষা বিশারদেরা মনে করেন। ৩৬টি রাফাল হাতে আসার পরে অন্তত অন্তরীক্ষে একসঙ্গে চিন ও পাকিস্তানের মোকাবিলা করতে পারবে ভারত। আর সেখানেই উঠে আসছে, জেএফ-১৭ এবং জে-২০-র বিরুদ্ধে আকাশযুদ্ধে রাফালের সাফল্যের সম্ভাবনার প্রসঙ্গ। আকাশযুদ্ধের পাশাপাশি, জমিতে থাকা সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস, নজরদারি, প্রত্যাঘাত, বিমান প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংসের ক্ষমতা, যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে হামলা, পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার সংক্রান্ত নানা বিষয় চলে আসছে তুল্যমূল্য আলোচনায়।
আরও পড়ুন: করোনা সঙ্কট সামনে রেখে নেপাল, আফগানিস্তানকে নিয়ে নয়া অক্ষ চিনের
চিন তার জে-২০-কে ‘সম্পূর্ণ স্টেলথ’ (রাডার নজরদারি ফাঁকি দিতে সক্ষম) বলে দাবি করলেও মার্কিন ও ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশেরই এ বিষয়ে সংশয় রয়েছে। তাঁদের মতে, চিনা বিমানটি বড় জোর ‘আংশিক স্টেলথ’। বস্তুত, ভারতীয় বায়ুসেনার সুখোই-৩০এমকেআই ফাইটার জেটের রাডার সীমান্তে জে-২০-র গতিবিধি চিহ্নিত করেছে বেশ কয়েক বারই। প্রযুক্তিগত অন্য দিকগুলিতেও ৪.৫ প্রজন্মের রাফালের তুলনায় জে-২০ পিছিয়ে রয়েছে বলেই তাঁদের মত। তা ছাড়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া এবং সিরিয়ার যুদ্ধে ইতিমধ্যেই রাফাল তার দক্ষতা প্রমাণ করেছে। জে-২০ এবং জেএফ-১৭ কিন্তু এখনও ‘পরীক্ষিত’ নয়। কারণ, যুদ্ধের অনুশীলন আর প্রকৃত যুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্যে ফারাক থেকেই যায়।
চিনা বিমানবাহিনীর জে-২০— ফাইল চিত্র।
রাফাল এবং জেএফ-১৭ এক কিংবা দু’আসন বিশিষ্ট হতে পারে। চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্স থেকে ভারত ২৮টি এক আসনের এবং ৮টি দু’আসনের (মূলত প্রশিক্ষণের ব্যবহারের জন্য) রাফাল পাবে। তবে জে-২০ শুধুমাত্র এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট হয়।
জোড়া ইঞ্জিনবিশিষ্ট রাফাল-এ ব্যবহৃত স্নেকমা এম-৮৮ টার্বোফ্যান জে-২০-র চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আর এক ইঞ্জিনের হালকা জেএফ-১৭ এ ক্ষেত্রে রাফালের তুলনাতেই আসে না। ভারতীয় বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আর নাম্বিয়ারের কথায়, ‘‘জেএফ-১৭-র ইঞ্জিন রুশ সুখোই-৩০ (যা প্রায় দু’দশক ধরে ভারতীয় বায়ুসেনায় রয়েছে)-এর চেয়ে বেশি উন্নত নয়।’’
তিনটি বিমানের মধ্যে জে-২০ সবচেয়ে ভারী। খালি অবস্থায় ওজন ১৯ হাজার কিলোগ্রাম। জ্বালানি ও অস্ত্রশস্ত্র-সহ ‘টেক অফ ওয়েট’ ৩৭ হাজার কিলোগ্রামের সামান্য বেশি। রাফালের বিভিন্ন মডেলের ওজন কমবেশি ১০ হাজার কিলোগ্রাম। টেক অফ ওয়েট প্রায় ২৪,৫০০ কিলোগ্রাম। জেএফ-১৭ তুলনায় অনেক হালকা। জ্বালানি ও অস্ত্রশস্ত্র-সহ ওজন প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কিলোগ্রাম। খালি অবস্থায় তার অর্ধেক।
১৫.৩ মিটারের রাফালের তুলনায় জে-২০-র দৈর্ঘ অনেকটাই বেশি— প্রায় ২০.৫ মিটার। রাফালের ডানার দৈর্ঘ ১০.৯ মিটার। জে-২০-র কমবেশি ১৩। কিন্তু ফরাসি নির্মাতা দাসো অ্যাভিয়েশন তাদের বিমানে যে অভিনব ক্লোজ-কাপল্ড ক্যানার্ডের ডেল্টা উইংড কনফিগারেশন তৈরি করেছেন, তা আকাশযুদ্ধের ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকরী। হাই-অ্যাঙ্গেলড অ্যাটাকে রাফালের দক্ষতা অনেক বেশি।
গতির লড়াইয়ে অবশ্য কিছুটা এগিয়ে জে-২০। ঘণ্টায় ২.০ ম্যাক (২,৪০০ কিলোমিটার) পর্যন্ত গতিতে ছুটতে পারে চিনের আধুনিকতম যুদ্ধবিমান। রাফালের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২২২২.৬ কিলোমিটার। আর এ ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে থাকা জেএফ-১৭-র সর্বোচ্চ গতি ১৯৭৫.৬৮ কিলোমিটার। গ্লোবালসিকিওরিটি.ওআরজি-র তথ্য বলছে, ‘ডগফাইটের’ (আকাশে মুখোমুখি যুদ্ধ) রাফাল ৫০ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠতে পারে। জেএফ-১৭ প্রায় ৫৪ হাজার ফুট এবং জে-২০ পারে ৬৫ হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায় উঠতে। তবে রাফাল উঠতে পারে মিনিটে ৬০ হাজার ফুট গতিবেগে। জে-২০ মিনিটে ৪৯,৮৪২ ফুট এবং জেএফ-১৭ মিনিটে ৫৯ হাজার ফুট গতিবেগে। আপাতদৃষ্টিতে পার্থক্য সামান্য হলেও আকাশযুদ্ধের সময় তা ‘নির্ণায়ক’ হয়ে উঠতে পারে নিমেষে।
ফরাসি যুদ্ধবিমানটির উড়ান ক্ষমতা প্রায় ৩,৭০০ কিলোমিটার। জে-২০ এবং জেএফ-১৭-এর যথাক্রমে ২,০৩৭ এবং ২,০০০ কিলোমিটার। ফলে চিনা এবং পাক প্রতিদ্বন্দ্বী বিমানের তুলনায় অনেকক্ষণ বেশি সময় ধরে আকাশে দাপিয়ে বেড়াতে পারবে রাফাল। আকাশে উড়তে উড়তেই জ্বালানি ভরে নিতেও (রিফুয়েলিং) দক্ষ রাফাল।
প্রতিপক্ষের তুলনায় রাফাল এগিয়ে রয়েছে অস্ত্রসম্ভারেও। দৃষ্টিশক্তির বাইরে (বেয়ন্ড ভিস্যুয়াল রেঞ্জ) আঘাত হানতে সক্ষম ‘মাইকা’ এয়ার টু এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র আকাশ প্রতিরক্ষা এবং হামলার ক্ষেত্রে অনন্য। শব্দের চেয়ে চার গুণ দ্রুতগামী, ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি পাল্লার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ম্যাটিওর আকাশযুদ্ধে ‘গেম চেঞ্জার’-এর ভূমিকা নিতে পারে। কয়েকটি জে-২০-তে চিন প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার নতুন এয়ার টু এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পিএল-১৫ বসিয়েছে বলে সে দেশের সরকারি মিডিয়ার দাবি। পাকিস্তানও ইতিমধ্যেই জেএফ-১৭-তে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এই ক্ষেপণাস্ত্র চেয়ে চিনের কাছে দরবার করেছে।
পাক বিমানবাহিনীতে আছে চিনা ফাইটার জেট জেএফ-১৭— ফাইল চিত্র।
রাফাল-এ ব্যবহৃত দূরপাল্লার আকাশ থেকে ভূমি স্ক্যাল্প ক্ষেপণাস্ত্র এবং এএম-৩৯ এক্সোসেট জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনীয় অস্ত্র চিনের তৈরি দু’টি কমব্যাট জেটের ভাঁড়ারে নেই। জে-২০ এবং জেএফ-১৭-র মতোই ‘অটোক্যানন’-এ সজ্জিত রাফাল। রয়েছে শত্রুর বাঙ্কার ওড়ানোর জন্য ৯০০ কিলোগ্রামের গাইডেড বোমাও। রাফালে অত্যাধুনিক আকাশ থেকে ভূমি ক্ষেপণাস্ত্র ‘হ্যামার’ বসানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বায়ুসেনা। লাদাখের মতো প্রতিকূল আবহাওয়াতেও এই ক্ষেপণাস্ত্র বিন্দুমাত্র কার্যকারিতা হারায় না। ৬০ থেকে ১৫ কিলোমিটার পাল্লার মধ্যে একসঙ্গে একাধিক লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে ৩৩০ কিলোগ্রাম ওজনের এই ‘হাতুড়ি’!
আরও পড়ুন: লক্ষ্য চিন, ৩৭০ পণ্য আমদানিতে গুণমানের নয়া মাপকাঠি কেন্দ্রের
রাফাল এবং জে-২০-র আধুনিক ইনফ্রারেড অনুসন্ধান ও ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং ক্রস-সেকশন রাডার শত্রুবিমান চিহ্নিত করতে বিশেষ দক্ষ। জেএফ-১৭-র প্রযুক্তি কিছুটা পুরনো। পাক বিমানবাহিনীর সবগুলি জেএফ-১৭-য় হেলমেট মাউন্টেড ডিসপ্লেও নেই।
ভারতীয় বায়ুসেনার এক আধিকারিকের কথায়, ‘রাফালের মোকাবিলার জন্য ইতিমধ্যেই সুখোই-৩৫ বিমান চেয়ে রাশিয়ার দ্বারস্থ হয়েছে চিন। সত্যিই যদি জে-২০ পঞ্চম প্রজন্মের কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট হতো, এমনটা করার প্রয়োজনই পড়ত না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy