পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ বেঙ্গালুরুতে। ছবি: পিটিআই
দেশ থেকে পেঁয়াজ রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। আর তার জেরে পেয়াজের ঝাঁঝে জেরবার প্রায় গোটা এশিয়া। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ও নেপালের। তিন প্রতিবেশী দেশে গত দু’সপ্তাহে কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও বা তিন গুণ বেড়ে গিয়েছে পেঁয়াজের দাম। হন্যে হয়ে চিন-মিশরের মতো দেশ থেকে আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। যদিও তাতেও সুরাহা এখনও মেলেনি। কাঠমাণ্ডু থেকে কলম্বো— আগুন দামে বিকোচ্ছে পেঁয়াজ। নাভিশ্বাস আম জনতার।
ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজের চাষ হয় মহারাষ্ট্রে। উৎপাদনের দিক থেকে তার পরে ক্রমান্বয়ে রয়েছে কর্নাটক, গুজরাত, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ, হরিয়ানার মতো রাজ্য। আবার এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদক দেশও ভারত। তাই ভারত বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, মায়ানমারের মতো দেশ পেঁয়াজের জন্য ভারতের উপর ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল। এখান থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ হয়ে গেলে কার্যত হাহাকার পড়ে যায় এই সব দেশে। গত ছ’-সাত বছরে এই দেশগুলির খুব একটা সমস্যা হয়নি। কারণ ভারত থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পেঁয়াজ রফতানি হয়েছে।
কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি আলাদা। দেশে পেঁয়াজ উৎপাদক রাজ্যগুলিতে অতিবৃষ্টি তো হয়েছেই, বর্ষার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক পরেও ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এখনও বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্য বন্যার কবলে। ফলে পেঁয়াজের ফলন মার খেয়েছে। আবার দেরিতে বৃষ্টিপাত হওয়ায় পেঁয়াজ উঠতেও দেরি হয়েছে। ফলে ভারতেই পেঁয়াজের দাম কার্যত আকাশছোঁয়া। মহারাষ্ট্র-কর্নাটকে পাইকারি বাজারেই বিক্রি হচ্ছে ৪০০০ থেকে ৪৫০০ টাকা কুইন্টাল। অর্থাৎ কেজি প্রতি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। ২০১৩ সালের পরে পেঁয়াজের এত বেশি দাম আর হয়নি। আর খুচরো বাজারে রাজ্য ভিত্তিক কোথাও ৬০ টাকা, কোথাও ৮০ টাকা কিলো দরে বিক্রি হচ্ছে।
দিল্লিতে ভর্তুকিতে সরকারি দরে পেঁয়াজ কেনার লাইন। ছবি: পিটিআই
আরও পড়ুন: এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স: মাথা নত করবে না দিল্লি, ওয়াশিংটনে স্পষ্ট বার্তা জয়শঙ্করের
দু’-চার দিনের মধ্যে পেঁয়াজ চাষির ঘরে উঠবে এমন সম্ভাবনাও কার্যত ক্ষীণ। বা সামান্য পরিমাণ উঠলেও চাহিদার তুলনায় সেটা নগণ্য। এই সব সমীকরণের কথা মাথায় রেখেই ২৯ সেপ্টেম্বর রবিবার থেকে পেঁয়াজ রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত। ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ার জেরে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপালের মতো দেশে দাম বাড়ছিলই। ভারত থেকে রফতানি বন্ধের জেরে দাম আরও চড়তে পারে বলেই আশঙ্কা সব মহলের। ঢাকায় এখন পেঁয়াজের কিলো বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা (ভারতীয় মুদ্রায় ১০০ থেকে ১১০ টাকা)। কলম্বোতেও শ্রীলঙ্কার মুদ্রায় দাম ২৮০ থেকে ৩০০ (ভারতীয় মুদ্রায় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা)। দু’দেশেরই ক্রেতারা বলছেন, গত দু’সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে।
আর এই সঙ্কটের জেরেই বিকল্প দেশ থেকে আমদানির তোড়জোড় শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। ভারত ছাড়া পেঁয়াজ রফতানিকারী প্রধান দুই দেশ চিন এবং মিশর। কিন্তু এই সব দেশের পক্ষে সেখান থেকে দেশে পৌঁছতে অনেক বেশি সময় লাগে। কিন্তু উপায় না দেখে শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যেই চিন এবং মিশর থেকে আমদানির বরাত দিয়ে দিয়েছে— জানিয়েছেন এসেনশিয়াল ফুড কমোডিটিজ ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জি রাজেন্দ্রন।
বাংলাদেশ সরকার আবার সঙ্কট সামলাতে ভর্তুকি দিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর মাধ্যমে দেশের প্রায় সব শহরে সরকারি দামে পেঁয়াজ বিক্রি চলছে। কিন্তু সেটাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম। খোলা বাজারেই কিনতে হচ্ছে বেশি। টিসিবি-র মুখপাত্র হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘‘আমরা পেঁয়াজ আমদানির জন্য সব রকম চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সবচেয়ে কম সময়ে পেঁয়াজ আমদানি করা। ইরান, তুরস্ক বা চিন বা মিশরের মতো দেশ রয়েছে— সেখান থেকে আমদানির সম্ভাব্য সুবিধা-অসুবিধা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু মিশর থেকে আসতে প্রায় এক মাস, মিশর থেকে ২৫ দিন সময় লাগে। সেখানে ভারত থেকে আনতে পারলে ৩/৪ দিনেই পৌঁছে যায়।’’
ঢাকার কারওয়ান পাইকারি বাজারে বিক্রির জন্য পেঁয়াজ সাজাচ্ছেন এক ব্যবসায়ী। ছবি: এএফপি
ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানির উপর এশিয়ার দেশগুলি যে কতটা নির্ভরশীল, একটা উদাহরণ দিলেই সেটা বোঝা যাবে। এগ্রিকালচারাল প্রসেসড ফুড প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট ডেভলপমেন্ট অথরিটির হিসেবে ২০১৮-’১৯ আর্থিক বছরে ভারত থেকে রফতানি হয়েছে ২২ লক্ষ টন। ব্যবসায়ীদের মতে, এই পরিমাণ এশিয়ার সব দেশের মিলিত পেঁয়াজ আমদানির অর্ধেকেরও বেশি।
আরও পড়ুন: কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থ জোগানের পিছনে দিল্লির পাক দূতাবাস? এনআইএ-র তদন্তে বিস্ফোরক তথ্য
কিন্তু পরিস্থিতি বদল হবে কবে? পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের মতে, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ চাষির ঘরে ওঠার পর বাজারে না আসা পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভাবে দাম কমার সম্ভাবনা কার্যত নেই। মুম্বইয়ের অনিয়ন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অজিত শাহ বলেন, ‘‘ফসল উঠতে উঠতে অন্তত নভেম্বরের মাঝামাঝি হয়ে যাবে। তার আগে পর্যন্ত সরকার রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলবে বলে মনে হয় না। একমাত্র ভারতে দাম কমলে তবেই ফের রফতানি চালুর কথা ভাববে ভারত। কিন্তু সেটা সময় সাপেক্ষ।’’
রফতানি বন্ধের পর ভারতের বাজারে দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলেই মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ভারত রফতানির দরজা না খোলা পর্যন্ত কার্যত গোটা এশিয়ার বাজারেই পেঁয়াজের জোগান কম থাকবে। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই দামও থাকবে ঊর্ধ্বমুখী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy